বনেদি পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান ঢাকা?

ঢাকা শহরের শব্দদূষণ সর্বসাধারণের সমস্যা, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে আমরা কি জানি? এই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এসব জায়গায় শব্দদূষণের বিষয়ে বেশি কড়াকড়ি নিয়ম থাকার কথা। কিন্তু সাধারণত এ শহরের কোথাও এসব নিয়মের বালাই নেই।

শীত শীত বিকালগুলোয় মৃদু বাতাস বয়ে গেলে ইচ্ছা করে প্রাণভরে শ্বাস নিতে। বিশেষ করে কোথাও থেকে যদি ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। কিন্তু আপনি যদি ঢাকা শহরের বাসিন্দা হন তাহলে প্রাণভরে শ্বাস নিতে গেলে দুই ধরনের বিপদ আছে। এক. ফুলের ঘ্রাণকে ছড়িয়ে আপনার নাকে প্রবেশ করবে দুর্গন্ধ। যেহেতু আদিম যুগের মানুষ খোলামেলা পরিবেশে প্রাকৃতিক কাজ করতে অভ্যস্ত। আর রাস্তার পাশে জমে থাকা বর্জ্য তো আছেই। আরেকটি বিপদ হলো আপনার স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের যা আয়ুষ্কালও কমিয়ে দিতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ঢাকা অনেক কিছু হতে পারত, ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য অন্তত সে কথাই বলে। কিন্তু শহরটি মূলত বনেদি পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান হয়ে গেছে। বংশ পরম্পরার কোনো ছাপ তার মধ্যে নেই। কেবল আছে বাতাসে দূষণ, কেবল আছে কর্কশ শব্দ। সেই দূষণে না ঠিকমতো শ্বাস নেয়া যায় আর না পিনপতন নীরবতায় খানিকটা সুখালাপ করা যায়। পরিস্থিতি এমন যে একটা কবিতা পড়া যায় না ঠিকঠাক। শঙ্খ ঘোষের লেখা আমার প্রিয় কবিতাটি পড়তে গেলে বলে বসি—

‘একটা দুটো সহজ কথা

বলব ভাবি নীরব-নিভৃতে

হর্নে হর্নে তা হারিয়ে যায়

পথে-ঘাটে, এই শহরে’।

শব্দদূষণের বিষয়টিতে পরে আসি। ঢাকার বায়ুদূষণ যে অবস্থায় পৌঁছেছে, কেন স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা হয় না বা কোনো আগাম সতর্কবার্তা দেয়া হয় না কিংবা আবহাওয়া ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কেন দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধানের পথে হাঁটা হয় না—এসব চিন্তা হতাশ করে তোলে।

এদিকে ২০২৪-এর শেষ মাসজুড়ে ঢাকার বায়ু ছিল খুব বেশি অস্বাস্থ্যকর। ৫ ডিসেম্বর ঢাকার বায়ু দুর্যোগপূর্ণই হয়ে ওঠে। সেদিন সকাল ৯টায় বাতাসের গুণমান সূচকে (একিউআই) স্কোর ৩৯২ নিয়ে ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে দূষিত। একই অবস্থা দাঁড়ায় ৯ ডিসেম্বরও। সেদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্বের ১২৬টি দূষিত শহরের মধ্যে শীর্ষে উঠে আসে ঢাকার নাম। এ সময় ঢাকার স্কোর ছিল ৩০৫। আবার এ মাসের শেষ তারিখ তথা ২০২৪ সালের শেষ দিনেও ঢাকার বায়ুমান ছিল ২০৬।

এদিকে ক্যালেন্ডারে নতুন সাল যুক্ত হয়েছে। কিন্তু পুরনো দূষণ দূর তো দূরের কথা, উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেনি পর্যন্ত। নতুন বছরের প্রথম দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্বের ১২৬টি শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল অষ্টম। সে সময় আইকিউএয়ার মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১১। এ স্কোরকেও ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বায়ুদূষণের এ মান নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। আর এ সূচকে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার শীর্ষে অবস্থান করাটা নতুন কিছু নয়। আবার এ নিয়ে সমাধানের পথে যারা হাঁটতে পারতেন বা এখনো পারবেন, তাদের নিশ্চুপ ভূমিকাও বেশ পুরনো আলাপের বিষয়। তবু অভিজ্ঞতার আলোকে এ নিয়ে একটা আলাপ অবশ্য করাই যায়।

ঢাকা শহরের শব্দদূষণ সর্বসাধারণের সমস্যা, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে আমরা কি জানি? এই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এসব জায়গায় শব্দদূষণের বিষয়ে বেশি কড়াকড়ি নিয়ম থাকার কথা। কিন্তু সাধারণত এ শহরের কোথাও এসব নিয়মের বালাই নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একদল শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে সাউন্ড বক্সে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বিশেষত হলের কাছাকাছি স্থানগুলোয় দীর্ঘ রাত পর্যন্ত শব্দদূষণের প্রতিবাদ জানানো এবং উপাচার্য যেন এর সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। গণমাধ্যম মারফতে যতটুকু জানা যায়, শিক্ষার্থীরা একাধিকবার এ বিষয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় তারা প্রতিবাদের এ উপায় বেছে নিয়েছেন। তাছাড়া ভিসির বাসভবনের সামনে প্রতিবাদ করা আমাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ। যত দূর মনে পড়ে, আহমদ ছফা লিখেছিলেন যে আমাদের ভিসিদের নিজে থেকে কোনো কাজ করতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুদিন পরপর আন্দোলন হয়, আর ভিসিরা সে মোতাবেকই কাজ করেন। সে যাক গে, আসল কথা হলো শিক্ষার্থীরা বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত লোকসমাগম এবং এর ফলে তৈরি হওয়া তীব্র যানজট ও শব্দদূষণের প্রতিবাদে দাঁড়িয়েও কোনো সমাধান পাননি। তবে সে ঘটনার পর ত্বরিত গতিতে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বহিরাগত যান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এখানে উল্লেখ্য, ঢাবি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে কতটা ইতিবাচক সেটি এ আলোচনার মুখ্য বিষয় নয় বলে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে।

তবে এটিই প্রথম নয়, অতিরিক্ত লোকসমাগম ও যানজট প্রসঙ্গে এক ঘটনা কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন আগে শিক্ষার্থীদের ভাগ্য খুলে যায়। তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসি মহোদয় নিজের কাজ শেষ করে তার বাসভবনে ফেরার সময় টিএসসিতে দীর্ঘক্ষণ আটকে ছিলেন। কোনোভাবেই কোনোদিক দিয়েই তার গাড়ি বেরোতে পারেনি। সেই সময় ঢাবিতে উপচে পড়া ভিড়ের অন্যতম কারণ ছিল যত্রতত্র বসা খাবারের দোকান। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় পা ফেলানো দায় ছিল সেখানে। মজার বিষয় হলো, ঠিক ভিসির গাড়ি আটকে থাকার ঘটনার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো উঠিয়ে দেয়া হয় এবং স্থানান্তর করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

গান বাজানো আর ভিসির গাড়ি আটকে থাকা—এ উভয় ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে তোলে—এ শহরে বা এ দেশে জনসাধারণের ভোগান্তি নিরাময়ের একটি অন্যতম উপায় হলো সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের সেই ভোগান্তির শিকার হতে হবে। আমি বলছি না যে বায়ুর মান উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা শহরের উন্মুক্ত স্থানে এনে বসিয়ে রাখতে হবে কিংবা চার রাস্তার মোড়ে তাদের চেয়ার স্থাপন করতে হবে। কিন্তু আবার বাস্তবতার দিকে তাকালে মনে হয়, এছাড়া আর উপায় আছে কি?

কার্যকর উপায় যতদিন না বেরোয়, ততদিন নিজেদের সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচতে আইকিউএয়ারের পরামর্শ, ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না এবং ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হবে। যতটা সম্ভব এ পরামর্শগুলো আমাদের মানা প্রয়োজন। নিজ থেকে বায়ুদূষণের বিষয়ে যতটা সম্ভব তথ্য রাখতে এবং সচেতন থাকতে হবে। আর সাদা চোখে শব্দদূষণ থেকে বাঁচার হয়তো একটি উপায়ই আছে, শহরটাই ছেড়ে দেয়া। তাহলে হয়তো এ শহরও মানুষের চাপ থেকে কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচবে।

সাবরিনা স্বর্ণা: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

আরও