বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করে চলেছে। যেসব দ্রব্যসামগ্রী মানুষের ব্যবহার-পরবর্তী কাজে লাগে না তাকে আমরা বর্জ্য বলি। মানুষের নানা চাহিদা ও ভোগের একটি বিরাট অংশ পরিণত হচ্ছে বহুমাত্রিক বর্জ্যে। গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, মেডিকেল, বাজার, যানবাহন ও সমুদ্রযান ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস থেকে মূলত কঠিন, তরল ও বায়বীয় বর্জ্য উৎপাদন হয়। শহর-নগর হলো অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অন্যতম ক্ষেত্র। এ নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে মানুষ এখন শহরমুখী, ক্রমাগত এ শহরমুখী মানুষের জন্য পৃথিবীব্যাপী শহরগুলোয় বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে যে গতিতে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে গতিতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। শহরের জনসংখ্যার আগামী প্রজন্মের উন্নত টেকসই নগর পরিবেশের জন্য মূলত যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
যেমন বাংলাদেশের অন্যান্য শহর অপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সচেতনতা এবং যথাযথ সমন্বয়ের অভাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পরিবেশ নানা সমস্যার সম্মুখীন।
দ্রুত নগরায়ণের ফলে বাসস্থান ও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে ভরাট হচ্ছে পুকুর, খাল-বিল, জলাশয়, নিম্নভূমি। এছাড়া বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে নানা ধরনের চাপ। যেমন আবাসন, মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ এবং নগরীয় বর্জ্য সমস্যা। বাংলাদেশের শহর এলাকায় এখনো পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় টেকসই নগর পরিবেশ নিশ্চিত করা বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের অগ্রগতির ফলে অভিগমন ও প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে নগরের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে বর্জ্যের পরিমাণও ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। নগর পরিবেশের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বর্তমানে একটি মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত। এজন্য সব পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট দায়িত্ব নিয়ে সচেতন ও সুরক্ষিত অবস্থায় সমন্বয়ের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। দ্রুত নগরায়ণের ফলে নগরের মানুষ সীমিত স্থানে বসবাস এবং নানা পণ্যের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে যে বর্জ্যের সৃষ্টি হয় তাই নগরীয় বর্জ্য। বিশ্বের নগরগুলোয় বিভিন্ন উৎস থেকে কঠিন, তরল ও বায়বীয় বর্জ্য উৎপাদন হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে। চসিকের হিসেবে নগরীতে হোল্ডিং (গৃহ) সংখ্যা হলো ২ লাখ ৪ হাজার ১৪০টি এবং চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন উৎস থেকে দৈনিক প্রায় ২ হাজার ৮০০ টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপন্ন হয় ১ হাজার ২০০ টন। প্রায় ৭০ লাখ নগরবাসীর বর্জ্য সংগ্রহ ও নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়োজিত রয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৬৫৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও গাড়িচালক। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে দৈনিক প্রায় ১৫০ টন বর্জ্য রাস্তা, নালা, নর্দমা, খালে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে এসব বর্জ্য বৃষ্টির পানিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীতে জমা হয়ে নদীকে দূষিত করছে। এতে বিপন্ন হচ্ছে কর্ণফুলীর বাস্তুসংস্থান এবং হ্রাস পাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর নাব্যতা। অন্যদিকে শহরের পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের দায়িত্বে নিয়োজিত চট্টগ্রাম ওয়াসা, কিন্তু দুঃখের বিষয় দীর্ঘ ৫৮ বছরেও ওয়াসা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখনো শুরু করতে পারেনি। ফলে দিনের পর দিন সব পয়োবর্জ্য জমা হচ্ছে সেপটিক ট্যাংকে। এক হিসাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে দৈনিক ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্লাজ বা মানব বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ১৫ ঘনমিটার সিটি করপোরেশন এবং ২০ ঘনমিটার এনজিও সংস্থা ডিএসকের মাধ্যমে পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী সিটি করপোরেশন তার সীমানাধীন সব জনপথ, সাধারণ পায়খানা, প্রস্রাবখানা, নর্দমা, ইমারত ও সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ ও অপসারণ করবে। কিন্ত পর্যাপ্ত ব্যবস্থার অভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় ৩০ হাজার কাঁচা পায়খানা এবং ৬০ হাজার স্যানিটারি পায়খানার পয়োবর্জ্য সরাসরি পড়ছে খাল, নালা ও নদীতে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব শিল্প-কারখানাকে লাল, কমলা ও সবুজ ক্যাটাগরিতে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে। লাল ও কমলা শ্রেণীর কারখানা বিপজ্জনক শিল্পবর্জ্য নিঃসরণ করে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও দুঃসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছে। আইন অনুযায়ী প্রত্যেক শিল্প-কারখানায় ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু চট্টগ্রামের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের ইটিপি নেই। ফলে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের সব শিল্পবর্জ্য সরাসরি খালে অথবা নালায় ফেলে দেয়, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর এসব বিষয় মনিটর করার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় লোকবল ও অন্যান্য কারণে তদারকির বাইরে থেকে যায়। দৃশ্যমান ও দণ্ডনীয় কোনো জরিমানা না থাকায় এসব শিল্পবর্জ্য যত্রতত্র পড়ে থাকায় নগর পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এক প্রসিদ্ধ ও বিরাট সম্ভাবনাময় এক শিল্প। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্পের সঠিক পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং এ শিল্পের শক্তিশালী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় ট্যানারি বর্জ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভয়াবহ দূষণের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের এক জরিপে বলা হয়, হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে দৈনিক ৭৭ লাখ লিটার তরল বর্জ্য ও ৮৮ লাখ টন কঠিন বর্জ্য নির্গত হয়। চট্টগ্রামের ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে কর্ণফুলী ও হালদার নদী দূষণ ছাড়াও নগরীর বায়ু, মাটি ও আন্ডারগ্রাউন্ড পানিকে দূষিত করছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ২১৭ হাসপাতাল থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ দৈনিক ২০০-২৫০ কেজি মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে হালিশহর আনন্দবাজার এলাকার ডাম্পিং স্পটে জমা করে। বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক এ মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক কোনো পদ্ধতি না থাকায় সনাতন পদ্ধতিতেই এ বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয়। সম্প্রতি একটি ইনসিনারেটর আধুনিক পদ্ধতি এ শহরে চালু করেছে যদিও তা সীমিত পরিসরে। সম্প্রতি ই-বর্জ্য এবং ব্যাটারি থেকে নির্গত সিসা শহর এলাকার পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। এছাড়া নষ্ট কম্পিউটার ও পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির বর্জ্য থেকে তেজষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে শহর এলাকার মানুষের শরীর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নগরবাসী ও সিটি করপোরেশনকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া এবং সচেতন হওয়া এখন সময়ের অন্যতম দাবি।
কোনো এলাকায় যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে অংশীজনের মতামত অপরিহার্য। আবার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশে ও জনবহুল এলাকায় আবর্জনাগার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বাধিক সচেতন ও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলীর ফতেয়াবাদে সন্দ্বীপ কলোনির ৫০ একর জায়গায় ল্যান্ডফিল স্থাপনের জন্য জায়গা চিহ্নিত করে এরই মধ্যে পাঁচ একর জমি ক্রয় করেছে। স্বাভাবিকভাবেই ওই এলাকার বসবাসকারী জনসাধারণ এরই মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ শুরু করেছে। পাহাড়, সবুজের আচ্ছাদনে ঘেরা, সেনানিবাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী, জনবহুল, বাজার ও বিনোদন কেন্দ্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে যে আবর্জনাগার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে তা এ এলাকার পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। সন্দ্বীপ কলোনির যে জায়গায় ল্যান্ডফিল বা বর্জ্যাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে তা আত্মঘাতী একটি পরিকল্পনা হতে পারে। কোনো ধরনের ইআইএ ছাড়া এ ধরনের পরিকল্পনা কখনো সুফল বয়ে আনবে না। এত জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সন্নিকটে পুরো এলাকার পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। চট্টগ্রাম শহরে আধুনিক ও পরিকল্পিত ল্যান্ডফিল অবশ্যই প্রয়োজন তবে স্থান নির্ধারণে যথেষ্ট সচেতন ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রয়োজন। কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণা ছাড়াই এ ধরনের আবর্জনাগার গড়ে তোলা নগর ও স্থানীয় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত বর্জ্যাগার হয় আবাসিক, শিল্প, জলাশয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখে। বর্জ্যের ভাগাড় হবে বিশাল মাটির স্তর রয়েছে এমন জায়গায়, যাতে বর্জ্য নিঃসৃত পানি মাটি শোষণ করে নিতে পারে। এছাড়া শ্রেণীভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। পরিকল্পিত ও আদর্শমানের না হলেও দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের হালিশহরের আনন্দবাজার ও বায়েজিদ এলাকায় নগরীর সব বর্জ্যগুলো ডাম্প করা হয়। এখন সময় এসেছে পরিকল্পিতভাবে, আদর্শমানের ভিত্তিতে, জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে লোকালয় থেকে দূরবর্তী স্থানে একটি আধুনিক আবর্জনাগার গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম শহরের টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য কিছু সুপারিশ উল্লেখ করা হলো: (ক) বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণমাধ্যমের ব্যবহার প্রচার; (খ) বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে বর্জ্য উৎপাদনের উৎসস্থলে শ্রেণী অনুযায়ী পৃথক ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করা; (গ) বর্জ্য পদার্থের পুনরাবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাভজনক পণ্যে রূপান্তর; (ঘ) আবর্জনাগারের কাছাকাছি বায়োগ্যাস প্রজেক্ট স্থাপন করা যাতে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি জ্বালানি খাতে সরবরাহ বৃদ্ধি পায়; (ঙ) নগরের জোনভিত্তিক ছোট আকারের পতিত স্থানে ডাম্পিং জোন স্থাপন করা; (চ) সড়ক জ্যাম হ্রাস, দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ থেকে সাধারণ নগরবাসীকে রক্ষায় দিনের কোলাহল পরিবেশের পরিবর্তে রাতের সময় কাভার্ড গাড়িতে বর্জ্য পরিবহন; (ছ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং (জ) সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও এলাকাবাসীর সমন্বয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ড. মো. ইকবাল সরোয়ার: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়