যেসব সংস্কার নির্বাচিত সরকার ছাড়াই করা যায় সেগুলোও হচ্ছে না

স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারে সরকারের মনোযোগ প্রয়োজন

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বিগত সরকারের পতন ঘটে এবং গঠন করা হয় নতুন ‘অন্তর্বর্তী সরকার’। নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বিগত সরকারের পতন ঘটে এবং গঠন করা হয় নতুন ‘অন্তর্বর্তী সরকার’। নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। সংস্কার ঘিরেই এ সরকারকে নিয়ে জনমনে প্রত্যাশাও ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রত্যাশা ছিল বলার কারণ, সময়ের পরিক্রমায় এবং বাস্তব প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তা কিছুটা ফিকে হয়ে পড়েছে।

একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি ন্যূনতম কাঠামোগত কিছু সংস্কারের কথা শুরু থেকে বলে এলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজের তেমন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ তাদের দায়িত্ব নেয়ার আট মাসের অধিক সময় পেরিয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতির বাইরেও যেসব জরুরি সংস্কার ও মানবিক কাজ অনায়াসেই করা যেত, সেগুলোয় আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। যেমন জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা, নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে কার্যত কোনো ‍কার্যকর উদ্যোগ নেই। অথচ জনগণের প্রত্যাশা ছিল, অন্তত মৌলিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এ সরকার। আবার অনেক পুরনো আলোচিত মামলাগুলো এখনো স্থবির অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। একই সঙ্গে অনেকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহারের ব্যাপারে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু সেটিও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সরকার যদি স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য কার্যক্রম সফল করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের নানা খাতে ঝুঁকি আরো বাড়বে। সেই ঝুঁকি এড়াতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের যেসব প্রাথমিক ও প্রধান প্রত্যাশা ছিল তা পূরণে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি নির্বাচনী পরিবেশ ইতিবাচক রাখার দায়িত্ব সরকারের অবশ্য পালনীয় হওয়া প্রয়োজন। তবে অর্থনৈতিক সংস্কার এখানেও প্রণিধানযোগ্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের পরিসর স্বাভাবিকভাবেই সীমিত। তাদের প্রধান দায়িত্ব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ তৈরি করা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে স্বল্পমেয়াদে অন্তর্বর্তী সরকার বেশকিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারে, যেগুলো রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত নয় এবং জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হবে।

জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ গ্রহণযোগ্য করতে নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষত জনপ্রশাসন সংস্কার। কারণ বিগত সরকারের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করার পেছনে জনপ্রশাসনের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। যদিও এরই মধ্যে সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার ঘিরে নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। পদায়ন, নিয়োগ ইত্যাদি ঘিরে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা রয়েছে এখনো এবং কাজে গতি ফেরেনি। রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ অংশের সংস্কার ছাড়া অন্য কোনো সংস্কার যে ফলপ্রসূ হবে না তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। জনপ্রশাসনকে দলীয়করণের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।

জনপ্রশাসনের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে স্বচ্ছতা থাকা চাই।

নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠুকরণের পাশাপাশি সরকার স্বল্পমেয়াদে মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে পারে। যেসব মানুষ রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা অতিসত্বর প্রত্যাহার করা উচিত। জামিনপ্রাপ্ত বন্দিদের দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুরনো আলোচিত মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের সহিংসতায় যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসা এবং নিহতদের পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদান জরুরি। সংখ্যালঘু, নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য বা হয়রানির যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি আবশ্যক।

অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ নিশ্চিতে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহি অত্যন্ত জরুরি। দেশের অভ্যন্তরে বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেকোনো চুক্তির ক্ষেত্রে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া তাই আবশ্যক, যার ঘাটতি কিছু ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে।

ঘাটতি রয়েছে অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও। সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ে সরকারের সম্পৃক্ততা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক বিভেদ বেশ স্পষ্ট এখন। দুঃখজনকভাবে এতে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে যে পরিস্থিতি প্রয়োজন, সেক্ষেত্রেও নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সংস্কারের জন্য সব অংশীজনের যেভাবে অংশগ্রহণ দরকার, সেটি দেখা যাচ্ছে না। ফলে অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে সংশয় তৈরি হয়েছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে জনমনে যেসব প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারও, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সহায়ক হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিশন থেকেও অভিযোগ উঠেছে স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো না মানার। আবার এখনো স্বস্তিদায়ক ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হয়নি। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মাঝে আস্থার সংকট রয়েই গেছে। আস্থা পুনরুদ্ধারে অর্থনীতিবিদরা নীতি ধারাবাহিকতা নিশ্চিতের কথা বললেও তা নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে নীতি ধারাবাহিকতা রক্ষায় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে অন্তত একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করার পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। উপরন্তু গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে বেশকিছু বড় কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকারত্বের হার বাড়ছে। কিন্তু সে অনুপাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি নেই, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার পিছিয়ে গেছে।

সরকারের এসব কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। অন্তত স্বল্পমেয়াদি কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে এতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আরো স্থিতিশীল হবে এবং তা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াবে। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিত্তি তৈরি হবে।

আরও