আলোকপাত

বিগত সরকারের লুটপাটতন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ ও শ্বেতপত্রের প্রধান দিক

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে।

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। ২৯ আগস্ট সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। কমিটিকে সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতির হাল-হকিকত গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমাদানের দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটি গত ১ ডিসেম্বর ড. ইউনূসের কাছে তাদের শ্বেতপত্রটির খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শ্বেতপত্রটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ (ডিসেকশন অব এ ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভ)। প্রায় ৩৯৬ পৃষ্ঠার খসড়া রিপোর্টে নাকি ২৪টি অধ্যায় রয়েছে। ড. দেবপ্রিয় শেখ হাসিনার শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) থেকে সরাসরি ‘চোরতন্ত্রে’ (ক্লেপ্টোক্রেসি) রূপান্তরিত হওয়ার দাবি করেছেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন পর শেখ হাসিনার একটা বক্তব্য ছিল, ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দুহাতে টাকা বানাতে হবে’। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজ সম্প্রতি হাসিনার এ মন্তব্যটির উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের গণমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তখন সোহেল তাজ ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। ২০০৯ সালের মে মাসে সোহেল তাজ পদত্যাগ করেছিলেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাড়ে পনের বছরের স্বৈরশাসন শেখ হাসিনাকে বেলাগাম লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসনামলে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা-লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এ পুঁজিলুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল শেখ হাসিনা-পুত্র জয়, শেখ রেহানা-কন্যা টিউলিপ ও পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল, তার ভাই শেখ জুয়েল ও তার পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তার পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং শেখ হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আর ছিল লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। অতিসম্প্রতি শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান এফ রহমান নিজেও তার মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, যে দায় এখন ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রায় সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চ স্তরের নেতাকর্মী এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও গত সাড়ে পনেরো বছরে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি ও পুঁজিলুণ্ঠনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। জনমনে একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। পুরো ব্যাপারটিই এখন ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার পতিত সরকার ‘ডাটা ডক্টরিং’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পুঁজিলুণ্ঠন ও পুঁজিপাচারকে ছড়িয়ে দিয়ে হাসিনা উন্নয়নের এ ‘মিথ্যা বয়ান’ রচনা করেছেন, যার প্রকৃত রূপটি শ্বেতপত্রে ফুটে উঠেছে। গত ১ ডিসেম্বর সরকারের কাছে জমা দেয়া শ্বেতপত্রটির নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হতে শুরু করেছে। শ্বেতপত্রটির পূর্ণাঙ্গ অবয়ব এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি সাধারণ জনগণের। তবুও বলব, প্রকাশিত অংশগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, শ্বেতপত্রটি সত্যিকারভাবেই স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কথিত উন্নয়ন বয়ানের আড়ালে লুক্কায়িত ‘অবিশ্বাস্য লুটপাটতন্ত্রের একটি নির্মোহ ব্যবচ্ছেদের দলিল’ হিসেবে দেশের ইতিহাসে স্থান করে নেবে। নিচে এরই মধ্যে প্রকাশিত শেতপত্রের প্রধান দিকগুলো বর্ণনা করছি:

এক. শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। শ্বেতপত্রে খাতওয়ারি লুণ্ঠনের তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটন করে লুণ্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে মোট ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুণ্ঠন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লুটেরা রাজনীতিবিদদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়াড়, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী, শেখ হাসিনার আত্মীয়-স্বজন এবং ‘ইনফ্লুয়েন্স প্যাডলার’ ও ‘হুইলার-ডিলাররা’ এ লুটপাটতন্ত্রের প্রধান খেলোয়াড়। এসব লুটেরা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান, সরকারি রাজস্ব আহরণ বিভাগ ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগগুলোকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফায়দা হাসিলের অংশীদার করে ফেলেছে। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে এরা দুর্বল করে ফেলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামিয়েছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে।

দুই. কানাডায় ৪৭ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। দুবাইয়ে ৯৭২ জন বাংলাদেশীর রিয়েল এস্টেট সম্পত্তি রয়েছে, মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ কার্যক্রমে ঘরবাড়ি কিনেছে ন্যূনপক্ষে ৩ হাজার ৬০০ জন বাংলাদেশী।

তিন. সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৩-৪০ শতাংশ আত্মসাৎ হয়েছে।

চার. সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মোস্তফা কামালের নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে ‘ডাটা ডক্টরিং’-এর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, একই সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশের রফতানি আয়কে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারকে সবসময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকে কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহার কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। একই সঙ্গে দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেটকে’ কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে বলে প্রচার করা যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রফতানি আয় আগের বছরে বিগত সরকার যতখানি দেখিয়েছিল তার চেয়ে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সাবেক সরকার দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি। দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার হার ১৮ শতাংশে নেমে গেছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ হার অনেক বেশি। আরো গুরুতর হলো এ দারিদ্র্য হার টেকসই নয়। মাসে দুদিন কাজ না পেলে দেশের দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় বলে দাবি করেছে শ্বেতপত্র কমিটি।

পাঁচ. দেশের সাতটি মেগা প্রকল্পের ব্যয় প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে ধরে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে, যার আনুমানিক পরিমাণ ৮০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এ মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে—পদ্মা সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, পায়রা বন্দর প্রকল্প এবং মাতারবাড়ী কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোর যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ এবং ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ না করার কারণে এ ৭০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাত সৃষ্টি হয়েছে।

ছয়. দেশের ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ পৌনে সাত লাখ কোটি টাকা। শ্বেতপত্র কমিটি প্রকৃত খেলাপি ঋণকে ‘ডিসট্রেসড এসেট’ নামে অভিহিত করেছে। শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে যে এ ‘ডিসট্রেসড এসেট’ দিয়ে ১৩ দশমিক পাঁচটি ঢাকা মেট্রোরেল কিংবা ২২ দশমিক ৫টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। অবৈধ হুন্ডি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৩ দশমিক ৪ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ১০টি ব্যাংক ‘টেকনিক্যালি দেউলিয়া’ হয়ে গেছে, যেগুলোর মধ্যে দুটো ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত আর বাকি আটটি ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক। এগুলোয় তারল্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জনতা ও বেসিক ব্যাংক বড় ধরনের ঋণ লুটপাটের শিকার। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ঋণ লুটেরা ইসলামী ব্যাংক ও অন্য শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।

সাত. দেশের শেয়ারবাজার থেকে কমপক্ষে ২৭ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আত্মসাৎ করা হয়েছে। নানা কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ১ ট্রিলিয়ন টাকারও (১ লাখ কোটি) বেশি লুটপাট করেছে কয়েকজন চিহ্নিত খেলোয়াড়। ২০১০-১১ সালের শেয়ারবাজারের পরিকল্পিত ধসের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির রিপোর্টকে কোনো পাত্তা দেয়া হয়নি, যেজন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হারিয়ে ফেলেছে।

আট. দেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ২০২২ সালে দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বিশ্বব্যাংকের জরিপে যে ৭২টি দেশের আয়বৈষম্য রিপোর্ট করেছে তার মধ্যে এর চেয়ে বেশি জিনি সহগের মান ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও পানামা—এ তিন দেশে বিদ্যমান। তার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের সম্পদবৈষম্যের পরিমাপক জিনি সহগ, ২০১৬-২২ সালে যেটা দশমিক ৮২ থেকে দশমিক ৮৪-তে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ এখন একটি মারাত্মক উচ্চ আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্যের দেশ।

নয়. দেশের মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হারকে ১৯৯৫ সাল থেকে কয়েক শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে, যেজন্য উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের অনেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ‘প্যারাডক্স’ অ্যাখ্যায়িত করেছেন। পতিত স্বৈরাশাসকের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাবেক সরকারের প্রক্ষেপিত ৬ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে এসে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।

দশ. শ্বেতপত্রে আনুমানিক ৭৭ হাজার কোটি থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলা হয়েছে। ৭০ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজনীতিবিদদের করায়ত্ত হয়েছে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এসব আমলা ও রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।

এগার. দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি লুট করা হয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টের ‘ক্যাপাসিটি চার্জের’ নামে লুট করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে মাত্রাতিরিক্ত দামে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে।

বার. কর অব্যাহতি (ট্যাক্স একজাম্পশন) প্রদানের মাধ্যমে কয়েক বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ কর অব্যাহতিগুলোকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা গেলে শিক্ষা খাতের ব্যয় দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় তিন গুণ বাড়ানো যেত।

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি;

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,

অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও