সময়ের ভাবনা

প্রযুক্তির যুগে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ

কার্ল মার্ক্সের সমীকরণে ইউরোপ ও বিশেষ করে ব্রিটেন ছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্ভাব্য জন্মস্থান। শিল্পোন্নত দেশগুলোয় হওয়ার কথা পুঁজিবাদের পতন এবং সাম্যবাদের উত্থানের উর্বর ভূমি। সেখানকার প্রোলেতারিয়েতরা দ্রুত নিজেদের অবস্থান ও বুর্জোয়াদের শোষণ সম্পর্কে সচেতন হবে। এর মধ্য দিয়ে ইতি টানবে বুর্জোয়াদের আধিপত্যে। কিন্তু মার্ক্সবাদীদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল দিন

কার্ল মার্ক্সের সমীকরণে ইউরোপ ও বিশেষ করে ব্রিটেন ছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্ভাব্য জন্মস্থান। শিল্পোন্নত দেশগুলোয় হওয়ার কথা পুঁজিবাদের পতন এবং সাম্যবাদের উত্থানের উর্বর ভূমি। সেখানকার প্রোলেতারিয়েতরা দ্রুত নিজেদের অবস্থান ও বুর্জোয়াদের শোষণ সম্পর্কে সচেতন হবে। এর মধ্য দিয়ে ইতি টানবে বুর্জোয়াদের আধিপত্যে। কিন্তু মার্ক্সবাদীদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল দিন কয়েক পরই। কারণ নয়া উদারনৈতিক দুনিয়ায় পুঁজিবাদের পতন তো হলোই না, বরং শিকড় শক্ত করল ইউরোপের মাটিতে। সেখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতি গিলে ফেলল কর্তৃত্ববাদী সরকাররা। মার্ক্স-পরবর্তী ইউরোপের চিত্র ভাবিত করেছিল মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক আন্তোনীয় গ্রামসিকে। কীভাবে কর্তৃত্ববাদী সরকার তাদের মসনদের মেয়াদ বাড়ায়, তিনি খুঁজেছেন তার জবাব। তারপর সামনে এনেছেন সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের আলাপ। 

গ্রামসি দেখিয়েছেন, কীভাবে শাসক শ্রেণী সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। কেবল ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই নয়, নিয়ন্ত্রণ করে সংস্কৃতির মাধ্যমেও। সংস্কৃতি দিয়েই শোষিতের মধ্যে সচেতনতা তৈরির প্রধান প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করানো হয়। শাসিতের জন্য শোষিত থাকাই নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়ার সম্মতি উৎপাদন করে। সংস্কৃতিকে সর্বজনীন সত্য হিসেবে দাঁড় করানো হয়। যেন সবকিছু এভাবেই ছিল এবং থাকবে। এভাবে শাসিতের পায়ে পরানো হয় অদৃশ্য শিকল। যেহেতু সংস্কৃতিকে দেখা হয় মানবাধিকারের অংশ হিসেবে। ফলে কোনোভাবে সংস্কৃতির রূপ নিয়ে কোথাও প্রবেশ করতে পারা মানে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে পারা। আজকের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে গ্রামসির তুলে আনা বিষয়টি আরো বেশি স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের মধ্য দিয়ে বিস্তার ঘটেছে তথ্যের। কিন্তু তথ্যের প্রাচুর্য মানেই তো আর সত্যের সহজলভ্যতা নয়। ব্যবহারকারীর সামনে কোন বয়ানকে হাজির করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক পরিষদ যদি কোনো একটি ন্যারেটিভের প্রতি পক্ষপাত কিংবা বিদ্বেষপূর্ণ হয়, তাহলে তা অবশ্যম্ভাবীভাবেই ব্যবহারকারীকে প্রভাবিত করবে। যে তথ্যের ওপর ব্যবহারকারীর অধিকার আছে, তা থেকে বঞ্চিত হবে। বরং সেই তথ্য তার সামনে যাবে, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ পরিষদ লাভবান হয়। ফলে যে শ্রেণী নীতিনির্ধারণ করে, তাদের সিদ্ধান্ত সার্বিক কিনা সেটাও বিবেচ্য। 

ষাট ও সত্তরের দশকে টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে সেখানকার সংস্কৃতির বিশ্বায়ন চলতে থাকে। মার্কিন তারকারা হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক তারকায়। ডিজিটাল জামানায় আধিপত্যের দেয়াল আরো মজবুদ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মূল্যবোধের কথাই ধরা যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্তৃপক্ষ নৈতিক বিচার-বিবেচনা মাথায় নিয়েই নীতিমালা প্রণয়ন করেন। এখন কথা হলো, কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যে মূল্যবোধ অনুযায়ী চলে তা কি সর্বজনীন মূল্যবোধ? নাকি অনেক শর্তের ফিল্টারে বের হয়ে আসা জুতসই মূল্যবোধ? অধিকাংশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব সিলিকন ভ্যালিতে। সেখানকার নৈতিকতার ফিল্টারও হয় মার্কিন সংস্কৃতির ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ও বিবর্তন মাথায় নিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ভারতে এর বৈসাদৃশ্য ঢের। কিন্তু মার্কিন তারকা যেমন আন্তর্জাতিক তারকা, সেভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার মূল্যবোধই সর্বজনীন মূল্যবোধ হয়ে উঠছে প্রযুক্তির দুনিয়ায়। বিপরীতে দুনিয়ার অন্য প্রান্তের তারকা বা মূল্যবোধ স্থানিক। অর্থাৎ সর্বজনীনতা একটা দার্শনিক সত্য আকারে থাকে। তাতে অধিকাংশ অনুসিদ্ধান্তই স্থানিক প্যারাডাইম থেকে বের হতে পারে না। বিশ্বায়নের মানে বিশ্বের ইউরোপায়ন।

ইউরোপীয় পণ্ডিতরা তাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে প্রাচ্যকে কীভাবে ‘‌অপর’ হিসেবে পাঠ করেছে, তার নমুনা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এডওয়ার্ড সাইদ তার ‘‌ওরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে। প্রযুক্তির জামানায় যা ঘটছে, তাকে খুব সম্ভবত ‘‌নিউ ওরিয়েন্টালিজম’ হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা ও নিউইয়র্কের সংস্কৃতি এক রকম নয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা ও নিউইয়র্ক একাকার হয়ে গেছে। এ একাকার হওয়ার মধ্য দিয়ে যে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন করা হয়েছে, তা নিউইয়র্কের; ঢাকার নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে নিউইয়র্কের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই। যখন কৌটিল্যকে প্রাচ্যের ম্যাকিয়াভেলি ও বিহযাদকে প্রাচ্যের রাফায়েল বলা হয়; তখন ম্যাকিয়াভেলি ও রাফায়েলকেই মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কৌটিল্য বা বিহযাদকে নয়। ইউরোপীয় দর্শনকে কেন ‘‌দর্শন’ বলা হয়, অথচ ভারতীয় দর্শনকে ‘‌ভারতীয় দর্শন’? সংজ্ঞায়নে ব্যবহৃত এ মানদণ্ডই নির্ধারণ করে ক্ষমতা। সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বৈচিত্র্যের নাম করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বৃহৎ শক্তির কাছ থেকে সংবাদ, তথ্য ও সংস্কৃতি আমদানি করে। কিন্তু তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে কিছু গ্রহণ করে না। এ একতরফা সংস্কৃতির বিনিময়ই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রথম পাঠ। সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও মূল্যবোধের ইউরোপায়নের একটা সংকট সামনে আনা যেতে পারে। পশ্চিমা সমাজে ধর্মীয় ব্যক্তিদের অপমান বাক-স্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে। মন্টি পাইথন’স লাইফ অব ব্রায়ানের মতো চলচ্চিত্র ইউরোপীয় ইতিহাসে বিস্তর। কিন্তু এশীয় দেশগুলোয় এটা ঘোরতর অপরাধ। ফলে কতটুকু পর্যন্ত বাকস্বাধীনতা ও কতটুকুতে আক্রমণ, তার ফারাক বের করতে পারাটা জরুরি হয়ে উঠেছে। আর ডিজিটাল যুগে সংস্কৃতির প্রবাহ যেহেতু আরো দ্রুত, ফলে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জায়গায় প্রশস্ত। 

১৯৪৮ সালে হিউম্যান রাইটস ঘোষণা করা হয়। যার ওপর ভিত্তি করে ষাটের দশকে জাতিসংঘ দুটি পৃথক মানবাধিকার নীতি গ্রহণ করে। প্রথমটি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র, আরেকটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র। কোনো জাতিই তার মূল্যবোধকে অন্য জাতি ও সভ্যতার বিরুদ্ধে উঁচু অবস্থানে দাঁড় করাতে পারবে না। আইনের উদ্দেশ্য যথেষ্ট যৌক্তিক। এ ধরনের প্রবণতার ফলাফল কেমন হতে পারে, তার নজির ইতিহাসে ভূরি ভূরি। ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে যে সাংস্কৃতিক বহুত্ব সুরক্ষার চুক্তি সই হয়, সেখানেও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিপরীতে অন্য সংস্কৃতির রক্ষাই উদ্দেশ্য। অবশ্য অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আঞ্চলিক ও স্থানীয়ভাবে কিছু নীতিমালা গ্রহণ করছে সাংস্কৃতিক বহুত্ব নিশ্চিত করার জন্য। সেটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। বরং তৈরি হয়েছে অন্য ঝামেলা। উন্নয়নশীল দেশগুলো নীতিমালার ক্ষেত্রে স্থানীয় সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে দলীয় সম্প্রসারণকে। সাংস্কৃতির বহুত্বের যে ধারণা তা পর্যবসিত হচ্ছে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতায়। যেহেতু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো দিন শেষে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ফলে কোনো দেশে টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীনদের কথা শুনতে অনেকটাই বাধ্য। তাছাড়া ভোক্তা আকর্ষণ ও মুনাফা বাড়ানোই থাকে প্রধান উদ্দেশ্য। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির অধিকার ও সামাজিক অধিকারকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হলো কিনা সেটার তোয়াক্কা খুব কমই করা হয়। 

প্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ অনেকাংশেই স্বাভাবিক নয়। ডিজিটাল যুগে এখানকার বোঝাপড়া, বিশ্বাস ও বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় এর মধ্য দিয়ে। প্রতিটি মনোমুগ্ধকর বয়ানের পেছনে থাকে ক্ষমতার সমীকরণ। সে সমীকরণ নির্ধারণ করে দেয় কার গল্প বলা হবে আর কার গল্প পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। মিডিয়া আউটলেটগুলো অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতাসীনদেরই ভাষ্যই বলে যায়। সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন সামাজিক দল কিংবা প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তির মতামত প্রকাশে একটা অবস্থান নিয়ে নেয়। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু কিংবা ক্ষমতাবহির্ভূতদের সব সময়ই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। ক্ষমতার সমীকরণে বিকৃত হয় বিশ্ববীক্ষা। তৈরি হয় লিঙ্গগত, বর্ণগত ও জাতিগত বৈষম্য। এমনকি কখনো কখনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্যও সম্মতি উৎপাদন করে। সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ একটি অর্থপূর্ণ আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগকে পর্যন্ত নষ্ট করে। ফিকে করে দেয় সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বহুত্বের ধারণা। কেবল বড় সংস্কৃতির পাশে তোষামুদে সংস্কৃতিকে দাঁড় করিয়ে রাখে। যেভাবে একনায়ক শাসক তার চারপাশে দাঁড় করিয়ে রাখে কেবল সমর্থক শ্রেণী। 

সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে কাটিয়ে ওঠার প্রথম শর্ত হলো তাকে স্বীকার করে নেয়া। মিডিয়া অবশ্যই সাংস্কৃতিক বহুত্বকে ধারণ করে উঠতে পারে। সেটা তৈরি করার জন্যই তাকে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু প্রযুক্তির জমানায় ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে সে সম্ভাবনা। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই সম্মতি উৎপাদন করে নিচ্ছে পুঁজিবাদ ও একনায়করা। দীর্ঘ হচ্ছে শোষিতের নির্যাতন। প্রায় এক শতক পার করেও তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন গ্রামসি।

আহমেদ দীন রুমি: সহসম্পাদক, দৈনিক বণিক বার্তা

আরও