টানা কয়েক অর্থবছর কোনো দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূচক নিম্নমুখী হলে সে দেশে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ সূচকের মধ্যে অন্যতম হলো বিনিয়োগ। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চক্রাকারে একে অন্যকে প্রভাবিত করে। বিনিয়োগ নিম্নগামী হওয়ার অর্থ হলো অর্থনীতির চাকার গতি শ্লথ হয়ে আসা। কারণ পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে শিল্প উৎপাদন ক্রমে কমে তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ব্যাহত হয়। আবার অন্যদিকে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, যা বেকারত্বের হার বাড়ায়। আর অর্থনৈতিক এসব সংকট শিল্প উৎপাদন হ্রাস, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ইত্যাদি যদি আগে থেকে বিদ্যমান থাকে তাহলে সেগুলো বিনিয়োগ পরিবেশের অবনমন ঘটায়। এসব সংকট যত দীর্ঘায়িত হয়, বিনিয়োগ পরিস্থিতি তত বিনিয়োগের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। এর ওপর যদি সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতাও বিরাজ করে তাহলে বিনিয়োগ পরিস্থিতি এক ধরনের স্থবির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কারণ এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয় এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
সম্প্রতি বিনিয়োগ স্থবিরতার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা দেশে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তার এ শঙ্কা অগ্রাহ্য করা কঠিন। কেননা উপরিল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা এক ধরনের ভঙ্গুর বলা যায়। বিগত সরকারের তৈরি অলিগার্ক ব্যবসায়ী শ্রেণী, নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নত করতে হবে। সরকারের এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেয়া দরকার।
বিগত সরকারের আমলে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ ২২-২৩ শতাংশেই আটকে আছে। এ সময় রাজনৈতিক মদদে কতিপয় অলিগার্ক ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি হয়েছে যাদের রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এসব ব্যবসায়ী দেশের ব্যাংক খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়েছে এবং পাচার করেছে বিপুল অংকের অর্থ। লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তীব্র হয়েছে যার প্রভাব পড়ে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে। উপরন্তু গত ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকার পরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো ঘটনায় অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এখনো পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়নি। একেক দিন একেক শ্রেণী-গোষ্ঠীর মানুষ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামছে। এরই মধ্যে মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রতিটি নাগরিক যেখানে শঙ্কায় রয়েছে সেখানে ব্যবসায়ীদের কাছে বিনিয়োগ একটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণত বিনিয়োগ কম হয়। আবার ব্যবসা সম্প্রসারণে নীতির ধারাবাহিকতা একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। এরূপ রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতায় নীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকার ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে। সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছাড়াও দেশে অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান দীর্ঘদিন ধরে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক পদক্ষেপস্বরূপ বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এটি এখন বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে ব্যাংক ঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসা খরচও বেড়েছে, যেখানে জ্বালানি সংকটে আগে থেকেই উৎপাদনে শ্লথগতি নেমে এসেছে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে বলে প্রতীয়মান হয় না। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাভাবিক করে তোলা প্রয়োজন যাতে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা দেয়া যায়। এটি জরুরি, কারণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগের প্রস্তাবও কমেছে। বিডার তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৬টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। টাকার অংকে যা ১৯ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। আগের তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় এক-চতুর্থাংশ। ওই সময়ে ২৫৪টি প্রতিষ্ঠান ৭৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। সুতরাং দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শিল্প খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পাশাপাশি শিল্প খাত থেকে শুরু করে ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে, যার প্রতিফলন ব্যাংক খাতে সুস্পষ্ট। এজন্য সার্বিকভাবে সুশাসন নিশ্চিতেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা যাবে আশা করা যায়। তবে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যবসা পরিবেশের সূচকে উন্নতি করতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশের ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে। চলতি বছরের মে মাসে ব্যবসা পরিবেশ সূচক (বিবিএক্স) ২০২৩-২৪ জরিপে উল্লেখ করা হয়, সার্বিকভাবে ২০২৩ সালে দেশের ব্যবসা পরিবেশের সূচকে ১০০ স্কোরের মধ্যে অর্জন ৫৮ দশমিক ৭৫, যা ২০২২ সালে ছিল ৬১ দশমিক ৯৫। ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিতেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে পিছিয়ে।
এ অবস্থার উন্নয়নেও সুশাসন প্রয়োজন। কারণ দেশে ব্যবসার প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। এ তথ্য সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপেও উঠে এসেছে। দুর্নীতি দূর করার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতারও সমাধান করা প্রয়োজন ব্যবসা সহজ করতে।
তবে দেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সমস্যা হলো পর্যাপ্ত জ্বালানির অভাব। এর সমাধানেও তাই নজর দিতে হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন শিল্পোৎপাদন সম্ভব নয়। আর শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে শিল্প উৎপাদন কমে গেলে তা কীভাবে বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে।
মোট কথা, বিনিয়োগের পথ সুগম করতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ অবশ্যই উন্নত করতে হবে। আর এর জন্য দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অপরিহার্য। ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা ভরসা পেলে বিনিয়োগ স্থবিরতা কেটে যাবে বলে আশা করা যায়।