বাংলাদেশের প্রযুক্তির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কিংবদন্তি প্রকৌশলী, স্থপতি, গবেষক ও শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। এক দশকেরও বেশি সময় স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি। অত্যন্ত কাছ থেকে স্যারকে দেখেছি। তিনি অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুচারুভাবে সম্পাদন করতেন। স্যার অত্যন্ত সময়সচেতন একজন মানুষ ছিলেন। যেকোনো প্রোগ্রামে সময়ের আগেই হাজির হতেন। ছোট-বড় সবার সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সুন্দর করে কথা বলতেন। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোরে তিনি ইন্তেকাল করেন। পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীকে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে স্যারের কর্মময় জীবনের ওপর সামান্য আলোকপাত করছি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বহু তরুণ প্রকৌশলী ও ডাক্তার উন্নত জীবনের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন তার বিপরীত। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে দেশের সেবা করার জন্য, দেশের ঋণ শোধ করার জন্য বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী যত বড় বড় অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে তার প্রতিটির সঙ্গে রয়েছে তার সম্পৃক্ততা ও অসামান্য অবদান।
বাংলাদেশ সরকারও এ দেশপ্রেমিক মানুষটিকে তার সম্মান দিয়েছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১৭ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার পাঁচ বছরের জন্য তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। দেশের কীর্তিমান মানুষ অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর অবিভক্ত আসামের সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মা হায়াতুন্নেছা চৌধুরী দম্পতির তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান জামিলুর রেজা চৌধুরী। ছোটবেলায় পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে পরিচিত ছিলেন প্রকৌশলী বাড়ির ছেলে হিসেবে। কারণ তার বাবা ও ভাইসহ একই পরিবারে ছিল ১২-১৩ জন প্রকৌশলী। মাত্র তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান আসামের জোড়হাটে। ১৯৪৭ সালে আবার ফিরে আসেন সিলেটে এবং চাকরির সুবাদে তার বাবা বদলি হয়ে চলে যান ময়মনসিংহে।
ছোটবেলায় হ্যাট পরে রাজকীয় আসনে ট্রলিতে বসার লোভে রেলে চাকরি অথবা আইসক্রিম খাওয়ার লোভে আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে চাকরি নিতে চাইলেও তা ছিল ক্ষণিকের মোহ। কিছুদিন পরই তা ভুলে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ভর্তি হন তৎকালীন আহ্ছানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যা বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট। ১৯৬৩ সালে পুরকৌশল বিভাগ থেকে সম্মানসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। মাত্র ২০ বছরে জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে বুয়েট থেকে শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম অনার্সসহ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন আর দ্বিতীয় শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৬৩ সালে পেয়েছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। ২৮ অক্টোবর ১৯৬৩ থেকে বুয়েটে তার শিক্ষাকতা জীবন শুরু হয়।
১৯৬৪ সালে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। এ বৃত্তি বছরে একটাই দেয়া হতো। পৃথিবীখ্যাত ইংল্যান্ডের সাউদাম্পাটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল ‘কংক্রিট বিমে ফাটল’। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। থিসিসের বিষয় ছিল ‘কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং।’ পরিচিত হন পৃথিবীর প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের সঙ্গে। জীবনে প্রথম কম্পিউটার দেখেন এবং সেখান থেকে কম্পিউটারে হাতে খড়ি হয়।
বিশ শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার আসে। ১৯৬৮ সালে বুয়েটে প্রথম কম্পিউটার শিক্ষা শুরু হয়। যারা বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী উঁচু দালান, কল-কারখানা, ট্রান্সমিশন টাওয়ার, এয়ারক্রাফট হ্যাঙ্গার, স্টেডিয়াম, জেটি নির্মাণ বা সারা দেশে কম্পিউটার প্রযুক্তি বিকাশে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এসবের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
২০০১ সালে বুয়েটের বর্ণাঢ্য অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমৃত্যু তিনি এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অবকাঠামো উন্নয়ন গবেষণাসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে এবং সম্মিলন-সংক্রান্ত প্রকাশনায় এ পর্যন্ত তার ৬৬টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
দেশের ক্রান্তিকালে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন কর্তৃক স্বর্ণপদক (১৯৯৮), গবেষণা এবং শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য বুয়েট থেকে পান ড. রশিদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭), শিক্ষা, লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে অবদান রাখার জন্য স্বর্ণপদক (১৯৯৯), বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদানের জন্য রোটারির সিড অ্যাওয়ার্ড (২০০০), বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি স্বর্ণপদক (২০০৫), শেলটেক পুরস্কার (২০১১), কাজী আজহার আলী স্বর্ণপদক (২০১১), ডা. ইব্রাহিম মোমোরিয়াল স্বর্ণপদক (২০১২), জাইকা (জাপান) প্রেসিডেন্ট পদকসহ (২০১৩) আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করে বিরল সম্মানে ভূষিত করা হয়।
শিক্ষকতা পেশাকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নে তার অবদান অসামান্য। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকতা করতে হলে শিক্ষকদের সব সময় পড়াশোনা করতে হয়। শিক্ষকদের আরেকটা দায়িত্ব—কীভাবে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান অর্জন করা।’ বুয়েটের শিক্ষাকে তিনি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
২০১৮ সালে রোমানিয়ায় অনুষ্ঠেয় ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ স্বর্ণপদক জয় করে। বাংলাদেশকে নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী এ কিংবদন্তি প্রকৌশলী, স্থপতি, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পাবেন। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর অবদান অসামান্য। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন তার কর্মের মাঝে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন।
এম এ আলিম খান: আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের (ভাব) সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর