আলোকপাত

সংস্কারের মাধ্যমে আর্থপ্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে

জনপ্রশাসনকে এখন আর শুধু প্রশাসনিক কাজে নিবেদিত নিষ্ঠাবান হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মূলত প্রশাসন ও অর্থ ব্যবস্থাপনার মিশেল, পারস্পরিক ও মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপার তার বিভিন্ন ডিসকোর্সে ফুটে ওঠে।

জনপ্রশাসনকে এখন আর শুধু প্রশাসনিক কাজে নিবেদিত নিষ্ঠাবান হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মূলত প্রশাসন ও অর্থ ব্যবস্থাপনার মিশেল, পারস্পরিক ও মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপার তার বিভিন্ন ডিসকোর্সে ফুটে ওঠে। সম্রাট অশোক বলি, আর মুহম্মদ বিন তুঘলক, শেরশাহ কিংবা মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের নবরত্ন সভার সদস্য বিদ্যা বাচস্পতি আবুল ফজল—রাজস্ব সংস্কারক টোডর মলের মতে, অর্থ ও প্রশাসনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি ছিল বলে তাদের সময়কার প্রশাসনিক সাফল্যের চেয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়আশয় প্রাধান্য পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১৭ জন অশ্বারোহীর আচমকা উপস্থিতিতে লক্ষ্মণ সেন পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার প্রাসাদ প্রশাসনের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড দুর্নীতি ও দুর্বলতার কারণে। তুঘলকের যেসব কর্মকাণ্ড তার ও তার প্রশাসনের ভরাডুবি ঘটিয়েছিল তা তো তার অত্যুৎসাহী পাগলামির উন্নয়ন ও রাজধানী দিল্লি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের দূরপ্রান্তে স্থানান্তরের অতি বিকেন্দ্রীকরণ ভূমিকার কারণে।

ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসন রাজস্ব আয় এবং সম্পদ লুণ্ঠনের অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত থাকলেও তারা আইন-শৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা ও জনকল্যাণ বা নাগরিক কল্যাণ কর্মকাণ্ডকে যতদূর সম্ভব পৃথকভাবে পরিপুষ্ট করতে পেরেছিল বলেই তারা ১৯০ বছর এ দেশে একটানা শাসন ও শোষণ চালাতে পেরেছিল। তারা আর যা-ই করুক, একদলীয় শাসন, এক দেশদর্শী প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেয়নি। জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ার নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, কিন্তু তাকেও গণহত্যার বিচারের সম্মুখীন করতে কসুর করেনি তদানীন্তন সরকার। পাকিস্তানের সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে বাংলাদেশকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছিল, সে তো পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক ভেদবুদ্ধি সঞ্চারিত বণ্টনবৈষম্য সৃষ্টি কাফফারার কারণে। অর্থাৎ যখন অর্থনীতি ও প্রশাসন বড্ড কাছাকাছি চলে এসেছে ভেদবুদ্ধির কারণে দুর্নীতি যখন দুঃশাসনের প্রতিভূ হয়েছে তখন। মালয়েশিয়ার সংসার থেকে সিঙ্গাপুরকে তিন তালাক দিয়ে বের করে দেয়া হয় টিংকু আবদুর রহমান এবং লি কুয়াংয়ের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েই। কারণ তারা অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিলেও গণবিরোধী প্রশাসনকে নাক গলাতে বা গলাগলি করতে দেয়নি।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক আমলের ‘ডেপুটি কমিশনার’ কিংবা ‘ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ বা ‘কালেক্টর’কে বাংলায় জেলা প্রশাসক বলা সাব্যস্ত হওয়ায় বোঝা যায় যে জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা তথা প্রশাসনিক গাম্ভীর্য বৃদ্ধির প্রয়াস বা অন্য সব দপ্তরের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হওয়ায় প্রশাসনে একটি এক দেশদর্শী উন্নয়নে নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সরাসরি দৃষ্টিতে আসার এবং পরস্পর স্বার্থ ভাগাভাগিতে কিংবা গদিনসীন রাখতে সাহায্য-সহযোগিতায় আসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশে প্রশাসন সংস্কার প্রয়াস প্রচেষ্টাকে ১৯৭২-৯০ ও ১৯৯১-২০০০ দুই পর্বে ভাগ করলে যা পাওয়া যায়—

১৯৭২-৯০ পর্বে প্রশাসনিক সংস্কার

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস রিঅর্গানাইজিং কমিটি (এএসআরসি), ১৯৭২, প্রধান মোজাফফর এ চৌধুরী (ফোকাস: সার্ভিস স্ট্রাকচার)

পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), ১৯৭৬ (১৯৭৭), নেতৃত্বে এমএ রশিদ (ফোকাস: সার্ভিস স্ট্রাকচার অ্যান্ড পে ইস্যুজ)

মার্শাল ল কমিটি ফর এক্সামিনিং অর্গানাইজেশনাল সেটআপ অব মিনিস্ট্রিজ/ডিভিশনস/ডিরেক্টরেটস অ্যান্ড আদার অর্গানাইজেশনস (এমএলসি), ১৯৮২, প্রধান ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক (ফোকাস: অর্গানাইজেশন অ্যান্ড র‍্যাশনালাইজেশন অব ম্যানপাওয়ার ইন দ্য পাবলিক সেক্টর অর্গানাইজেশনস)

১৯৯১-২০২৪ পর্বে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন:

ক্যাবিনেট কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্ম ১৯৯৩ (১৯৯৫), প্রধান কর্নেল (অব.) ওয়ালি আহমেদ, এমপি (ফোকাস: রিকগনিশন অ্যান্ড রিভিউ দ্য রিপোর্টস অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেক্টর স্টাডি (ইউএনডিপি) অ্যান্ড টুওয়ার্ডস বেটার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ)

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিঅর্গানাইজেশন কমিটি (এআরসি), ১৯৯৩ (১৯৯৬); প্রধান নুরুন নবী চৌধুরী (ফোকাস: স্ট্রাকচার অ্যান্ড র‍্যাশনালাইজেশন অব ম্যানপাওয়ার অ্যাকসেস মিনিস্ট্রিজ/ডিপার্টমেন্টস/ ডিরেক্টরস)

পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিটি (পিএআরসি), ১৯৯৭ (২০০০); এটিএম শামছুল হকের নেতৃত্বে (ফোকাস: অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য লাইট অব নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট)

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, ২০২৪। কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। একটি জনমুখী, দক্ষ জবাবদিহিতামূলক ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন দাখিল এ কমিশনের দায়িত্ব।

বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে, ১৯৮৪ সালে (এনাম কমিটি) ও ১৯৯৮ সালে (সামসুল হক কমিটি) প্রশাসক সংস্কারের প্রতিবেদন প্রণয়ন ও পেশ করা হয়েছিল। ১৯৭৩-৮৪ সময়ে প্রশাসনিক সংস্কার ১৯৭২ ও ১৯৭৬ সালে গৃহীত সরকারি/উপদেষ্টা পরিষদে, প্রতিবেদনে সুপারিশকৃত সংস্কার অনুসৃত হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে এনাম কমিটির সংস্কার ছিল মূলত লোকবল প্রমিতকরণ, মন্ত্রণালয়গুলোর সাংগঠনিক স্তম্ভ নির্মাণ ও প্রক্রিয়াকরণের কাজ। এটি যথাযথভাবে অনুসৃত হয়েছিল ১৯৯৯-২০০০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু শামসুল হক কমিটির না প্রতিবেদন না কার্যক্রম বা তার দর্শন সুপারিশ ও দর্শন পরবর্তীকালে পুরোপুরি অনুসরণের কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।

১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ গঠন, যেখানে ঊর্ধ্বতন সিভিল সার্ভেন্টদের সশরীরে ও ভাবগতভাবে উপস্থিতির মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের সংঘবদ্ধ শক্তির (স্পিরিট ডি কোর) ‘ঘরের বাহির’ হওয়ার সংস্কৃতি উদ্ভব ঘটে। এখান থেকে প্রশাসন দলীয়করণের খপ্পরে পড়া শুরু হয়। এখান থেকেই শুরু হয় একেক সরকারের আমলে হিরো ও জিরোকরণ প্রক্রিয়া। ১৯৯৬-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থী হওয়ার প্রতিযোগিতা ও পরস্পরের অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০১-০৬ সালে বিরোধী পক্ষের কর্মকর্তাদের ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অপসারণ-অবসর দেয়ার পরিমাণ আকার ও ব্যাপ্তি বেড়ে যায়। ২০০৯-২৪ সালে একটানা ১৫ বছর এক সরকার ক্ষমতায় থাকায় এ সময় প্রায় ১ হাজার ৪০০ উচ্চমধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বিপক্ষীয় ট্যাগ লাগিয়ে ওএসডি/অবসর প্রদান করা হয়। বিরোধী পক্ষীয় ট্যাগ লাগিয়ে ওএসডি করে অফিসার বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়া হয় এবং ১০-১১ বছর চাকরিকাল শেষ করে তারা অবসরে যান। এ সময়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত রাখা হয়। জনপ্রশাসনে মেধাশূন্য করার ক্ষেত্রে সুকৌশলে প্রণীত এ প্রথা সম্ভবত ইতিহাসে বিরল। ওএসডি, বাধ্যতামূলক অবসর ও পদোন্নতিবঞ্চিত করে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে অফিসারদের মুহুর্মুহু পদোন্নতি পুনর্বাসন করা হয়। স্থলাভিষিক্তকরণসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সব ঊর্ধ্বতন পদগুলোর ক্ষমতা চার-পাঁচ গুণ বাড়িয়ে পদোন্নতির পথ সুগম করা হয়। কিন্তু কাজের পরিধি একই থাকায় অধিকাংশ অফিসারকে ইনসিটো করা হয়। উপসচিবের টেবিলে যুগ্ম সচিব এমনকি অতিরিক্ত সচিবকে বসে কাজ করতে হয়। কাজের মান না বাড়লেও তাদের শুদ্ধাচার ও সুশাসন পদক দিয়ে হালাল করা হয়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাজ ও দায়িত্ব রুলস অব বিজনেসে লেখা থাকলেও প্রতি বছর সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোর মধ্যে ঘটা করে নতুন কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব বিভাগীয় কমিশনারদের সেরা কর্মসম্পাদনকারী হিসেবে পদক ও সনদ প্রদান করা হয়। অনুগত পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের পুলিশ পদক বিতরণের হিড়িক পড়ে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি দিয়ে অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাবিহীন দুর্নীতি সহায়তাকারী মন্ত্রণালয় প্রধানদের ২০১২ সালের পর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বিদেশী ভালো/লোভনীয় পদে এমনকি তাদের সংসদে ঠাঁই দিয়ে মন্ত্রী মর্যাদায় আনার লোভ বিতরণ করা হয়। একদিকে ট্যাগ লাগিয়ে অফিসারদের ওএসডি করে কর্মরতদের সামনে অযৌক্তিকভাবে হলেও সরকারের আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। জনপ্রশাসনের মধ্যে আনুগত্য প্রদর্শন, অন্ধ অনুসরণ ও চাটুকারিতার এক অদ্ভুত অভিনব ও অদম্য সংস্কৃতি শুরু বা চালু হয়, যা জনপ্রশাসনের ভাবগাম্ভীর্য, নিরপেক্ষতা ও নিষ্ঠাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে। খোদ জনপ্রশাসনে বিভেদ, বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে।

পররাষ্ট্র ক্যাডারের মেধাবী কর্মকর্তাদের মিশনে যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকরণে যোগ্যতা ও দক্ষতা বিচার-বিশ্লেষণ ও সমীক্ষার সুযোগ থাকা উচিত। দেশের ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধানের জন্য সনদ বা ডিগ্রি অর্জনে, চেয়ার ও আবক্ষ প্রতিমূর্তি স্থাপনে তাদের মূল্যবান সময় ব্যয়িত হওয়া উচিত নয়। দূতাবাসের কূটনীতিকরা যেন দৈশিক হন, সেখানে আমি অমুকের লোক, তুমি অমুকের লোক—এ ধরনের বিভেদ-বিভাজনের শিকার না হয়। তাদের পদায়ন ও প্রস্থান হবে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে।

কর্মকর্তারা তাদের ওপর ব্যক্তিগত প্রভাব অনুগতকরণের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা সৃষ্টি যাতে না হয় সেদিকে বা তার পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দূতাবাসে লেবার, কর্মাশিয়াল ও ইকোনমিক উইংয়ের কর্মকর্তাদের যারা আছেন তাদের নিজ নিজ ক্যাডার বা মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ হলেও তাদের বাজেট দূতাবাসের প্রধান যিনি প্রায়ই পররাষ্ট্র ক্যাডার কিংবা চুক্তিভিত্তিতে নিয়োজিত হন। ফলে সেখানে প্রায় আন্তঃদ্বন্দ্ব ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও কর্মকাণ্ডের সাম্প্রতিক ফোকাস কূটনীতির পরিবর্তে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উত্তরণে জোর তাগিদ থাকা উচিত। পররাষ্ট্র দপ্তরকে সেভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীতা দেখা দেবে।

নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগকে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ দেখভালের সাংবিধানিক দায়িত্বে সচেতন হওয়ার অবকাশ থাকবে। অডিটর জেনারেলের অনুমোদন ছাড়া নতুন নতুন ব্যয়ের খাত খোলা এবং এক খাতের টাকা অন্য খাতের হস্তান্তরের সুযোগ নেই। প্রজাতন্ত্রের যেকোনো খাত বা বিষয়ে নিরীক্ষার দায়িত্ব সাংবিধানিক পদাধিকারী সিঅ্যান্ডএজির। তাই যদি হবে তাহলে গত ১৫ বছরে সংঘটিত সম্পাদিত ভূরিভূরি আর্থিক অনিয়মের ওপর অডিট বিভাগের পর্যবেক্ষণ দেশবাসী জানতে পারেনি কেন? সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে অডিট আপত্তি উপস্থাপনের সুদীর্ঘ সময় নেয়া এবং বিরোধী দলশূন্য সংসদের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা উপস্থাপনের এ দারুণ দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পাবলিক মানি যথেচ্ছাচার ও স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারের পথ সুগম করেছে। আদর্শিক ও তাত্ত্বিকভাবে অডিট বিভাগকে অবশ্যই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হতে হলে অডিট দপ্তর সরকারের রাজনৈতিক প্রচারণার কার্যালয়ে পরিণত হতে পারে না। সাংবিধানিক পদে আসীন হওয়ার ঝোলানো মুলা ধরতে গিয়ে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা গোটা অফিসকে রাজনৈতিক কার্যালয় বানাতে ব্যস্ত হলে বা থাকলে সেটি হবে সংবিধান, দেশ ও জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ।

অডিট বিভাগে দপ্তর-পরিদপ্তর ও লোকবলের সংখ্যা বেড়েছে বটে, কিন্তু পাবলিক মানি আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা, কৃচ্ছ্রসাধন ও ন্যায়নীতিনির্ভরতার পরিবেশ হয়েছে বিপন্ন। আর্থপ্রশাসনিক সংস্কারে অডিট বিভাগ, সেক্টর করপোরেশন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ বা রেগুলেটরকে (বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, ইআরডি, প্ল্যানিং কমিশন) ঢেলে সাজাতে হবে, কর্ম ও দায়িত্বনিষ্ঠ করার বিকল্প নেই। রেগুলেটরি বডি যেমন সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, বেজা, বেপজাকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে পোষক প্রতিষ্ঠান হতে আরো মজবুত ও সংস্কার করার আবশ্যকতা রয়েছে। সরাসরি সরকারপ্রধানের অফিসের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এ অফিসগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা পীড়াদায়ক। বেসরকারি বিনিয়োগ দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই সরকারের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গড়ে বেসরকারি খাতের জন্য প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা সমীচীন হয় না।

আর্থপ্রশাসনিক ক্ষেত্র বা বিভাগে পেশাদার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী কর্মকর্তাদের পোস্টিং হওয়া উচিত, যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড, অডিট ডিপার্টমেন্ট। এসব ক্ষেত্রে নিজ নিজ সার্ভিস বা বিষয়ে পড়াশোনা কিংবা বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনকারীদের পদায়ন হলে তারা অবদান রাখতে সক্ষম হন।

প্রশাসনে মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রবেশ এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এমন একটা ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে যেটা জাপানে প্রযোজ্য আছে। সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা শীর্ষস্থানীয় বা ভালো রেজাল্ট করেছে তাদের আগে থেকেই এ কনসার্ন মন্ত্রণালয় বা ডিপার্টমেন্ট, প্রাইভেট সেক্টরে যারা আগে থেকেই যেমন এগ্রিকালচারের এগ্রিকালচার বিষয়ক, স্বাস্থ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, আইন আইনের যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তাদের আগে থেকেই বলা থাকে যে যাদের ভালো রেজাল্ট হয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ওই মন্ত্রণালয়ে বা দপ্তরে যোগ দেবে এবং ওই মন্ত্রণালয়ে থাকার ব্যবস্থা, তাদের অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগে বদলির কোনো দরকার নেই। তারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় বা বিভাগে থেকেই ওপরে উঠবে। এখানেই তাদের দক্ষতা বিকাশ হবে। আমাদের দেশে যেটা হয় সেটা হলো, পড়াশোনা করে এক বিষয়ে চাকরি হয় অন্য মন্ত্রণালয়ে, পরের বছর দেখা যায় তাকে আরেক মন্ত্রণালয়ে দেয়া হলো। এতে দেখা যায় কোনো দক্ষতা গড়ে ওঠে না। আর জাপানে সিস্টেমটা হচ্ছে, ইউনির্ভাসিটির সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের আগে থেকেই টার্গেট করা হয়। বলা হয়, তুমি এগ্রিকালচার মিনিস্ট্রির জন্য, তুমি হেলথ মিনিস্ট্রির জন্য। আগে থেকেই সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকে। যাদের ভালো রেজাল্ট হয় তাদের সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, বিসিএস হোক আর যা হোক সে সেটা দিয়ে ওখানে সার্ভিসে যোগ দেয়। ওই মন্ত্রণালয়ে প্রথমে তার পোস্টিং হবে এবং তারপর সে ওখান থেকেই ধাপে ধাপে এগিয়ে উঠবে এবং সে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি পরামর্শক বা উপদেষ্টা কমিটি থাকতে পারে। এ কমিটিতে বেসরকারি ব্যবসায়ী নেতা, সুশীল সমাজ প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, পেশাদার ব্যক্তি, সাবেক কর্মকর্তারা থাকতে পারেন। বছরে অন্তত চারবার এ কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নীতিগত বিষয় পরামর্শ দিতে পারবেন। জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ বা অঞ্চলে এ ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান।

প্রশাসনের ভেতরে সুশাসন, দক্ষতা, শুদ্ধতা—এগুলোর ব্যাপারে প্রথম থেকেই তাদের সম্পদ বিবরণী, এসিআর দেয়ার ব্যাপারগুলোয় প্রযোজ্য সংস্কার আনা যায়। তাতে যথাযথ রিপোর্ট হয়, সেটার ভিত্তিতেই তাদের পদোন্নতি বা অন্য ব্যাপারগুলো ফলোআপ করা হয়। এটা এ রকম যেন না হয়—এক পর্যায়ে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত পছন্দ বা কোনো দলের পছন্দ কিংবা কারো দ্বারা বদলি করা অথবা কোনো ব্যাপার না হয়। প্রত্যেকের যার যার মন্ত্রণালয় তার নিজস্ব পদোন্নতি, বদলি, নিয়োগ এগুলোর পদ্ধতি খুব স্পষ্ট থাকতে হবে। এছাড়া জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে একটা সমন্বয় থাকবে। সেখানে জেলা প্রশাসক অথবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যরা তার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন, তার অধীনে কাজ করবেন কিন্তু তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন না। তাদের সমন্বয়ক হিসেবে তাদের উপদেশ দেবেন, সেজন্য উন্নয়ন কমিটি থাকতে পারে, সে কমিটিতে তারা যথাযথ অবদান রাখবেন। সব বিভাগের সব কর্মকর্তার মধ্যে যেন কোনো বৈষম্যবোধ, স্বজনপ্রীতি, কোনো ধরনের কষ্ট বা মনঃকষ্ট অথবা অমুকের চেয়ে অমুক ভালো—এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভব যেন না হয়।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান

আরও