আলোকপাত

জ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত: ২০২৪ সালের বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার

১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার, যা অসাধারণ মৌলিক গবেষণা আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর দেয়া হয়।

১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার, যা অসাধারণ মৌলিক গবেষণা আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর দেয়া হয়। পাঁচটি ক্ষেত্রে যথা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। সুইডেনের রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী এ পুরস্কার দেয়া হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের একটি স্বর্ণপদক, সনদ ও উল্লেখযোগ্য অর্থ (যা ২০২৩ সালে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার ছিল) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ পুরস্কারের অর্থ ১২ কোটি টাকার কাছাকাছি।

২০২৪ সালে চিকিৎসা, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন—এ তিনটি শাখায় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তরা যে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন, তা এরই মধ্যে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে বিশালভাবে প্রভাবিত করছে। এ তিনটি পুরস্কার বিজয়ীদের গবেষণায় দেখা যায়, জীববিজ্ঞান, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সমন্বয় আমাদের সমাজ ও বিশ্ব ব্যবস্থাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। এ পুরস্কারগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মাইক্রোআরএনএ (microRNA), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং এবং প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন এবং কার্যক্রম।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ বছরে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলো জীববিজ্ঞান তথা জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ প্রবন্ধে আমি বিজ্ঞানে এ বছর নোবেল জয়ী শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এবং তা কীভাবে আমাদের জীবন, সমাজ, অর্থনীতি এবং সর্বোপরি বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখতে পারে তা আলোকপাত করব।

২০২৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরতত্ত্বে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন। মাইক্রোআরএনএ এবং ট্রান্সক্রিপশন-পরবর্তী জিন নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন জ্ঞান সৃজনের জন্য তারা এ সম্মাননা অর্জন করেন। তাদের গবেষণা বহুকোষী জীবদেহে জিন নিয়ন্ত্রণের ধারণা বদলে দিয়েছে।

প্রতিটি জীবদেহের গাঠনিক একক হচ্ছে কোষ। জীবের সব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলি কোষের অভ্যন্তরে ডিএনএ অণুতে কোড আকারে সংরক্ষিত থাকে। সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী কোডগুলোকে জিন বলা হয়। মানুষের ডিএনএ অণুতে রয়েছে তিরিশ হাজারের বেশি জিন। জিনের কোডগুলো ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে এমআরএনএ (mRNA) তৈরি হয়। এমআরএনএ ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে কোষে প্রোটিন তৈরি হয়। জীবের কোষে সব কার্যক্রম প্রোটিন করে থাকে। জিনের এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে প্রোটিন তৈরি হওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়াটিকে প্রাণরসায়নে সেন্ট্রাল ডগমা হিসেবে অভিহিত। তবে এবারের নোবেল জয়ীদের আবিষ্কৃত মাইক্রোআরএনএ পুরনো ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেয়। মাইক্রোআরএনএ যা ২০-২৫টি নিউক্লিওটাইড দ্বারা গঠিত, তা জিনের এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে প্রোটিন তৈরিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জিনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণের ফলে জীবের বিভিন্ন ধরনের কোষের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাংসপেশির কোষ ও স্নায়ুকোষের গঠন ও কার্যাবলি আলাদা। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর উদ্ভব ঘটে জিনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, যেখানে নির্দিষ্ট জিনগুলো বিশেষ কোষে কাজ করে। পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য সঠিক নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জিন নিয়ন্ত্রণের অস্বাভাবিকতা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং বিভিন্ন অটোইমিউন রোগের জন্ম দিতে পারে। জীবের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।

১৯৯৩ সালে অ্যামব্রোস এবং রাভকুন নতুন একটি জিন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যখন তারা Caenorhabditis elegans নামক একটি গোলকৃমির জিন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। গবেষণায় তারা দেখলেন যে লিন-৪ (lin-4) জিনটি লিন-১৪ (lin-14) জিনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে। লিন-৪ জিন থেকে উৎপন্ন ক্ষুদ্র আরএনএ, যা পরে মাইক্রোআরএনএ নামে পরিচিত হয়, লিন-১৪ এর কার্যকারিতা বন্ধ করে দেয়। এ গবেষণার ফলাফল সম্পূর্ণ এক নতুন ধারণার জন্ম দেয়—জিন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া ট্রান্সক্রিপশনের পরে ঘটে। প্রথমদিকে এই আবিষ্কার বিশেষ গুরুত্ব না পেলেও ২০০০ সালে রাভকুনের দল লেট-৭ নামের একটি নতুন মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার করে। লিন-৪ ও লিন-১৪ জিনের তুলনায় লেট-৭ বিভিন্ন জীবের কোষে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ আবিষ্কার মাইক্রোআরএনএ নিয়ে গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

এখন জানা গেছে, মানব জিনোমে হাজার হাজার মাইক্রোআরএনএ নির্দেশনার উপস্থিতি রয়েছে, যা কোষ ও টিস্যুর বৃদ্ধি ও কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীরা মাইক্রোআরএনএ এবং অন্যান্য আরএনএর সম্পর্ক ও কার্যকর প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। একটি মাইক্রোআরএনএ একাধিক জিনের ওপর কাজ করতে পারে, আবার একটি জিনের ওপরেও বহু মাইক্রোআরএনএ কার্যকর হতে পারে। মাইক্রোআরএনএর আবিষ্কার আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে কোষগুলো কীভাবে তাদের কার্যকলাপ নির্ধারণ করে এবং জিনগুলো কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে কাজ করে। ফলে নতুন রোগ শনাক্তকরণ এবং থেরাপির নতুন গতি পেয়েছে, বিশেষ করে ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসায়। অ্যামব্রোস ও রাভকুনের এ মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার জিন নিয়ন্ত্রণের গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাদের কাজ যদিও এক ছোট গোলকৃমি থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু তা মানবজীবন, উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মাইক্রোআরএনএর বিভিন্ন সমস্যা ক্যান্সার, জন্মগত বধিরতা এবং চোখ ও হাড়ের নানা রোগের কারণ হতে পারে।

মাইক্রোআরএনএ গবেষণা জীবের নানা রকম কোষের মধ্যে সৃষ্ট জটিল পার্থক্যগুলোকে সুরাহা করছে, যা বহুকোষী প্রাণীদের জীবতত্ত্বকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করছে। প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়ার ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন পর্যায়ে কী প্রভাব ফেলে তা বোঝাতে এ আবিষ্কার বিদ্যমান চিকিৎসা এবং জিন থেরাপির ক্ষেত্রে নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। মাইক্রোআরএনএর বিকৃতি বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক রোগ এবং ক্যান্সারের মতো রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত তা আজ প্রমাণিত। জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাস্থের উন্নয়ন এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মাইক্রোআরএনএর প্রকৃত জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী জন জে হপফিল্ড এবং কানাডার বিজ্ঞানী জেফরি ই হিন্টন। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিংয়ের বিকাশের জন্য তাদের এ বিশ্ব স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তাদের এ যুগান্তকারী আবিষ্কার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিকাশ ঘটিয়ে মানব জীবন, সমাজ, প্রযুক্তি এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন একটি পরিচিত নাম, বিশেষ করে চ্যাটজিপিটি এবং গুগলের ভাষাগত এআই টুলের মাধ্যমে। তবে বিজ্ঞানীরা এর ব্যবহারকে আরো ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন, যেখানে তাদের বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনায় এআইয়ের সহায়তা রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মহাকাশের ছবি বিশ্লেষণ করে নতুন নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি শনাক্ত করতে সাহায্য করছে।

এআইয়ের একটি মূল উপাদান হলো মেশিন লার্নিং, যেখানে যন্ত্র উদাহরণ দেখে শিখে নেয় কীভাবে কাজ করতে হবে। এর সাধারণ সফটওয়্যারের সঙ্গে পার্থক্য হলো পারম্পরিক প্রোগ্রামে সব পদক্ষেপ নির্দেশ দিতে হয়, কিন্তু মেশিন লার্নিংয়ে যন্ত্র নিজে থেকেই শিখতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের শেখানোর একটি বিশেষ পদ্ধতি হলো কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা মানুষের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট গঠন অনুসরণ করে। মস্তিষ্কের কোষগুলো, নিউরন, কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে নোড হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি নোডের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত। নোডগুলোর মধ্যে যোগাযোগ শক্তিশালী অথবা দুর্বল হতে পারে, যা সংকেতের প্রবাহকে প্রভাবিত করে। নেটওয়ার্ককে প্রশিক্ষণ দিলে এটি সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।

জন হপফিল্ডের কাজ ছিল ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’ তৈরি করা, যা তথ্য সংরক্ষণ ও পুনর্গঠন করতে পারে। এ নেটওয়ার্ক প্যাটার্ন সংরক্ষণ করে এবং পুনর্নির্মাণে সক্ষম, যা পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত। অন্যদিকে জেফরি হিন্টন নতুন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন যাকে ‘বোলজম্যান মেশিন’ বলা হয়, যা তথ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আলাদা করতে সক্ষম। এটির জন্য তিনি পরিসংখ্যায়িক পদার্থবিদ্যা ব্যবহার করেন, যা কীভাবে একটি সিস্টেম কাজ করে তা বিশ্লেষণ করে।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এ বিজ্ঞানীরা আধুনিক এআইয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। তারা কথা বলা, ছবি আঁকা এবং বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগৎকে রূপায়ণ করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। নোবেল কমিটি এ কাজের গুরুত্ব তুলে ধরে বলে যে তাদের কাজ সমাজের কল্যাণে মূল্যবান এবং পদার্থবিজ্ঞানে নতুন উপন্যাস সৃষ্টি কিংবা বিদ্যমান উপাদান উন্নয়ন কার্যক্রমে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মেশিন লার্নিং এখন জীববিজ্ঞানে বিগ ডাটা বিশ্লেষণে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জীবনের কোডগুলো উদঘাটন বা রহস্য উন্মোচনে মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।

এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রোটিনের গাঠনিক এবং কার্যকারিতা ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া জানার বিপ্লব সৃষ্টিকারী কৌশল উদ্ভাবনের জন্য প্রদান করা হয়। মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড বেকার প্রোটিন ডিজাইনের জন্য পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেমিস হ্যাসাবিস ও মার্কিন বিজ্ঞানী জন এম জাম্পার প্রোটিনের গঠন অনুমানের জন্য বাকি অর্ধেক পুরস্কার অর্জন করেছেন।

প্রোটিন প্রাণের গাঠনিক একক, যা জীবনের মৌলিক রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। হরমোন, অ্যান্টিবডি ও টিস্যুর গাঠনিক একক হিসেবেও কাজ করে। এবারের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীরা প্রোটিনের গঠনের কোড বের করেছেন, যা ‘প্রোটিন হ্যাক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উনিশ শতকে বিজ্ঞানীরা প্রোটিনের গুরুত্ব জানতেন, কিন্তু প্রোটিন বিশ্লেষণের কার্যকর পদ্ধতি ১৯৫০-এর দশকে উদ্ভাবিত হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রথমবারের মতো এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করেন, যা ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জনের সূচনা করে।

২০০৩ সালে ডেভিড বেকার ফোরট্রান ভাষায় ‘রোজেটা’ নামক একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যা প্রোটিনের কাঠামো ধারণা করতে সক্ষম হয়। তার দল বিভিন্ন প্রোটিনের গঠনের উপাদানগুলো সংগ্রহ করে কাঙ্ক্ষিত প্রোটিনের নকশা তৈরি করে। তাদের গবেষণার ফলাফল দেখায় যে তার তৈরি কৃত্রিম প্রোটিন গাঠনিকভাবে নির্ভুল। ডেমিস হ্যাসাবিস এবং জন জাম্পার ২০২০ সালে ‘আলফাফোল্ড২’ নামের একটি এআই মডেল উদ্ভাবন করে প্রোটিন গঠন অনুমানের (prediction) ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল সিমুলেশন ব্যবহার করে প্রোটিনের গঠন শনাক্ত করার চেষ্টা হয়। এভাবে তারা ২০ কোটি প্রোটিনের গঠন অনুমান করতে সক্ষম হন। রসায়ন, জৈব রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ আবিষ্কার একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, যা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। প্রোটিন ছাড়া জীবন অসম্ভব এবং এবারের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষণার মাধ্যমে আমরা প্রোটিন তৈরি ও গঠনের কার্যকারিতা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সক্ষমতা অর্জন করেছি। রসায়নে ত্রিমাত্রিক (৩ডি) প্রোটিন গঠন ও আন্তঃক্রিয়া নতুন কম্পিউটেশনাল পদ্ধতি সাধারণত অণুবিজ্ঞান এবং চিকিৎসা গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলছে। জীব অণুর মধ্যে প্রোটিনের গঠন ও কাজ বোঝার মাধ্যমে আমরা আরো উন্নত ও কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কার এবং উন্নয়নে সক্ষম হচ্ছি। ফলে নতুন থেরাপি (কার্যকর ড্রাগ) উন্নয়ন এবং রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারছি । কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় ভ্যাকসিন আবিষ্কারসহ আধুনিক ড্রাগ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে তাদের আবিষ্কৃত কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গতিশীলতার প্রেক্ষাপটে, ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের তিনটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার আমাদের সমাজের প্রতিটি দিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আসছে। জীববিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজি—এ তিনটি ক্ষেত্রের গবেষণা শুধু বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং মানব সমাজের জন্যও দুরূহ ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে। পাল্টে দেবে মানব কর্মকাণ্ড, অর্থনীতিক ব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা ও পুরো সভ্যতার বিকাশ।

জীববিজ্ঞানের উন্নতি আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুনের মাইক্রোআরএনএ নিয়ে গবেষণা কোষের জিন নিয়ন্ত্রণের সঠিক প্রক্রিয়া অন্বেষণ করছে, যা ক্যান্সার ও অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় নতুন করে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিস্থাপন করবে। এ আবিষ্কারগুলো আমাদের নতুন রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার পদ্ধতির উন্নয়নে যুগান্তকারী বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতি সারা বিশ্বে প্রযুক্তিগত সেবা প্রদান ও তথ্য বিশ্লেষণে বিপ্লব আনতে সক্ষম হচ্ছে। জন হপফিল্ড ও জেফরি হিন্টনের গবেষণা আধুনিক কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের ভিত্তি তৈরি করেছে, যা আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের দক্ষতা বাড়াবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর করবে। ফলে আমাদের সামাজিক ও বাণিজ্যিক জীবনে প্রযুক্তির স্থান আরো মজবুত হবে। রসায়নে ডেভিড বেকার, ডেমিস হ্যাসাবিস ও জন জাম্পারের প্রোটিন গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। তারা জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা এবং নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক (৩ডি) গঠন ও কার্যক্রমের উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা নতুন ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম ব, যা মানব স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করবে। এ তিনটি আবিষ্কারের মধ্যে আন্তঃসংযোগ আমাদের সামাজিক উন্নয়ন ও মান উন্নতিতে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সুতরাং ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত আবিষ্কারগুলো আগামী দশকগুলোয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজের মধ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

আমরা যদি এ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির দিকে নজর দিই, তবে দেখতে পাব যে মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তবায়ন কৃষি, স্বাস্থ্য ও সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। এসব আবিষ্কার কৃষিতে জিন প্রকৌশল ও জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রতিরোধ ও রোগ নিরীক্ষণে সহায়তা করছে। ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব বিনির্মাণে এবারের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত আবিষ্কারগুলো বিশেষ অবদান রাখছে। স্বাস্থ্য খাতে, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার প্রক্রিয়ায় দক্ষতা বাড়ছে।

এবারের নোবেল বিজয়ীরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণার যে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন, তা সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে নিয়তই আরো নতুন নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন এগিয়ে চলছে। আমাদের দেশও এদিকে পিছিয়ে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতে আমার গবেষণা দল মেশিন লার্নিং ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে ২০১৬ সালে গমে মহামারী সৃষ্টিকারী ছত্রাক জীবাণুটির কৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলি এবং এটি কোথা থেকে এসেছিল তা নিখুঁতভাবে নির্ণয় করে। আমরা গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয়ে একটি স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি। আমরা কভিড-১৯ মহামারীকালে ভাইরাস জীবাণুর আক্রমণে মানব কোষের প্রতিরোধের কৌশল এবং নাসারন্ধ্রে বসবাসকারী উপকারী অণুজীবগুলোর মিথস্ক্রিয়ার কৌশল উদঘাটনে মেশিন লার্নিং ব্যবহার করেছি। এছাড়া গমে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জিন আরএমজি৮ জিনের এক্সপ্রেশনে সৃষ্ট প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন নির্ণয় এবং তা কীভাবে ছত্রাক জীবাণুর রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটিনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধিতা সৃষ্টি করে, তা নির্ণয়ে আমরা রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের উদ্ভাবিত কৌশল ব্যবহার করেছি। অধিকন্তু আমরা গমের ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য প্রাকৃতিক যৌগ ছত্রাকনাশক উদ্ভাবনে কম্পিউটেশনাল বায়োলজিক্যাল টুলস ব্যবহার করেছি। এছাড়া বারমাসী কাঁঠালের জীবন রহস্য এবং জাতীয় মাছ ইলিশের অন্ত্রে নতুন উপকারী প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া উদঘাটনেও আমরা কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ব্যবহার করেছি। শুধু কি আমাদের ল্যাব, এ দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মেশিন লার্নিং, কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ও মাইক্রোআরএনএ তাদের গবেষণায় ব্যবহার করে থাকেন। এসব বিষয়ে উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য দেশে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে টার্গেট-ওরিয়েন্টেড সমন্বিত গবেষণা এবং পর্যাপ্ত ফান্ডিং জোরদার করা বিশেষ প্রয়োজন।

উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যন্ত্র শেখা (মেশিন লার্নিং) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রয়োগের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, প্রযুক্তির প্রাপ্যতার অভাব ও উচ্চমূল্যের কারণে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো তৈরি করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব রয়েছে, যা এ প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাছাড়া ডেটা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার সমস্যা এবং নৈতিক দ্বন্দ্বও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবশেষে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং সমস্যা অনুযায়ী সঠিক সমাধান তৈরি করতে ব্যর্থতা এ প্রযুক্তির সফল প্রয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

পরিসমাপ্তিতে ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কারের এ তিনটি গবেষণা মানব জীবনের গুণগত পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন আশা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। আমরা আশা করি, বিশ্বজুড়ে গবেষক ও বিজ্ঞানীরা এ নতুন আবিষ্কারগুলোর মাধ্যমে মানবজাতিকে একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যকর টেকসই পরিবেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।

ড. তোফাজ্জল ইসলাম: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো ফুলব্রাইট, বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি

আরও