করোনা মহামারী চলাকালীন ভিয়েতনামে স্বাক্ষরিত হয়ে গেল নতুন একটি বাণিজ্য চুক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, এই জোটই হবে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য এলাকা। এই জোটের অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের চলতি শীর্ষ বৈঠকের শেষ দিনে ভিয়েতনামে ১৫ নভেম্বর ১৫টি দেশের মধ্যে বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। এটি ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপ’ (আরসিইপি) নামে পরিচিত। চুক্তিটি বিশ্ব বাণিজ্যে মৌলিক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আসিয়ান জোটের ১০টি দেশ ছাড়াও এই চুক্তিতে সই করছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে সেটি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এশিয়ার নতুন এই বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি বড় হবে।
জানা যায়, ২০১২ সালে প্রথম এই চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারপর আট বছর ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ ও উদ্যোগে এটি বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। মুক্ত বাণিজ্যের এই চুক্তিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের পথে একটি অভ্যুত্থান হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে তাদের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছে থাইল্যান্ডের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক ব্যাংকক পোস্ট।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্যের অধ্যাপক আলেকজান্ডার ক্যাপ্রিকে উদ্ধৃত করে ব্যাংকক পোস্ট বলেছে, এই জোট চীনকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালে মুক্ত বাণিজ্য থেকে আমেরিকা যেভাবে পিছিয়েছে, সেই শূন্যতা দখল করছে চীন। ২০১৬ সালে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে টিপিপি নামে যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করেছিল সেটি থেকে আমেরিকাকে বের করে নিয়ে যান তিনি।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, নতুন চুক্তিটি হলে ভবিষ্যতে এশিয়ায় বাণিজ্যের নীতি এবং শর্ত নিয়ন্ত্রণ করবে চীন। এশিয়ায় প্রধান দুই বাণিজ্য চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নেই, ফলে এশিয়ায় বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের শর্ত ও মান নির্ধারণের ক্ষমতার হাতবদল হবে এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে সে ভাবেই ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে।
জাপান-অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও চীনা আধিপত্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। তারপরও আরইসিপিতে যোগ দিতে তারা এখন আর পিছপা তো হচ্ছেই না বরং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে এ নিয়ে উৎসাহ বাড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী মোহামেদ আজমিন আলী বলেছেন, ‘আট বছর ধরে রক্ত, ঘাম আর চোখের পানি ঝরিয়ে আজ আরসিইপি সইয়ের জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছি।’
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, করোনা সংক্রমণের পরিণতিতে আসিয়ান জোটের দেশগুলো যে চরম অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই চুক্তিতে সই করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নুগেইন জুয়ান ফুচ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি খুশি যে আট বছর জটিল আলোচনা শেষে, আজ আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে আরসিইপি আলোচনা শেষ করি।’
শুল্ক কমাতে এবং ব্লকের মধ্যে পরিষেবা বাণিজ্য উন্মুক্ত করার চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং এটি এখন তাদের বদলে চীনের নেতৃত্বে বিকল্প বাণিজ্য উদ্যোগ হিসাবে দেখা হচ্ছে। সস্তা চীনা পণ্য দেশের বাজারে প্রবেশ করবে এই উদ্বেগে নিয়ে ভারত গত বছর এই চুক্তি থেকে সরে যায় এবং ১৫ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরে আয়োজিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানেও তারা যোগদান করা থেকে বিরত ছিল। তবে তারা চাইলে পরবর্তীতে এই জোটে যোগদান করতে পারবে।
এদিকে ভারত না থাকলেও এই চুক্তির সুবিধা ভোগ করবে ২১০ কোটি মানুষ। এর আওতায় প্রতিটি দেশের নিজস্ব নিয়ম অনুসরণ না করেও ব্লকের মধ্যে যে কোনও জায়গায় পণ্য রফতানি করার মাধ্যমে ব্যয় সংকোচন এবং দ্রুত পরিবহন করা যাবে। তৈরি পোশাক খাতের আরেক বড় রফতানিকারক দেশ ভিয়েতনাম রয়েছে এই চুক্তিতে। এই চুক্তির ফলে যেসব সুবিধা প্রতিযোগী দেশ পাবে তা থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে বলা যায়। বলা হয়ে থাকে এই শতাব্দীতে এশিয়া অঞ্চল বিশ্ব বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিবে। বিশ্ব বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে এই বাণিজ্য চুক্তিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করা দরকার।
আনোয়ার ফারুক তালুকদার
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক