প্লাস্টিকের বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি অবগত এবং দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহারে অভ্যস্ত। দ্রুত নগরায়ণ ও উন্নয়নের সঙ্গে প্লাস্টিকের কম খরচ, টেকসই ও বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগিতা থাকায় এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে বর্তমান সময়কে প্লাস্টিক যুগ বলা যেতে পারে। এছাড়া কভিড-১৯ মহামারী প্লাস্টিকের প্যাকেজিং এবং শপিং ব্যাগের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে প্লাস্টিকের অপচনশীল প্রকৃতি পরিবেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাপ, চাপ এবং জীবাণুর প্রভাবে ভেঙে গিয়ে প্লাস্টিকের কণা ক্ষুদ্র আকারে পরিণত হয়, যাকে আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে চিনি। সাধারণত ৫ মিলিমিটারের (৫ হাজার মাইক্রোমিটার) চেয়ে ছোট আকারের কণাগুলোকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস মূলত বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের অবক্ষয় থেকে সৃষ্টি হয়। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, প্যাকেজিং সামগ্রী, টায়ার, কাপড়ের সিনথেটিক ফাইবার ইত্যাদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। সূর্যের আলো, তাপমাত্রা এবং প্রাকৃতিক ঘর্ষণের কারণে এ প্লাস্টিকগুলো ক্ষুদ্র টুকরো বা কণায় ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক পণ্য সরাসরি ছোট আকারে তৈরি করা হয়; যেমন স্ক্রাবিং পণ্য বা প্রসাধনীতে ব্যবহৃত মাইক্রো-বিড, যা ব্যবহারের পর পানির মাধ্যমে সরাসরি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের পলিমার রয়েছে, যাদের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার ভিন্ন। প্রথমত, পিইটিই (পলিথিন টেরেফথালেট), যা সাধারণত পানি ও পানীয়ের বোতল এবং রান্নার তেলের পাত্রে ব্যবহৃত হয়। এরপর এইচডিপিই (উচ্চ ঘনত্ব পলিথিন), যা বালতি, ডিটারজেন্টের বোতল এবং খাবারের পাত্রে ব্যবহৃত হয়। তৃতীয়ত, পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড), যা খাবারের ট্রে, পাইপ ও চেয়ারে ব্যবহৃত হয়। এলডিপিই (নিম্ন ঘনত্ব পলিথিন) সাধারণত ক্যারিয়ার ব্যাগ, রুটির ব্যাগ এবং খাদ্য সংরক্ষণ পাত্রে ব্যবহৃত হয়। পিপি (পলিপ্রোপাইলিন) প্লাস্টিক স্ট্র, শ্যাম্পুর বোতল এবং বোতলের ঢাকনায় ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় পলিমার। এছাড়া পিএস (পলিস্টাইরিন) প্রধানত ভেন্ডিং কাপ, প্যাকিং পিনাট এবং সিডি (কেস) তৈরিতে ব্যবহার হয়। এদের মধ্যে এলডিপিই এবং পিপি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পলিমার।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ, একটি উদ্বেগজনক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে ২০০২ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে, বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে এ নিষেধাজ্ঞার পরও প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দেশের অধিকাংশ খুচরা বিক্রেতা এখনো প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করছে। পলিথিনের সহজলভ্যতা এবং স্বল্প মূল্যের কারণে এটি এখনো ব্যবহার হচ্ছে। যদিও প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে"সোনালি ব্যাগ" তৈরি হয়েছে, যা একটি পরিবেশবান্ধব জৈব-প্লাস্টিক ব্যাগ; তবে এটি এখন বাণিজ্যিকভাবে প্রচলিত হলেও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্লাস্টিকের বিকল্প প্রচারে সফল হয়েছে ২০১০ সালের জুট প্যাকেজিং আইন প্রণয়ন করে, যার আওতায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য (চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি) অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় আরো ১১টি পণ্য এ উদ্যোগের আওতায় আনা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ৪৩০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হচ্ছে, যার মধ্যে ২৮০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে মিশে যাচ্ছে, যা মারাত্মক দূষণের সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে দৈনিক সংগৃহীত ৬ হাজার ৪৬৪ টন বর্জ্যের মধ্যে ১০ শতাংশ হলো প্লাস্টিক (৬৪৬ টন দৈনিক), যার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ল্যান্ডফিলে পৌঁছায়, ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়, ১২ শতাংশ খাল ও নদীতে চলে যায় এবং ৩ শতাংশ শহর করপোরেশনের নালা ও সেবাবহির্ভূত এলাকায় পৌঁছে। শহুরে বর্জ্য হটস্পট হলো এমন একটি স্থান যেখানে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য জমা হয় এবং তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় মোট ৬৫৫টি হটস্পট রয়েছে, যেখান থেকে ময়লা সংগ্রহ করা হয়। তবে আরো ১ হাজার ৮৩টি স্থান রয়েছে যেগুলো থেকে কোনো ময়লা সংগ্রহ করা হয় না। ঢাকার চারটি প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগের তীরবর্তী এলাকায় এমন ১২৯টি হটস্পট রয়েছে, যেগুলো প্রতিদিন প্রায় ১১৩ টন বর্জ্য পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ হটস্পটগুলো নদী ও তার আশপাশ অঞ্চলের পরিবেশকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। এছাড়া গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিদিন ১-৩ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো বড় শহরগুলো থেকে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক নদী ও খাল হয়ে সমুদ্রে পৌঁছায়। এছাড়া দেশের প্রধান নদীগুলোর তীরে এবং নদীগর্ভে বহু মাইক্রোপ্লাস্টিক জমা হয়েছে, যা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র এবং জলজ প্রাণীর জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণাগুলো এতটাই ক্ষুদ্র যে এটি বাতাসে ভেসে দূরবর্তী এলাকায় চলে যেতে পারে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া আকারে ছোট হওয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের পৃষ্ঠে ধাতু, অ্যান্টি-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ সহজে আটকে যেতে পারে, যা পরিবেশে এ ক্ষুদ্র কণাগুলোর প্রভাবকে আরো মারাত্মক করে তুলছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ তাই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্লাস্টিকে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ, যেমন থ্যালেট, পলিব্রোমিনেটেড ডাইফিনাইল এস্টার ও বিসফেনলে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠছে। এসব রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে প্রজনন, স্নায়ুতন্ত্র, হরমোন ও জেনেটিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। এদিকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণও ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। মিঠাপানির জলাশয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যাপকভাবে উপস্থিত এবং মাছ ও উভচর প্রাণী, যেমন ব্যাঙ, একে খাবারের মতো ভুল করে খেয়ে নিচ্ছে, যা তাদের জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোবায়োজিওকেমিস্ট্রি এবং পলিউশন কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত একটি গবেষণায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির মিঠাপানির মাছের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ মাছের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব রয়েছে, যা খাদ্যশৃঙ্খলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের বায়োঅ্যাকুমুলেশনের লক্ষণ প্রকাশ করে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের সামুদ্রিক লবণে করা আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে একজন ব্যক্তি বছরে ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার সংস্পর্শে আসতে পারে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হতে পারে বলে আমরা মনে করি।
২০২৩ সালে ঢাকা শহরের তিনটি লেকের পানি, মাটি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ নির্ণয়ের জন্য আরেকটি গবেষণা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাটা ও তেলাপিয়া মাছ বিশেষভাবে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো লেকের পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করছে। দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ লোড সূচক অনুযায়ী এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে রয়েছে। এ লেকের বাটা মাছ খাওয়ার মাধ্যমে মানুষও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে এসে যেতে পারে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণায় সাম্প্রতিক সময়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসছে। ২০২৩ সালে একটি গবেষণায় বেঙ্গল ডেল্টার বিভিন্ন আবাসস্থল থেকে নয়টি প্রজাতির মোট ২৭টি ব্যাঙ সংগ্রহ করে তাদের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা গেছে, এ ব্যাঙগুলোর ৯০ শতাংশের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে, যা অন্যান্য আন্তর্জাতিক গবেষণার তুলনায় একটি উদ্বেগজনক সংখ্যা। ২০২৪ সালের আরেকটি গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানিতেও ব্যাপকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়, যা প্রতিনিয়ত সেসব এলাকার মানুষ পান করছে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় পশুর ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর হুমকির ইঙ্গিত দেয়। এসব গবেষণায় বাণিজ্যিক খাদ্য চিনি ও চা ব্যাগের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া ২০২৪ সালে গবেষকরা বাণিজ্যিক খাদ্য আটার মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্বের প্রমাণ পান, যা মানুষের খাদ্যচক্রে এ ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশের একটি উদাহরণ। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে বলা হয় যে একজন ব্যক্তি প্রতি বছর এ নদীর মাছ থেকে প্রায় চার হাজার থেকে ৭ হাজার ৬৬০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বিভিন্ন দেশ মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ রোধে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে নিষেধাজ্ঞা, সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারের উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পণ্য নিষিদ্ধ করেছে, যার আওতায় ২০২১ সাল থেকে প্লাস্টিকের প্লেট, কাঁটা চামচ, স্ট্র এবং কটন বাডের মতো পণ্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। প্রসাধনী ও ব্যক্তিগত যত্নের পণ্য থেকেও মাইক্রোবিড সরানোর নির্দেশনা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাজ্য ২০১৮ সালে প্রসাধনীতে মাইক্রোবিড নিষিদ্ধ করে, ফলে স্ক্রাবিং পণ্য ও টুথপেস্টের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া বন্ধ হয়। কানাডাও ২০১৮ সালে মাইক্রোবিডকে বিষাক্ত হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করে এবং এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাসে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের প্রচলন বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে ‘Microbead-Free Waters Act’ পাস করে এবং ২০১৭ থেকে প্রসাধনীতে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার ব্যবহার বন্ধ করে। অস্ট্রেলিয়া মাইক্রোবিড নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে। জাপানও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ কমাতে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করার পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছে। ভারত একাধিক রাজ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে এবং বেশকিছু শহরে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশও মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিচ্ছে, যেমন ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীন ও আয়ারল্যান্ড প্লাস্টিক ব্যবহারে কর আরোপের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়েছে। ফলে চীনে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সুইডেনে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা এতটাই উন্নত যে দেশটির মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ১ শতাংশেরও কম ল্যান্ডফিলে যায়। এভাবে বিভিন্ন দেশের নেয়া পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং সচেতনতার মাধ্যমে মানুষের অভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ একটি গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা ইকোসিস্টেম, বন্যপ্রাণী ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিমাণ কমাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা সীমাবদ্ধতা তৈরি করা প্রয়োজন, যেমন একবার ব্যবহারযোগ্য স্ট্র, প্লাস্টিকের ব্যাগ ও চামচের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। পাশাপাশি জৈব-বিয়োজ্য বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে। যেমন কাপড়ের ব্যাগ, ধাতব স্ট্র ও কাচের পাত্রের প্রচলন করা। আমাদের দেশের উদ্ভাবন সোনালি ব্যাগের ব্যবহারকেও বৃদ্ধিকরণ জরুরি। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের হার বাড়ানোর জন্য পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জনসচেতনতার প্রচারণা চালানো প্রয়োজন, যাতে মানুষ সঠিক পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া ও প্লাস্টিকের অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হয়। এছাড়া প্লাস্টিকের পরিবর্তে নতুন ধরনের উপকরণ উদ্ভাবনের জন্য গবেষণায় বিনিয়োগ করা উচিত, যেমন জৈব-বিয়োজ্য পলিমারের ব্যবহার। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির ট্রিটমেন্ট প্লান্টে মাইক্রোপ্লাস্টিক ফিলট্রেশন প্রযুক্তি, যেমন ন্যানো ফিলট্রেশন বা রিভার্স অসমোসিস প্রযুক্তির প্রয়োগে প্রায় ৯৯ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারণ করা সম্ভব। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে বর্জ্য পরিবেশে প্রবেশ করতে না পারে এবং কম্পোস্টিং ও জৈব বর্জ্য কর্মসূচির মাধ্যমে মোট বর্জ্য কমানো যায়। প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারে কঠোর নিয়মকানুন প্রয়োগের পাশাপাশি টেকসই প্রক্রিয়া গ্রহণকারী ব্যবসাগুলোর জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সম্প্রদায়ের পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও শিক্ষামূলক কর্মশালা চালু করতে হবে এবং বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে পরিবেশ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে আগামী প্রজন্মকে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলা এবং ব্যবসা, এনজিও ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে একত্র করে এ সমস্যা মোকাবেলায় যৌথ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কারণ সমুদ্রের স্রোত মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে দিতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের এ মারাত্মক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বর্তমান প্রচেষ্টাগুলো এখনো সীমিত। প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার না হওয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য সাধারণত নদীর তীর বা রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়। সামগ্রিকভাবে প্লাস্টিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাবের ওপর আরো গবেষণা এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রয়োজন, যাতে এ দূষণ কমানো যায় এবং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এ ধারণাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের প্রভাব কমাতে পারি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে পারি। ব্যক্তিগত সম্প্রদায়, সরকার ও সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ফেলো রয়্যাল কেমিক্যাল সোসাইটি ও চার্টার্ড পরিবেশবিদ, যুক্তরাজ্য