কেমন হল এবারের মুদ্রানীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ হচ্ছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। আগে বছরে দুবার ঘটা করে মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বছরে একটি মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হচ্ছে। মুদ্রানীতির মূল কাজ হচ্ছে অর্থ প্রবাহ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এবারের মুদ্রানীতিতে বিশেষ কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। এটি গতবারের ধারাবাহিকতাকেই তুলে ধরেছে। তারই কিছুটা নিম্নে তুলে ধরার চেস্টা করেছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ হচ্ছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। আগে বছরে দুবার ঘটা করে মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বছরে একটি মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হচ্ছে। মুদ্রানীতির মূল কাজ হচ্ছে অর্থ প্রবাহ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এবারের মুদ্রানীতিতে বিশেষ কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। এটি গতবারের ধারাবাহিকতাকেই তুলে ধরেছে। তারই কিছুটা নিম্নে তুলে ধরার চেস্টা করেছি।     

গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে জুন  পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এবারের মুদ্রানীতিতেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। নতুন বিনিয়োগ কম হওয়ায় আগামীতেও ঋণপ্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়বে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। গত অর্থবছরের জন্য সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলেও সঞ্চয়পত্র থেকে প্রচুর ঋণ পাওয়ায় সরকার ব্যাংক থেকে নিয়েছে অনেক কম। 

এবারে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগের বছরের প্রকৃত অর্জন দেখে বুঝা যায় এবারে কিভাবে অর্জিত হবে, তা ভাবার বিষয়। প্রতি বারের মত এবারও উৎপাদনশীল খাতে ঋণের জোগান বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তা এবং স্ব-কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ৫০০ কোটি টাকার এবং তফসিলি ব্যাংকসমূহের পরিচালন মুনাফার ১ শতাংশ নিয়ে স্টার্ট আপ ফান্ড গঠন, সিএসএমই খাতের পুনঃ অর্থায়ন সুবিধা যথাযত বাস্তবায়নের নিমিত্তে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কীম চালু করা হয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও চলমান করোনা মহামারীতে নতুন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

মানুষ জীবন নিয়ে একদিকে যেমন আতঙ্কিত তেমনি জীবিকা নিশ্চিত করতে না পেরে চরম হতাশায় বিমজ্জিত। এই অবস্থায় দেশে কি ভাবে ঋণ বাড়ানো যাবে তার কোন দিক নির্দেশনা এখানে পাওয়া যায় না। একদিকে সবকিছু বন্ধ রেখে অন্যদিকে ঋণ বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এখানে স্পষ্টত বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হয়। কার্যত করোনা মহামারীর কাছে মানুষ অনেক অসহায়। অনেক চেস্টা করেও মহামারী ঠেকানো যাচ্ছে না। এতদিন আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণা ছিল গ্রামের মানুষের করোনা হয়না বা হবে না কিন্তু এখন চিত্র একেবারেই উল্টো। গ্রামের মানুষই বেশী আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। এর কারণ অবশ্য টিকা। এখন অর্থনীতি সচল করার প্রধান উপায় হল টিকা নিশ্চিত করা। সরকার দেরী হলেও এই পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে, এই তারল্য ব্যবহারের কোন সুবিধা আমরা মুদ্রানীতিতে দেখতে পাইনা। বরং বলতে শুনেছি ঋণের ব্যবহার যদি সঠিক না হয় তবে বাজার থেকে যে কোন সময় টাকা তুলে নেয়া হবে। টাকা তুলে নেয়া অনেক সহজ কিন্তু টাকার ব্যবহার করানোটা কঠিন। টাকা কিভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তার উপায় খোঁজা জরুরী। অনেক বড় বড় অর্থনীতিবিদগণ বলে আসছেন মানুষের হাতে নগদ টাকা দিন। এর ফল ভাল হবে। কাজ হারানো মানুষের হাতে টাকা দিলে টাকার বুদবুদ সৃষ্টি হবে না । তা প্রকৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হবে। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হবে। শেয়ার বাজার বা ফ্ল্যাট কেনায় এই টাকা যাওয়ার কোন সুযোগ নাই।

সরকার অবশ্য কিছুটা হলেও মানুষের হাতে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করছে । যেমন ফিরে আসা ২ লক্ষ প্রবাসীদের ১৩ হাজার করে মাসিক টাকা দেয়া হবে। ফিরে এসেছে ৪ লক্ষ প্রণোদনা পাবেন ২ লক্ষ। এটা যাতে সঠিক লোকের হাতে যায় এটা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় টাকা পাওয়া উপকার ভোগীর সংখ্যা বাড়নো উচিত। কারণ নতুন করে অনেক লোক হত দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তাঁদের জন্য রাষ্ট্রের বিশেষ কিছু করা প্রয়োজন। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে এখন ভাবার খুব একটা দরকার দেখি না। কারণ মুদ্রাস্ফীতি জুন ২০২১ শেষে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ছিল যা আগের বছরে ছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন নেই।

তবে সতর্ক থাকা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া বক্তব্যে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় ঘুরে দাঁড়ায়নি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও মানসম্মত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করতে সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। দেখা যাক এই মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থনীতিকে কতখানি সম্প্রসারণ করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধকল্পে বিএফআইইউ কর্তৃক আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই ক্ষেত্রে আরও দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড দেখতে চায়। পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা এবং পাচারকারীর নাম জনসম্মুখে আনা হোক। তবেই বুঝা যাবে আসলেই আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।   

আনোয়ার ফারুক তালুকদার

ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক 

আরও