অভিমত

সুশিক্ষা নিশ্চিতে ভালো শিক্ষক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুরুত্ব

শিক্ষা অমূল্য সম্পদ, জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। কারণ শিক্ষাই মানুষের ভেতরকার সুপ্ত আত্মাকে জাগরিত করে। মানুষকে ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে এবং তাদের করে তোলে আত্মসচেতন। এজন্য প্রতিটি জাতির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত সর্বজনীন। আর যদি সেটা না হয় তবে কোনো সমাজ বা জাতিই প্রকৃত

শিক্ষা অমূল্য সম্পদ, জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না। কারণ শিক্ষাই মানুষের ভেতরকার সুপ্ত আত্মাকে জাগরিত করে। মানুষকে ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে এবং তাদের করে তোলে আত্মসচেতন। এজন্য প্রতিটি জাতির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত সর্বজনীন। আর যদি সেটা না হয় তবে কোনো সমাজ বা জাতিই প্রকৃত আলোর মুখ দেখতে পায় না। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের আগে জাতীয় নেতাদের খুব সতর্ক ও কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হয়। তা না হলে জাতিকে একসময় এর চরম মূল্য দিতে হয়। আর কোনো রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। 

পাশাপাশি সম্মানিত শিক্ষকরা সেই শিক্ষার কাণ্ডারি, ধারক ও বাহক এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের প্রকৃত কারিগর। মূলত শিক্ষক বলতে শুধু আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুরুদেরই মূল্যায়ন করে থাকি। আসলে বিষয়টি এমন নয়। পৃথিবীর সূচনালগ্নে আমাদের আদিম পিতা-মাতার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। নবী-রাসুলরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তবে তারা কি অশিক্ষিত কিংবা মূর্খ ছিলেন? মোটেই না। বাড়িতেও তাদের জন্য ছিল না কোনো গুরুগৃহ কিংবা হোম টিউটরের সাধারণ ব্যবস্থা। সবাই এক বাক্যে বলবেন তা কেমনে হয়? কারণ যুগে যুগে মহান আল্লাহর প্রেরিত এসব বার্তাবাহকই তো মানবকুলকে দিয়েছেন সঠিক আলোর দিশা। 

একজন শিশুর প্রথম শিক্ষক তার পরিবার, তার বাবা-মা, যেখান থেকে সে পায় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা যা চরিত্র গঠনের মূল হাতিয়ার। তাই পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতা থাকলে একজন মানুষকে সারা জীবন ধরেই তার ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়। মূলত এজন্যই নেপোলিয়ন সুন্দর একটি জাতি গঠনের জন্য শিক্ষিত মায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ একজন স্বশিক্ষিত মা-ই পারেন একটি সুসন্তান উপহার দিতে। এভাবে তৈরি হয় মানবসম্পদের এক একটি বীজ। গড়ে ওঠে এক একটি সুন্দর পরিবার যা কোনো একটি রাষ্ট্রের মনোমারিক ইউনিট। রসায়নের ভাষায় অনেকগুলো মনোমার মিলে হয় এক একটি পলিমার। ঠিক এমনিভাবেই প্রতিটি পরিবার কোনো একটি রাষ্ট্রের ডিস্ট্রাকচারাল ইউনিট হিসেবে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। তাই পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্বকে যেকোনোভাবে অবমূল্যায়ন করা হলে তা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

এরপর শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এখানে সে অর্জন করে নিজেকে আলোকিত করার সব সরঞ্জাম। সমাজ ও রাষ্ট্র সেই শিক্ষা ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক একটি শিশুকে প্রথমে হাতে ধরে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলে যদিও শিক্ষিত কোনো পরিবারে একজন স্বশিক্ষিত মা মহৎ এ কাজটুকু সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট। আর এ কারণেই সুন্দর জাতি গঠনের জন্য শিক্ষিত একজন মায়ের প্রয়োজন এতটা বেশি। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা অপরিহার্য। এখানে ভালো বেতনে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া না হলে শিশুরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। এভাবে ধাপে ধাপে একজন মানুষ হাই স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পর্যায়ে অধ্যয়ন করে সম্পন্ন করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। পুঁথিগত বিদ্যা লাভের মাধ্যমে এভাবে একের পর এক অর্জন করে এক গাদা সনদ যা কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার প্রকৃত ভিত রচনা করে যদিও কর্ম দক্ষতা অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা একটি বিষয়। 

পাশাপাশি মানুষ বাস্তব শিক্ষা পায় প্রকৃতি থেকে, যা একজন মানুষকে বাস্তবতার কশাঘাতে টিকে থাকার কঠিন শিক্ষা দেয়। মানুষ পদে পদে দীক্ষা গ্রহণ করে বাস্তবতার বীভৎস রূপ থেকে। কর্মজীবনের প্রতিযোগিতার বাজারে প্রকৃতি প্রদত্ত বাস্তব শিক্ষা মানুষকে টিকে থাকতে সাহায্য করে যা কাউকে দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে সোনা বানায়। কত ধানে কত চাল, তা চিনতে শেখায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে এ শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় না হলে অর্জিত শিক্ষাগত সনদগুলো একজন মানুষের কর্মজীবনে সাফল্যের ঝরনাধারা পুরোপুরিভাবে বয়ে আনতে পারে না। তাকে পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। এভাবেই একজন মানুষ সুনাগরিক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পরিপক্বতা অর্জন করে বাস্তবতার বৈচিত্র‍্যময় রূপ থেকে। আবার উল্টোটাও হতে পারে যেভাবে বাংলা সিনেমায় নায়ক ভিলেন বনে যায়। এখান থেকেই একজন মানুষ অমানুষও হতে পারে, আবার একজন অমানুষও হতে পারে সত্যিকারের মানুষ। 

সর্বোপরি সব শিক্ষকের ওপর আছেন মহান সৃষ্টিকর্তা, যার প্রদত্ত বিধিনিষেধ পালনের মাধ্যমেই একজন মানুষের মধ্যে সুন্দর আত্মার বিকাশ ঘটে। মানুষ শিখতে পারে অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঠিক ও সুষ্ঠু প্রয়োগ। অন্য কোনো শিক্ষা যদি নাও থাকে শুধু এ শিক্ষাই একজন নিরক্ষর মানুষকেও গড়ে তুলতে পারে সুনাগরিক কিংবা মহামানব হিসেবে। আর এভাবেই যুগে যুগে মহান আল্লাহর প্রেরিত পুরুষরা আসমানি প্রত্যাদেশ লাভ, বহন ও প্রচার করে নিজেরাও মানবতার প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছেন এবং নিজ নিজ সম্প্রদায়কে দিয়েছেন সত্য ও সঠিক দিকনির্দেশনা। তারা ধন্য হয়েছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক দুভাবেই। এভাবে মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে যখন অন্য সব শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় ঘটে, তখনই শিক্ষা পায় পরিপূর্ণতা। আর এ পথেই একজন শিশুর ভেতরে লুক্কায়িত সব সুপ্ত প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। গড়ে ওঠে দক্ষ মানবসম্পদ, জন্ম নেয় সুনাগরিক। পূর্ণাঙ্গতা পায় মানবজীবন। সমৃদ্ধ হয় দেশ ও জাতি। সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ লাভ করে বিশ্ব মানবতা। সার্থক হয় সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে মানবজাতির আগমনী ধারা। 

অতএব শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্যাটাগরির উন্নয়নের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। কারণ শিক্ষার মতো একটি মৌলিক অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত হলে কোনো জাতির প্রকৃত অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। কাজেই এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মপন্থা বা পলিসি প্রত্যেক রাষ্ট্রের থাকা উচিত, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে। কেননা রাষ্ট্র স্বয়ং শিক্ষার এই ক্যাটাগরির পৃষ্ঠপোষকতা করে। তাই যিনি শিক্ষা দেবেন প্রথমেই তার পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা ও জীবনমানের ব্যবস্থা সমন্বয় করতে হবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিশুরা শিক্ষার প্রকৃত সুবিধা ও পরিবেশ পাচ্ছে কিনা সেটাও নজরে আনা একান্তভাবে জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় গোল্ডেন জিপিএর অন্ধ প্রতিযোগিতা ছেলেমেয়েদেরকে এমনকি অভিভাবক মহল, বিশেষ করে মায়েদেরকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। অভিভাবক বনাম অভিভাবক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা হয় এ প্রতিযোগিতার শিকার। অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে কোমলমতি শিশুরা একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে শিক্ষার প্রতি। এরপর সবচেয়ে যেটি বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের কারিকুলামকে অনুসরণ করে বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিতে দলমত নির্বিশেষে সত্যিকারের পণ্ডিতদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত। পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সব চক্রান্তের বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নেয়া বাঞ্ছনীয়। 

ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে অনেক সময় নীরব ঘাতক ঘুণ পোকার মতো সবকিছু শেষ করে দেয়। তাই সর্ষের ভেতরকার ভূত শুরুতেই দূর করতে হবে। কারণ পূর্বপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে প্রকৃত শিক্ষা ধ্বংস করে কোনোভাবে যদি একটি প্রজন্মকে অথর্ব করে দেয়া যায় তবে সে জাতি হারিয়ে ফেলে উজ্জীবনী শক্তি। এতে স্বাধীনতার ছদ্মাবরণে পশ্চাৎপদ একটি জাতিকে খুব সহজেই পরাধীনতার শেকলে বন্দি রাখা যায়। রাষ্ট্রকে করা যায় অকার্যকর। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ কিংবা ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’ ফলপ্রসূ স্লোগান দেয়ার মতো অবশিষ্ট কেউ আর থাকে না ঊষর এ জনবসতির ভেতরে। লাভবান হয় বিদেশী প্রভুরা এবং তাদের এ দেশীয় সাময়িক সুবিধাভোগী কুশীলবরা। কাজেই আলোচিত প্রতিটি বিষয় বিবেচনায় রেখেই শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া অত্যাবশ্যক। কারণ একটি সুশিক্ষিত জাতিই পারে সুষ্ঠুভাবে গণতান্ত্রিক একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে যেখানে জনগণ লাভ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। ঠিক তখনই দেশের জনগণ আস্বাদন করে স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বাদ। আর এটিই কোনো একটি রাষ্ট্রের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। 

ড. মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও