রিটার্নে অপ্রদর্শিত সম্পত্তি প্রদর্শনের বিধান শুধু কাগজে-কলমেই

আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি

দেশে বিদ্যমান আয়কর আইনের ২১ নং ধারায় কোনো নিবাসী বাংলাদেশী করদাতার বিদেশে সম্পদ থাকলে তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করা হয় ২০২২ সালের জুলাইয়ে। প্রদর্শন না করলে প্রয়োজনীয়

দেশে বিদ্যমান আয়কর আইনের ২১ নং ধারায় কোনো নিবাসী বাংলাদেশী করদাতার বিদেশে সম্পদ থাকলে তা আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করা হয় ২০২২ সালের জুলাইয়ে। প্রদর্শন না করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে সেখানে। বিধানটিতে এ ধরনের কোনো সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে অনুসন্ধান চালানো এবং সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইনে বিধানটি যুক্ত হওয়ার পর সময় পেরিয়েছে প্রায় আড়াই বছর। এ সময়ের মধ্যে বিধানটির আওতায় অনুসন্ধান চালানো হয়েছে মোটে একটি। যদিও বিগত সরকারের আমলে সাবেক মন্ত্রী, আমলাসহ ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী বাংলাদেশীর বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তোলার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এসব সম্পদের বিপরীতে আইনের ধারাটির প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়নি। কিন্তু যদি যথাযথভাবে আইনের এ ধারার প্রয়োগ করা যেত তাহলে অর্থ পাচার প্রতিরোধে অনেক শক্তিশালী হাতিয়ার হতো। কিন্তু বাস্তবে আয়কর আইনের এ ধারা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কেননা এর জন্য যে ধরনের সহযোগিতা ও উদ্যোগ দরকার তা সরকার নেয়নি। বিদেশে কোনো বাংলাদেশীর সম্পদ আছে কিনা তার সত্যতা ও মালিকানা নিশ্চিত করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর জন্য দরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা বাড়ানো এবং বিদেশী মিশনগুলোয় কর কর্মকর্তাদের নিয়ে আলাদা একটি সেল গঠন করা। তারা কোনো তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সাড়া মিললে কাজ শুরু করতে পারবে এবং কেউ তথ্য না দিলেও নিজ উদ্যোগে দেশে-বিদেশে সম্পদের খোঁজ নিতে পারবে। কিন্তু সরকার সে রকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অপ্রদর্শিত নিবাসী বাংলাদেশী করদাতার বিদেশে থাকা সম্পত্তিসংক্রান্ত ধারাটির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ বিদেশে যে পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়েছে তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে এর সত্যতা ও মালিকানা নিশ্চিত করা দরকার। সত্যতা নিশ্চিত হলে জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।

দেশী-বিদেশী ঋণ, সুদ ও ভর্তুকির দায় পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে বাংলাদেশের। নিজস্ব অর্থায়নে দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই দেশের। ঋণ করেই এসব দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে ক্রমেই বাড়ছে পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম প্রধান খাত রাজস্ব আয়। প্রতি অর্থবছরই সরকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু কখনই তা বাস্তবায়ন করতে পারে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের সময় যেসব শর্ত বেঁধে দিয়েছিল, এর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজস্ব আয় বাড়ানো। অর্থাৎ কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো। সংস্থাটি একটি লক্ষ্যমাত্রাও দিয়েছিল। তবে এ বছরের জুন শেষে সংস্থাটির লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আহরণ করতে পারেনি। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত না করা, কর সম্প্রসারণে জরিপ কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা ও পদ্ধতিগত সমন্বয়হীনতা; কর ব্যবস্থাপনার তথ্য বিনিময়ের অপ্রতুলতা এবং দক্ষ জনবলের স্বল্পতা ও ভৌত অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাব। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকায় অর্থ পাচারও ঠেকানো যাচ্ছে না। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এসব প্রতিবন্ধকতা নিসরনসহ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতে সরকারকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। এর মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়িয়ে দায় পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে দেশের অর্থনীতিবিদ-বিশেষজ্ঞসহ আইএমএফ পরামর্শ দিচ্ছেন। নিজস্ব আয় থেকে ঋণ, সুদ ও ভর্তুকির দায় পরিশোধে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। অথচ বাস্তবতা তার বিপরীত। গত এক দশকে কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে বরং কমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা ঘোচেনি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর চার মাসে নিত্যপণ্যে ব্যাপক শুল্ক-কর ছাড় দেয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার কিছু সুযোগ। এতে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরো ঝুঁকিতে রয়েছে। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানো জরুরি।

গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) ছিলেন। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ৪৩ লাখ। টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে কর প্রদান বাড়েনি। অর্থাৎ নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়লেও রিটার্ন জমা দেয়া ব্যক্তির সংখ্যা সেই তুলনায় কম। কমসংখ্যক রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য অপর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত করদাতা জরিপের অনুপস্থিতি এবং কর প্রশাসনের অটোমেশনের ধীরগতিই দায়ী। এছাড়া রিটার্ন দাখিলে প্রমাণপত্র (পিএসআর) যথাযথভাবে তদারকি হচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে দেশে কর আদায় ব্যবস্থা যথাযথভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। ফলে কর প্রদানে মানুষের আগ্রহ কম। প্রত্যক্ষ কর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়া কর ব্যবস্থাপনায় এনবিআরের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। এনবিআরের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে কর কাঠামোর সংস্কার আবশ্যক। এছাড়া প্রত্যক্ষ কর আহরণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হলো কর জমাদানের প্রক্রিয়াটি এখনো জটিল। করদাতাদের স্বেচ্ছায় কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে। করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া করদাতাবান্ধব হতে হবে। এছাড়া করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে। আয়করযোগ্য ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা গেলে রাজস্ব আহরণ বহুগুণে বেড়ে যাবে।

কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে রাজস্ব আহরণে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের ভার যাদের ওপর তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। করদাতাকে হয়রানি এবং অর্থের বিনিময়ে বড় বড় কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কর ফাঁকি দেয়ার বন্দোবস্ত করে দেন তারা। ফলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হয়নি এবং বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ থেকে বঞ্চিত হয় দেশ। কর ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন ও সংস্কারের পাশাপাশি কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে।

আইএমএফ রাজস্ব আয়ের একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল। গত অর্থবছর অর্থাৎ এ বছরের জুন শেষে আইএমএফের বেঁধে দেয়া রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর রাজস্ব আয় হয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ কর রাজস্ব কম আয় হয়েছে। কেবল আইএমএফের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা নয়, বাজেটে উল্লিখিত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। এ কারণে দেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে। এমনকি নিজস্ব আয় কম হওয়ায় ঋণ করে সরকারের বিভিন্ন দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই কেবল আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রাই নয়, দেশের অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজস্ব আয় বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর আহরণ বাড়ানোর পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

আরও