ভূরাজনীতি

গাজা কি পশ্চিমা একাডেমিয়ার দেউলিয়াত্ব তুলে ধরছে

ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন মাহমুদ আলনাউক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে মাস্টার্স করার কথা ছিল তার। কিন্তু নিয়তিতে ছিল অন্য কিছু। ২৫ বছর বয়সী এ ফিলিস্তিনি তরুণ সপরিবারে ইসরায়েলি হামলায় মারা যান ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর। তার স্মরণে গত মাসে মেলবোর্নের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এক ভবনের নাম রাখে মাহমুদ’স হল। প্রতিষ্ঠানে

ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন মাহমুদ আলনাউক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে মাস্টার্স করার কথা ছিল তার। কিন্তু নিয়তিতে ছিল অন্য কিছু। ২৫ বছর বয়সী এ ফিলিস্তিনি তরুণ সপরিবারে ইসরায়েলি হামলায় মারা যান ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর। তার স্মরণে গত মাসে মেলবোর্নের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এক ভবনের নাম রাখে মাহমুদ’স হল। প্রতিষ্ঠানে এভাবে নামকরণের দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন সারা আহমেদ তার ‘অন বিয়িং ইনক্লুডেড: রেসিজম অ্যান্ড ডাইভারসিটি ইন ইনস্টিটিউশনাল লাইফ’ বইয়ে। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। তার মৃত্যুতে শুধু মেলবোর্ন নয়, অস্ট্রেলিয়ার কোনো ইউনিভার্সিটিই টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। উচ্চবাচ্য হয়নি পশ্চিমা একাডেমিয়ায়। 

পশ্চিমা একাডেমিয়া গবেষণা, লেখালেখি, সেমিনার ও চিন্তার চর্চাকে কদর করে। দার্শনিক তর্ক চলে গণহত্যা, সেটলার কলোনিয়ালিজম, ডিকলোনাইজেশন, সামাজিক আন্দোলন, গণহত্যা, সাব-অল্টার্নের মতো ভারী ভারী শব্দের ভাণ্ডার নিয়ে। কিন্তু সে তত্ত্ব ও দার্শনিকতার জোয়ারে হারিয়ে যায় গণহত্যা বন্ধের প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপের আলাপ। তাদের পাঠে যেন গণহত্যা কোনো অতীতের বিষয়। ইতিহাসের গলিঘুপচি খুঁজে দূর থেকে আবিষ্কারের প্রসঙ্গ। যেন বর্তমানে খুঁজে পাওয়ার দরকার নেই। অন্তত গাজা প্রসঙ্গে এসে সেটাই প্রমাণ হয়। একাডেমিয়ায় গণহত্যা পাঠের জন্য আলাদা করে বিনিয়োগ ও চুক্তি হয় গবেষক ও ছাত্রদের সঙ্গে। তাদেরকেই সংজ্ঞায়ন করতে হয় সেসব বিষয়। অথচ মাহমুদের মতো হাজারো ছাত্র যখন গণহত্যার শিকার, তখন তা হচ্ছে নিহতের পরিসংখ্যানে নতুন সংখ্যার সংযোজন মাত্র। মাহমুদের মৃত্যু তো বাস্তব ও বর্তমান। গাজা তো বইয়ের পাতার বিষয় নয়; সম্মুখের ঘটনা। অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া রায়, জাতিসংঘের বক্তব্য ও ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর কার্যক্রম খুবই স্পষ্ট। গাজায় হত্যাকাণ্ডের প্রতি এমন উপেক্ষা পশ্চিমা মোড়লদের মতোই পশ্চিমা একাডেমিয়ার দীনতাকেও কি তুলে ধরছে না। 

গাজার পরিস্থিতি পাঠে গবেষণার বিষয় হতে পারে মাহমুদের মৃত্যু। তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট ঘুরে এলেই স্পষ্ট হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে তার কোনো দ্বিধা ছিল না। ইসরায়েল ঠিক কীভাবে হত্যার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। কীভাবে দিনের পর দিন সে আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। যেন দিনগুলো নিয়ে পুরো একটা বই লেখা এর মধ্যেই হয়ে গেছে। হলোকাস্টের সময় নিয়ে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি ছিল যেমনটা। মাহমুদের টাইমলাইনে দেখা যায়, মে মাসে তিনি ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে টুইট করেছেন। শেয়ার করেছেন এ-বিষয়ক আর্টিকেল। তুলে ধরেছেন গাজার হাসপাতালের বিদ্যমান অবস্থা। কীভাবে ক্যান্সারের রোগীরা জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দিন দিন, সেটাও। এ রকম একজন ভুক্তভোগী মূলত মাহমুদের মা। তার মায়ের ক্যামোথেরাপি দেয়ার প্রয়োজন ছিল। তার জন্য যেতে হতো পশ্চিম তীর। কিন্তু দফায় দফায় নেয়ার চেষ্টা চালালেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। পরিণামে ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন গাজাতেই। এভাবে কেবল ইসরায়েলের সশস্ত্র আক্রমণ নয়, তাদের দ্বারা সংঘটিত ধীর গণহত্যার জ্বলন্ত দলিল গাজার এমন মৃত্যুগুলো। সে গণহত্যা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে, চলাফেরার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে। নারী ও শিশুরা বিমান হামলায় নিহত হচ্ছে, সাংবাদিকরা জেলে ঢুকছেন, প্রাণ দিচ্ছেন ডাক্তার ও শিক্ষকরা। নিকট ইতিহাসে নির্মমতার এমন নজির আর কোথায়? তার পরও পশ্চিমা একাডেমিয়ায় তা উপেক্ষিত রয়েছে। পশ্চিমা ইউনিভার্সিটিগুলো গাজা ইস্যুতে বৈশ্বিক ছাত্রদের হতাশ করেছে। তারা ডিকলোনাইজেশন, জেনোসাইড ও সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ নিয়ে মুখে ফেনা তুললেও গাজা প্রসঙ্গে এসে রা নেই। তার ওপর ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলা ছাত্রদের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবাদী ছাত্রদের মুখ বন্ধ করে রাখতে চায়। এটা তাদের জ্ঞানচর্চার নৈতিক দীনতাকেই তুলে ধরে। সেখানে ছাত্ররা সেটাই করছে, যা তাদের প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধান করতে ব্যর্থ। উদাহরণস্বরূপ, মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকেনি। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত বসে থাকতে চায়নি। তারা মাহমুদকে স্মরণীয় করে তুলে আনতে চেয়েছেন তার নামে হলের নামকরণ করে। 

মাহমুদের সর্বশেষ টুইট ছিল ১৬ অক্টোবর। তার চারদিন পর ইসরায়েলি বাহিনী তাকে হত্যা করে। শেষ টুইটগুলোর একটা ছিল, ‘এ পাগলামি শেষ হোক।’ ৭ অক্টোবরের পর থেকে মাহমুদ গাজা আন্ডার অ্যাটাক হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছেন। ১৩ তারিখে তিনি টুইট করেছেন জেনোসাইড লিখে। পরের দিন লিখেছেন, ‘গাজায় জেনোসাইড আর পৃথিবী আমোদে মগ্ন!!’ একই দিনে তিনি ফিলিস্তিনি শিশুদের ছবি শেয়ার করেছেন, যাদের হাতের তালুতে নাম লিখে রাখা। নামটা এজন্য লেখা হয়েছে যেন ইসরায়েলি বিমান হামলায় মৃত্যুর পর তাদের শরীর শনাক্ত করতে অসুবিধা না হয়। এভাবে পেছনে যেতে থাকলে উঠে আসে গাজার দিনগুলো। মাহমুদ এখন কবরে। আন্তর্জাতিক আদালত হয়তো কিছু একটা করতে চেয়েছে; কিন্তু তাদের দৌড় কতটুকু তা এরই মধ্যে বোঝা হয়ে গেছে। মাহমুদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা বুঝতে আন্তর্জাতিক আদালতের দরকার নেই। দরকার নেই ভারী পুস্তকের। কেবল দরকার মানবিক মর্যাদার বোধটুকু। ইসরায়েলের হামলা শুরুর এক সপ্তাহ না যেতেই মাহমুদ বুঝতে পারলেন একটা গণহত্যা ঘটে চলছে। হ্যাশট্যাগ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। অথচ পশ্চিমা একাডেমিয়ায় তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই সে অর্থে। 

‘ইনসাইড হায়ার এডুকেশন’-এ সম্প্রতি একটি মতামত প্রকাশিত হয় গবেষক মোতি মিজরাহির। তিনি দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফিলিস্তিনপন্থী স্লোগান উচ্চ শিক্ষার ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। ছাত্ররা ঐতিহাসিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট বুঝতে পারছে না, সহনীয়তা শিখতে পারছে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা সত্য, পশ্চিমা উচ্চ শিক্ষা বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যর্থ। তবে লক্ষণ এটা নয় যে, তারা ফিলিস্তিনপন্থী স্লোগান দিচ্ছে। ইসরায়েল গাজার শেষ বিশ্ববিদ্যালয়টিকেও যখন সেনাছাউনি বানাল, সেখানকার জাতীয় জাদুঘরের তিন হাজারের বেশি সামগ্রী ধ্বংস করল, সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করল; তা পশ্চিমা একাডেমিয়ায় কোনো সংকেত দেয় না। ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার ছুঁতে যাচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেখানকার স্কুল, লাইব্রেরি, জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মসজিদ, চার্চ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। তা নিয়ে যে আলোচনা নেই, পশ্চিমা একাডেমিয়ার অধঃগতির লক্ষণ সেখানে। অথচ যখন রাশিয়া অভিযান চালাল, তখন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তার মানে কি গাজার মানুষের কণ্ঠস্বর নেই? ফিলিস্তিনিরা কি বলতে পারে না? প্রশ্নটা অবশ্য বড় পরিসরে আগেই করেছিলেন দার্শনিক হামিদ দাবাশি তার ‘ক্যান নন-ইউরোপিয়ান থিংক’ গ্রন্থে। 

পশ্চিমা দেশগুলোয় একাডেমিয়ার অবস্থান তাদের নৈতিক স্খলনকে তুলে ধরে। ফিলিস্তিনি আন্দোলনে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’ স্লোগান একটা রেটোরিকে পরিণত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। স্লোগানটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদের পোয়েটিক প্রকাশ। তবু অ্যান্টি-সেমেটিক তকমা পেয়েছে। অথচ ইসরায়েল সরাসরি ম্যাপ দেখিয়ে ঘোষণা দিয়েছে তারা তাদের আধিপত্য আক্ষরিক অর্থে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’ বিস্তৃত করবে। তার জন্য উচ্ছেদ হবে ফিলিস্তিনিরা। সেখানে গাজাও নিরাপদ নয়, পশ্চিম তীর নয়। একাডেমিয়ায় কিন্তু সে বিষয়ক কোনো বার্তা নেই। এভাবে ভাষাও পরিণত হচ্ছে অস্ত্রে। যেন ফিলিস্তিনের কথা বলার স্বাধীনতাই অ্যান্টিসেমেটিক। ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে চাওয়ার মানেই বাকহীন থাকতে হবে। বাতিল হবে শিল্পীদের প্রোগ্রাম, বাধা দেয়া হবে লেখকদের। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে সম্প্রতি ফিলিস্তিনি আর্টিস্ট সামিয়া হালাবির চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন বাতিল করা। তাদের অজুহাত বিশৃঙ্খলার ভয়। অথচ একাডেমিক স্বাধীনতা হলো, কোনো নির্দিষ্ট সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্নকে হাজির করতে পারা। 

মৃত্যুর সংখ্যা গণনা নিজেই মৃতের জন্য অপমানজনক। প্রতিটি মৃত্যুই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যখন কেউ মৃত্যুবরণ করে সংখ্যায় পরিণত হন, সে তালিকার মধ্যে একটা ছদ্ম ডিহিউম্যানাইজিং ব্যাপার থাকে। বর্তমান যুদ্ধে ইসরায়েলের ভাষ্য বেশ পরিষ্কার। হামাস নির্মূল হবে তখনই, যখন গাজা নিশ্চিহ্ন হবে। গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারে পৌঁছেছে। তাদের বড় অংশ নারী ও শিশু। পশ্চিমা একাডেমিয়া যখন ভ্রুক্ষেপহীন, সে সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের এক তরুণ শ্বেতাঙ্গদের চিৎকার করে শোনাচ্ছেন বাস্তবতা। তিনি বলে দিচ্ছেন কী ঘটছে আসলে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন গণহত্যা, সেটলার কলোনিয়ালিজম ও স্বাধীনতা হরণের সংজ্ঞা। ‘জেনোসাইড’ স্ট্যাটাস দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান মাহমুদ। মৃত্যুর আগে তিনি কোন পাগলামির কথা বলতে চাচ্ছেন? এটা কি সেই পাগলামি না, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র পয়সা ঢালে? পশ্চিমা শক্তির ওপর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইসরায়েল প্রতিটি দিন একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে যাচ্ছে। দখলদার বাহিনীর অত্যাচার, তৈরি করা অনিরাপত্তা, এটা পাগলামি ছাড়া আর কি! তারা আক্রমণকে নয়, আঘাতগ্রস্তের চিৎকারকে ভর্ৎসনা করে। এ সময়ে একাডেমিয়ায় বহু প্রশ্ন থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেখানে এখন লজ্জাজনক নীরবতা। গাজায় যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে পশ্চিমা একাডেমিয়ার অহম।

আহমেদ দীন রুমি: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

আরও