গভীরে দৃষ্টি

খাদ্যনিরাপত্তার রাজনৈতিক অর্থনীতি

খাদ্যনিরাপত্তা একটি বৃহৎ বিষয়। শুধু উৎপাদন বাড়ালেই খাদ্যনিরাপত্তা অর্জিত হবে, বিষয়টি তা নয়। এর সঙ্গে খাদ্যের বণ্টন, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় জড়িত। খাদ্যনিরাপত্তার আলোচনায় প্রথমেই দেখতে হবে আমাদের খাদ্যদ্রব্য কী এবং সেটার পরিসরের ভেতরে কী কী প্রয়োজনীয় পণ্য থাকা দরকার। সাধারণত আমাদের কার্বোহাইড্রেডের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রধান খাদ্য হলো চাল আর প্রোটিনের

খাদ্যনিরাপত্তা একটি বৃহৎ বিষয়। শুধু উৎপাদন বাড়ালেই খাদ্যনিরাপত্তা অর্জিত হবে, বিষয়টি তা নয়। এর সঙ্গে খাদ্যের বণ্টন, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় জড়িত। খাদ্যনিরাপত্তার আলোচনায় প্রথমেই দেখতে হবে আমাদের খাদ্যদ্রব্য কী এবং সেটার পরিসরের ভেতরে কী কী প্রয়োজনীয় পণ্য থাকা দরকার। সাধারণত আমাদের কার্বোহাইড্রেডের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রধান খাদ্য হলো চাল আর প্রোটিনের জন্য প্রধান খাদ্য হলো ডাল। এ দুটি আমরা জানি। আমাদের ডাল আমদানি করতে হয়। কারণ আমাদের ডালের উৎপাদন কম। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের কারণে আমাদের চাল উৎপাদন মোটামুটি হয় এবং সরকার দাবি করে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার পরও প্রতি বছর ২০-৩০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। লিন সিজনে খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারকে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হয়। আর একটু বাড়তি সরবরাহ না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সুতরাং আমদানি করার অর্থ এটা নয় যে আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছি না, আমদানি করা হচ্ছে বাজারটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। খাদ্যের দাম রাজনৈতিকভাবে খুব নাজুক। খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। তাই সরকার এর দিকে খেয়াল রাখে। একমাত্র চালের ক্ষেত্রে একটা (পিএফডিএস) পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম আছে। তার মানে অন্তত চাল ও ডাল সব মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে না পারলে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ, যেখানে খাদ্যের মৌলিক অধিকার, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে—এসব কথা কেবল কথার কথাই হয়ে থাকবে। 

চাল ও ডালের দাম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়? চাল-ডাল ছাড়াও তো অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য আছে যেমন শাকসবজি, মাছ-মাংস, ভোজ্যতেল, দুধ ও দুধজাতীয় পণ্য ইত্যাদি। এসব খাদ্যদ্রব্যের দামও কী রকম হওয়া উচিত এবং এগুলোর সরবরাহ ও আমদানি কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত? এ পটভূমিতে আমরা যদি পুরো খাদ্য পরিসরকে নিয়ে আলোচনা করি তাহলে এর মধ্যে দুটি উৎসের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে। একটি হচ্ছে সরকারি খাত এবং অন্যটি বেসরকারি খাত। একটি পরিচালিত হয় সামাজিক কল্যাণ দিয়ে, অন্যটি মুনাফা দিয়ে। 

চাল বা ধান আমাদের দেশে মূলত কৃষকরা উৎপাদন করে থাকেন। ধান থেকে চালে রূপান্তর করে থাকেন চালকলের মালিকরা এবং সেই চালকলের মালিকদের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট দাম দিয়ে সরকার চাল কিনে থাকে। তারপর সরকার সেই চালটা পিএফডিএসের আওতায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য, লিন সিজনে বাড়তি চাল সরবরাহ করা, বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্বল গোষ্ঠীদের খাদ্য দেয়া ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করে থাকে। এই সিস্টেমের মধ্যে কতগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। 

প্রথমটি হলো, চাল ব্যবসায়ীরা যখন পিক সিজনে ধানের দাম কম থাকে তখন কিনতে চান। আর সরকার যদি সংগ্রহ করা শুরু না করে অর্থাৎ সরকার যদি সময়মতো হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তাহলে চাল ও ধানের বাজারটা পরিচালনা করবেন ফড়িয়া, ব্যবসায়ী, চালকল মালিকরা। কৃষকরা তখন ন্যায্য দাম পান না। আর সরকার যদি ঠিকমতো হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হয় তাহলে কৃষকরা ফড়িয়া, চালকল মালিকদের কাছে না গিয়ে সরকারের প্রতিনিধির কাছে যাবেন। তবে এখানে দুটি সমস্যা রয়েছে একটি হলো সরকার। এর জন্য ব্যাপক পুঁজি নিয়ে, গুদাম নিয়ে, ধানের আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নিয়ে প্রস্তুত নয়। দ্বিতীয়ত, ধান ভেজা কিনা এ নিয়ে সেসব সংগ্রহশালায় লাগাতার একটা দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। এটি প্রযুক্তিগতভাবে সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেয়নি সরকার। অর্থাৎ ধানের মান অনুযায়ী সংগ্রহমূল্যের পরিষ্কার কোনো ব্যবস্থাপত্র এখনো তৈরি করা হয়নি। এসব নিয়ে প্রকিউরমেন্ট সেন্টারের প্রায় সময় কৃষকের সঙ্গে দামাদামি করা হয়। আর তাতেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে কৃষকরা বিক্রয় কেন্দ্রে দাম বেশি থাকলেও চালকল মালিকের কাছে ধান বিক্রি করে থাকেন। চূড়ান্তভাবে আসলে কৃষক উপকৃত হন না। এটার একটি সমাধান হচ্ছে কৃষকের ধান সংরক্ষণের সক্ষমতা তৈরি করা। সেটা কৃষক মার্কেটিং কো-অপারেটিভ তৈরির মাধ্যমে হতে পারে। এটা ছাড়া যারা একটু সম্পদশালী কৃষক এবং যাদের সংরক্ষণের সক্ষমতা আছে তারাও ধানের মজুদ গড়ে তুলতে পারেন। ধান বিক্রির সময় সরকারি সংগ্রহের দাম বলার পাশাপাশি ফড়িয়ার দাম, চালকল মালিকের দাম এবং খুচরা ধান থেকে চালে রূপান্তর করার খরচ মিলে কী দাম হওয়া উচিত—এসব তথ্য যদি তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে জানানো যায় তাহলে কৃষকরা ও ভোক্তারা উভয়ই উপকৃত হন। এখানে তথ্যটা বড় গুরুত্বপূর্ণ। এ তথ্যটাই পৌঁছে দিতে হবে সরকারকে—সেখানেও একটি ঘাটতি আছে। তথ্য সরবরাহের ঘাটতি থাকায় কৃষক ঠিকমতো বাজার সম্পর্কে বুঝতে পারেন না। চালের ব্যাপারে সরকারের তবু কিছু মাধ্যম রয়েছে, কিন্তু ভালো করে চিন্তা করে দেখুন, আলুর ক্ষেত্রে কোনো সরকারি সুবিধাই নেই। আলু কিনে ফড়িয়ারা। তার থেকে কেনে শহরের বিক্রেতারা। সুতরাং ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী সমস্যা কাঠামোগতভাবে অনিবার্য। শাকসবজি, টমেটো, আলু-সরিষার বেলায় সরকারের একটা তথ্যগত সেবা দেয়া উচিত। দেশব্যাপী কৃষকের নিজস্ব বাজার তৈরি করা উচিত, যেমনটা বিভিন্ন দেশে আছে। এমন বাজারে কৃষক অল্প পরিমাণে পণ্য আনলেও দাম নিয়ন্ত্রিত থাকে আর আগের থেকে দাম ঘোষণা করাই থাকে। আর কৃষকের বাজারটা উল্লম্বভাবে একীভূত করে শহরের সরবরাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া গেলে সুফল মিলবে। এমন উদাহরণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে আছে। একটি লোক কৃষকের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বাজারের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রোগ্রামের সফটওয়্যারসহ একটি কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে। প্রত্যেক রাতে সেখানে কৃষক যান এবং কৃষক যে পণ্যগুলো বিক্রি করতে চান শহরে তার দামটা কত তা কম্পিউটার দেখে কৃষককে জানিয়ে দেয়া হয়। এতে করে কৃষক সম্ভাব্য দাম জানতে পারেন। ফলে তার মধ্যে দামাদামি করার ক্ষমতা তৈরি হয়। তখন কো-অপারেটিভ না করলেও শুধু এ তথ্য পাওয়ার কারণে কৃষক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। কৃষককে শক্তিশালী করার জন্য তাকে সংরক্ষণ সুবিধা দেয়া ও তাকে মধ্যস্বত্বভোগী এড়িয়ে সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেয়াটা আবার সরকার কোন শ্রেণীর জন্য কাজ করবে তার ওপর নির্ভর করে। যদি গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থকে সরকার নিজের ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে বেছে নেয় তাহলে এক্ষেত্রে সরকারের কোনো সদিচ্ছা না থাকারই কথা।

এটা হলো একটা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সুপার প্রফিট বা অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে আনা যায়। আরো একটা পদ্ধতি হলো কৃষক কার্ড করে স্বল্পমূল্যে সার, বীজ, সেচের পানি সরবরাহ করা। কিন্তু এগুলো সবই অ্যাডহক। বর্তমানে যাদের জমি আছে তারা নিজে কৃষিকাজ না করে বর্গা দিয়ে জমি চাষ করেন। অথবা শ্রমজীবীদের দিয়ে দেয়। তারা একটি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করেন। সরকার ল্যান্ড ব্যাংক তৈরি করে জমির মালিকদের সঙ্গে একটা চুক্তি করতে পারে। যেখানে যারা জমি নিজেরা চাষ করছে না তারা সেই জমি সরকারের ল্যান্ড ব্যাংকের কাছে জমা দিতে পারে। সরকার জমির ন্যায্য ভাড়া নিয়ে পরে তা বণ্টন করে দেবে। সরকার এ জমি অধিক উৎপাদনের জন্য চাষাবাদ করতে পারে। সর্বোচ্চ জনকল্যাণের জন্য নানাভাবে তা ব্যবহার করতে পারে। এটাও অবশ্য সরকারের শ্রেণীচরিত্র ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

এখন জমি নিয়ে যাচ্ছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। ক্যাপিটালিস্ট বড় এগ্রো বিজনেস ফার্ম গ্রামে ঢুকছে। কারণ তাদের জমি লাগবে, তাই জমিকে মালিকের কাছ থেকে নিয়ে একটি সুরক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি লিজিংয়ের ভিত্তিতে ছোট কৃষকদের দিয়ে তারপর সেই ফসলটার দুই ভাগ করে একটা ভাগ জমির মালিককে প্রদান এবং অন্য ভাগটি উপকরণের জন্য ব্যবহার করতে পারে। যেমনটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন উপকরণের এক ভাগ, জমির মালিকের এক ভাগ আর শ্রমের এক ভাগ। সেটা কিন্তু এভাবেও ভূমি মালিক ও ভূমিহীনের মধ্যে কিছুটা বৈষম্য হ্রাস নিশ্চিত করা সম্ভব। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এটি একটি উপায় হতে পারে। কৃষি ও কৃষককে বৃহৎ বুর্জোয়া ও গ্রামের কায়েমি স্বার্থের কবল থেকে নিরাপদ না করতে পারলে খাদ্যনিরাপত্তা হবে না। 

শাকসবজি, মাছ, মাংস, ভোজ্যতেল, দুধ ও দুধজাতীয় পণ্য উৎপাদনে আমরা চাহিদা অনুপাতে পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারছি না। এসব যারা উৎপাদন করে তাদের সুসংগঠিত করা, প্রণোদনা দেয়া এবং সাপ্লাই বাড়ানো উচিত। যতদিন চাহিদা ও জোগানের মধ্যে মিল না হচ্ছে তত দিন কিছু হলেও আমদানি করতে হবে। যেমন এখন আমরা গুঁড়া দুধ আমদানি করছি। একই সঙ্গে আমাদের একটা লম্বা পরিকল্পনা করে ডেইরি ফার্ম, লাইভ স্টক আমদানি পরিপূরক শিল্পকে উৎসাহিত করা। জাতীয় বুর্জোয়াদের এ উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। এ উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের ভুল হয়। ১ ডলার যদি আমি আমদানি বাবদ বাঁচাতে পারি তা কিন্তু এক ডলার সমান রফতানি আয় করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। এখানে সরকারের রাজনৈতিক অর্থনীতিটি হলো, সরকার যুগপৎ আমদানি ও রফতানি লবিকে রক্ষায় বেশি আগ্রহী। সেই কারণে আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্প এখানে গড়ে উঠছে না। আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্প আরো দুটি কারণেও হয় না—একটা হলো পণ্যের মান খারাপ এবং অন্যটি হলো দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম আমদানি মূল্য থেকে বেশি হয়। এসব দিকে আমাদের মনোযোগ দিতেই হবে। যদি ভালো মানের এবং কম খরচে আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্প গড়ে ওঠার অবকাশ থাকে তাহলে সরকার তাকে সহায়তা দিতে পারে। দ্বিতীয় নীতি হওয়া উচিত ছিল রফতানিকে যে পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় ঠিক একই পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা আমদানি প্রতিস্থাপনকারী শিল্পকে দেয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা থাকলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শিশু শিল্প হিসেবে তাকে রক্ষা করা সম্ভব। এর চমৎকার উদাহরণ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার স্টিল মিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় স্টিল মিল ছিল তুলনামূলক ব্যয় বেশি ও মানেও খারাপ। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া ঠিক করল—আমি আমদানি করব না আমি ভর্তুকি দিয়ে হলেও মান বাড়ানোর চেষ্টা করব। তখন দেশটির সরকার ভালো মানের স্টিলের জন্য দাম বৃদ্ধি করে হলেও স্টিল কারখানা চালিয়েছে। ভর্তুকি দিয়েছে। ১০ বছরের মতো ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তারা। এ ১০ বছরের মধ্যে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে বলা হয়। তারা এভাবে শিশু শিল্পকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন করেছে। আজ তারা স্টিল শিল্পে অগ্রগামী। আমাদের ক্ষেত্রেও ডেইরি, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল ও গম উৎপাদনে ভর্তুকি দিতে পারি তাহলে মান ও সরবরাহ উভয়ই বাড়ানো সম্ভব। এসব তো গেল মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।

স্বল্পমেয়াদে ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য করণীয় কী? হঠাৎ করে একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো আর মৌসুমি ফসলের দাম বেড়ে গেল তখন করণীয় কী? সাহাবুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে একাধিক কমিশন করা হয়েছিল। সেখানে নিত্যপণ্য উৎপাদন ও বাজার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশের জন্য ড. মাহবুব হোসেনকে দিয়ে একটি গবেষণা করানো হয়েছিল। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সেখানে এ-সংক্রান্ত একটি অধ্যায় ছিল। তাতে ড. মাহবুব হোসেনের পরামর্শ ছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের চাহিদা, জোগান ও উৎপাদন এবং দামের তথ্য সরকারের কাছে থাকতে হবে। অপরিহার্য খাদ্য পণ্যগুলোর পরিমাণ কত, মাথাপিছু প্রয়োজনীয়তা কত? জনসংখ্যা কত? প্রয়োজন ও উৎপাদন কত এবং আমদানি কত—এসব হিসাব থাকলে সরকার পরিকল্পনামতো আগেই কার্য সম্পাদন করতে পারবে। তাই এমন হিসাবটা আগে থেকেই সরকারের কাছে থাকলে যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেবে তখনই আমদানি বাড়িয়ে দেবে। আরেকটি বিষয় হলো চাহিদার সঙ্গে জোগান মিলিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করা হলে বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। সেখানে আরেকটি সুপারিশ ছিল আর তাহলো জরুরি নিত্যপণ্যের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ সরকারের গুদামে মজুদ থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, এটি সরকার কীভাবে সংগ্রহ করবে। যখন দাম খুব কমে গেছে তখন সরকার নিজের বাজেট থেকে টাকা দিয়ে সেই পণ্য কিনবে, কেনার সময় অবশ্যই কৃষকের উৎপাদন ব্যয় ও মুনাফা যোগ করে দাম পরিশোধ করবে। যখন দাম বেড়ে যাবে তখন সার্ভিস ব্যয় টাকা যোগ করে তা বিক্রি করবে। এতে সিন্ডিকেট বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের এখানে খোলাবাজারে সরকারি যেসব পণ্য বিক্রি করে সেটার পরিসর বড় করা গেলে তা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। ভারত অপরিহার্য কিছু পণ্যের তালিকা করেছে এবং সেগুলো সরবরাহে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। শুধু তা-ই নয়, স্বল্পমূল্যে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষকে নিত্যপণ্য সরবরাহ করছে। এটা কিন্তু আমাদের দেশেও করা সম্ভব। কিন্তু সেটার জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। আর এখানেই আসবে আবারো রাজনৈতিক অর্থনীতির কথা। বড় চমকপ্রদ অবকাঠামো তৈরি করা হবে নাকি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, খেলাপিদের ধরবে না ছাড় দেবে—কোটিপতিদের কাছে মাথা নত করবে নাকি তাদের কাছ থেকে সম্পদ কর কঠোরভাবে আদায় করবে—সেটি একটি বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন।

ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও