বাজার ব্যবস্থাপনা

বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবি কতটুকু কার্যকর?

আমি ১৯৯২ সালে এএনজেড গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের পাবলিক সেক্টর হেড হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশেরও (টিসিবি) রিলেশনশিপ ম্যানেজার ছিলাম। এমনকি ক্রান্তিকালে টিসিবির

আমি ১৯৯২ সালে এএনজেড গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের পাবলিক সেক্টর হেড হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশেরও (টিসিবি) রিলেশনশিপ ম্যানেজার ছিলাম। এমনকি ক্রান্তিকালে টিসিবির বৃহৎ আমদানি ঋণপত্র খুলে ও অর্থায়ন করে পুরস্কৃতও হয়েছিলাম। তাই অপরাপর রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো টিসিবি নিয়েও আমার সম্যক ধারণা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসনের একজন ছাত্র ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে অনেক দিন কর্মরত থাকার সুবাদে এটাও জানি যে ব্যক্তি খাতচালিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুব একটা কাজ করে না, বরং রাষ্ট্রীয় কোষাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অনেকেই জানবেন, স্বাধীনতার পর গড়ে তোলা হয়েছিল টিসিবি। উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রি। সময়ের পরিক্রমায় সংস্থাটির বিপণন কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানতে পেরেছি, বর্তমানে শুধু ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমেই সরাসরি উপকারভোগী হিসেবে সংস্থাটির তালিকাভুক্ত রয়েছে এক কোটি পরিবার। মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে কার্ডধারীদের বাইরেও পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে টিসিবিকে। তবে সেবার পরিধি বাড়লেও সংস্থাটির সক্ষমতা সেভাবে বাড়ানো হয়নি। এ সুযোগে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের প্রভাব বেড়েছে বাজারে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

দেশে দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না টিসিবি। এমনকি রমজানে বাড়ে এমন পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতেও তারা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। পত্রিকান্তরে উঠে এসেছে—সংস্থাটির জনবল ও গুদাম সংকট, দুর্নীতি, মূলধনের অভাবসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে টিসিবিকে শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। তাছাড়া জনবলের অভাবে টিসিবির যে আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে, তাও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কারো অজানা নয় যে সংস্থাটির ভৌত অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাসহ বেশকিছু অসুবিধার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজারে তারা প্রতিযোগিতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে বৃহৎ ব্যক্তি খাতের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় টিসিবির সক্ষমতাও কম।

স্বাভাবিকভাবেই নব্বইয়ের দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর বেসরকারি খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে টিসিবির কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভবও নয়। এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকারের ভূমিকা রাখা উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোট চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে কিছু অসাধু চক্র অযৌক্তিকভাবে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি বা দাম বাড়াতে না পারে, তা দেখাও সরকারের দায়িত্ব। অনেকের মতে, টিসিবি হলো সরকারের সেই ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা যায়। দুই বছরের অধিক সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু টিসিবির পণ্যের ধরন, পরিমাণ ও বিপণনের আওতা সেভাবে বাড়েনি, বাড়ানো সম্ভবও হয়নি।

সরকারের অনেকেই বলছেন, দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকায় এ মুহূর্তে টিসিবির সক্ষমতা ও কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা দেশের স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবিকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা প্রয়োজন।

তবে টিসিবিতে সমস্যারও অন্ত নেই। এত সমস্যা নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করা এবং তা থেকে জনগণের সুফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ পরিস্থিতিতে টিসিবির মজুদ সক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসহ পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে অনেকেই বলছেন। অনেকেই ভারত কিংবা পাকিস্তানের স্টেট ট্রেডিং করপোরেশনের উদাহরণ টানছেন।

তবে ব্যক্তি উদ্যোগের এ যুগে দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের বিপরীতে টিসিবির মতো ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাজারে হস্তক্ষেপও কঠিন হয়ে পড়েছে। একটি বৃহৎ ও নিত্য পরিবর্তনশীল ভোগ্যপণ্যের বাজারে সামান্য আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রয় ক্ষমতার সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে আমাদের মতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটা কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাটা অনেক দুরূহ।

প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি সংস্থাটির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগও কম নয়। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সংস্থাটির বিরুদ্ধে ২৯৭ কোটি ৬ লাখ টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণের তথ্য পাওয়া গেছে। আবার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে সংস্থাটির কেনাকাটায়ও প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। পর্যাপ্ত নগদ তহবিল না থাকায় সংস্থাটিকে কেনাকাটা চালাতে হয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। এ ঋণের সুদহার পরিশোধ করতে গিয়ে টিসিবির পণ্যের দামও কিছুটা বেড়ে যায়। অনেক সময় রাষ্ট্রকেও বাধ্যতামূলক ভর্তুকির পথে হাঁটতে হয়।

বেশ অনেকদিন ধরেই আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ফলে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। অনেকেই ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে কম দামে পণ্য পেতে ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। ডিলাররা ট্রাক আনার আগে পণ্য পেতে দীর্ঘ লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকেন ভোক্তারা। ট্রাকভর্তি পণ্য এলে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। সরবরাহ কম থাকায় সবার চেষ্টা থাকে কে কার আগে পাবেন। শুধু টিসিবি ট্রাকেরই নয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকেরও একই অবস্থা। তারা রাজধানীতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, পেঁপে, লাউ, কাঁচামরিচ বেশকিছু এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রি করছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাজারে বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করায় দাম কমাতে এ উদ্যোগ নিয়েছে আগের সরকার। বর্তমান সরকারও এটা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সেখানে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম। ভোক্তাদের অভিযোগ, অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর যা পাওয়া যায় তা সামান্যই। আবার অনেকেই পণ্য না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরছেন। এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় একই পরিবারের সদস্য একাধিকবারও নিচ্ছেন। ফলে ট্রাকের সামনে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে ট্রাক থেকে বিক্রয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেটাকে সুদূরপ্রসারী করতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে নির্ধারিত পণ্য সঠিকভাবে পেতে পারে সেজন্য চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বাড়াতে হবে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ অতি কষ্টে আছে। এ অবস্থায় অনেকেরই মতে ট্রাক থেকে বিক্রি কার্যক্রমের আওতা আরো বাড়ানো জরুরি। সরকারকে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ট্রাক থেকে বিক্রি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

টিসিবিকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে জনবল বাড়ানো, নতুন গুদাম তৈরি ও কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণের পাশাপাশি নগদ তহবিল বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আপৎকালীন খাদ্য সংকটে সংস্থাটির কেনা পণ্যের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ ও বিপণনক্ষমতা বাড়ানো দরকার। টিসিবির যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা দূর করার পাশাপাশি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও আবশ্যক।

তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে টিসিবি কতটুকু কামিয়াব হবে এটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন রয়েছে। এ যেন ‘সিন্ধুতে বিন্দুর ফোঁটা’। তবে ব্যাপক দারিদ্র্য আর আয়বৈষম্যের এ দেশে টিসিবির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। ধীরে ধীরে একটি দায়িত্বশীল ব্যক্তি খাত গড়ে উঠলে এবং সেই সঙ্গে দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীকে আরো আধুনিক ও নির্ভরশীল করা গেলে আমাদের হয়তো বৃহৎ ও বর্ধিঞ্চু ব্যক্তি খাতের সঙ্গে অনেকটা প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ আর বেশ অদক্ষ এই টিসিবির প্রয়োজন হবে না। এ কাজ যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব ততই রাষ্ট্রীয় স্থিতিপত্রের জন্য মঙ্গলকর।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

আরও