অসমতা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বহুল আলোচিত বিষয়। বিশ্বের নানা দেশে আয় কিংবা আয়বহির্ভূত বিষয়গুলোয় অনপেক্ষ দারিদ্র্যের আপাতন কমে এসেছে, কিন্তু অসমতার ব্যাপ্তি বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে অসমতা নানা আঙ্গিকে বিরাজমান—আঞ্চলিকতার প্রেক্ষিতে, আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, সামাজিক সেবার লভ্যতার ক্ষেত্রে, পরিবেশ বিভাজনের কারণে, নর-নারীর মধ্যে। সেই সঙ্গে অসমতা রয়েছে সুযোগের মধ্যে এবং সেই সঙ্গে ফলাফলের ক্ষেত্রেও। আসলে অনেক সময়ে সুযোগের বৈষম্যই (যেমন শিক্ষা-সুযোগের ক্ষেত্রে) ফলাফল অসমতায় (যেমন আয়-প্রাপ্তির পরিপ্রেক্ষিত) প্রতিফলিত হয়। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বিত্তশালী ১০ ব্যক্তির সম্পদ বিশ্বের জনসংখ্যার নিম্নতম ৩১০ কোটি জনগোষ্ঠীর সমান। কভিড-১৯ অতিমারীর পর বৈশ্বিক অসমতা আরো বেড়েছে। ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম বৈশ্বিক অসমতা ক্রমবর্ধমান। কারণ ওই অতিমারীর পর বিশ্বের ২০ শতাংশ সবচেয়ে বিত্তশালী মানুষের আয়ের তুলনায় বিশ্বের ৪০ শতাংশ দরিদ্রতম মানুষের আয় দ্বিগুণ হ্রাস পেয়েছে।
ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে যখন কৃষি অর্থনীতিই সমাজের মূল স্তম্ভ ছিল, তখন ভূমির বণ্টনই সমাজে অসমতার মূল চালিকাশক্তি ছিল। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার সুযোগ ও শিক্ষায় অর্জন অসমতার নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন সমাজে তথ্যপ্রযুক্তি লভ্যতার ক্ষেত্রে যে বিভাজন রয়েছে, সেটাই আজকের দিনে সামগ্রিক আর্থসামাজিক বৈষম্যের একটি মূল কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে তিন দশক ধরে বিশ্বে একটি তথ্যপ্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। ২০২৪ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫৫০ কোটি মানুষ (পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ) আন্তর্যোগ ব্যবহার করেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বৈশ্বিকভাবে প্রায় ৯০০ কোটি মানুষ মুঠোফোনের গ্রাহক ছিলেন (অনেকের একাধিক ফোন ছিল)। ফলে মানুষের কাজের প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হয়ে তার কাজের জগৎ বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষে মানুষে সংযোগের প্রকৃতি, মানুষের উদ্ভাবন, তার ব্যবসা-বাণিজ্য, যার ফলে বৈশ্বায়নও ত্বরান্বিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে বৈশ্বিকভাবে পণ্যসামগ্রী এবং সেবার উৎপাদন ও বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে বিশ্বে পণ্যসামগ্রীর বাণিজ্য ছিল ১৯ লাখ কোটি ডলারের, ২০২৩ সালে সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ কোটি ডলারে। বৈশ্বিক সেবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ৫ লাখ কোটি ডলার এবং ৭ লাখ কোটি ডলার।
তবে সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি বঞ্চনাও বিদ্যমান। বিশ্বের ২৬০ কোটি লোক এখন পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এবং এর বেশির ভাগ মানুষই উন্নয়নশীল বিশ্বে বাস করে। বিশ্বের ১০০ কোটি লোকের আত্মপরিচয়ের কোনো পরিচয়পত্র নেই। সুতরাং নানা তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা ও সুযোগ তারা গ্রহণ করতে পারে না। আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তীকরণ বহু মানুষের কাছে এখনো একটা স্বপ্নের বিষয়। তাই বৈশ্বিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তিতে সংঘটিত একটি বিশাল বিপ্লব সত্ত্বেও এবং সেই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিতে নানা বঞ্চনার পাশাপাশি এ প্রযুক্তির লভ্যতা এবং এর ব্যবহারের অঙ্গনে নানা অসমতা রয়েছে, যার ফলাফল হচ্ছে বৈশ্বিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি বিভাজন।
তথ্যপ্রযুক্তির বিভাজনটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে একটি ফারাক হিসেবে—তথ্যপ্রযুক্তির লভ্যতা এবং সেই সঙ্গে নানা কর্মকাণ্ডে সে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান একটি বৈষম্যের নিরিখে। এ বৈষম্য ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে হতে পারে, আবার নানা আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেও থাকতে পারে। আন্তর্যোগে সম্পৃক্ত গোষ্ঠীরগুলোর এ সম্পৃক্ততার মধ্যকার নানা অসমতাই তথ্যপ্রযুক্তির বিভাজন চিহ্নিত করে—এ বিভাজন উন্নত বনাম উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে হতে পারে, ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যেও হতে পারে, আবার নারী-পুরুষের মধ্যেও হতে পারে। এ বিভাজন শুধু তথ্যপ্রযুক্তির লভ্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও দক্ষতার মধ্যেও এমন বিভাজন বিরাজ করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির লভ্যতা এবং তা ব্যবহারের দক্ষতা পারস্পরিকভাবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যন্ত্রের লভ্যতা না থাকলে তা ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করা যাবে না, আবার প্রয়োজনীয় দক্ষতাও যন্ত্রের অনুপস্থিতিতে কোনো কাজে আসবে না।
উন্নত দেশগুলো উচ্চতর তথ্যপ্রযুক্তির স্তর অর্জনে সমর্থ হয়েছে। উচ্চতর তথ্যপ্রযুক্তির কারণে এসব দেশে উন্নততর সমাজ, উচ্চতর অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা এবং সরকারি খাতের সুকর্মকাণ্ড অর্জন হয়েছে। এর মানে হচ্ছে যে ভোক্তারা, উদ্যোক্তারা ও সরকার অনেক বেশি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে এবং সে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছে। যেমন উন্নত বিশ্বে ৮৭ শতাংশ গৃহস্থালি আন্তর্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত ও ৮২ শতাংশ গৃহস্থালির কম্পিউটারের প্রবেশাধিকার আছে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল বিশ্বে ৪৭ শতাংশ গৃহস্থালিতে আন্তর্যোগের প্রবেশাধিকার আছে এবং ৩৯ শতাংশ গৃহের কম্পিউটারের লভ্যতা আছে। এ সংখ্যা স্বল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে আরো কম। এসব দেশে মাত্র ১২ শতাংশ গৃহস্থালির আন্তর্যোগে প্রবেশাধিকার আছে এবং মাত্র ১০ শতাংশ গৃহ একটি কম্পিউটারের মালিক। বহু খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বহু শ্রমিক কর্মচ্যুত হতে পারেন, যার ফলে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য বাড়তে পারে। এসব প্রক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং একটি দেশের অভ্যন্তরের বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির অসমতা আরো বিস্তৃত হতে পারে।
বৈশ্বিকভাবে শহরে আন্তর্যোগ ব্যবহারকারীর সংখ্যা গ্রামীণ ব্যবহারকারীদের সংখ্যার দ্বিগুণ। ২০২৩ সালের শেষের দিকে বিশ্বের তরুণ সমাজের (বয়স ১৫-২৪ বছর) তিন-চতুর্থাংশ আন্তর্যোগ ব্যবহার করছিল। অন্যদিকে অন্যান্য বয়ঃগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তর্যোগ ব্যবহারের হার ছিল ৫৭ শতাংশ এবং যাদের বয়স ৬৫ বছরের ওপর, তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি ছিল ৫ শতাংশের কম। সচল প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে। এ প্রযুক্তির মালিকানা, প্রবেশাধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তি সম্পৃক্ত যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবেই নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। পুরুষদের তুলনায় মুঠোফোনের মালিকানায় নারীদের মালিকানা ৭ শতাংশ কম এবং আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ফারাক ১৬ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে, আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যার তুলনায় ২৬ কোটি কম সংখ্যক নারী এখনো এটা ব্যবহার করে না। সুতরাং বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তির অঙ্গনে সামগ্রিক বিভাজনের মাঝে একটি নারী-পুরুষ বিভাজনও রয়েছে। যেমন ভারত ও মিসরে প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন আন্তর্যোগ ব্যবহার করে, কারণ তারা মনে করে যে এটা করা তাদের জন্য সমীচীন নয় এবং তাদের পরিবার এ কাজ অনুমোদন করে না। বিশ্বের বিভিন্ন অঙ্গনে নারী-পুরুষের সমতার ব্যাপারে বৈশ্বিকভাবে নানা অগ্রগতি হলেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরা এখনো একটি অসম অবস্থানে রয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অন্তরায়ের কারণে নারীরা তথ্যপ্রযুক্তির পুরো সুবিধা ভোগ করতে পারে না। সত্যিকারভাবে বিশ্বের অর্ধেক নারীরই তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার নেই। উন্নত বিশ্বে আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ফারাক যেখানে ২ শতাংশ, সেখানে উন্নয়নশীল বিশ্বে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি হচ্ছে ২৩ শতাংশ। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় এ ফারাক হচ্ছে ৪৩ শতাংশ। যেসব দেশে মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ফারাক বেশি, সেসব দেশে আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ বৈষম্য অনেক বিস্তৃত।
বৈশ্বিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তির যে বিভাজন রয়েছে, তা শুধু তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্তির পথেই বাধা নয়, বরং তা বিশ্বের সামগ্রিক উন্নয়নের পথেও এক বিরাট অন্তরায়। তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্তীকরণ ত্বরান্বিত করা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির বৈষম্য আজকের দিনে সমাজের সার্বিক অসমতার অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্তীকরণে সাম্য ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিভাজন দূরীকরণ—সমাজে এ জাতীয় বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এর দূরীকরণ বিশ্বে সার্বিক আর্থসামাজিক সাম্য অর্জনে সহায়ক হবে।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র