আমি ১৯৯২ সালে একটি অস্ট্রেলীয় ব্যাংকের পাবলিক সেক্টর হেড হিসেবে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ তথা টিসিবির রিলেশনশিপ ম্যানেজার বা সম্পর্ক ব্যবস্থাপক ছিলাম। পত্রিকায় একবার শিরোনাম হয়েছিল—‘বাজারে সিমেন্ট সংকট, নির্মাণ শিল্প হুমকির মুখে’। সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করতে টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপীয় একটি দেশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে সর্বনিম্ন দরদাতার মাধ্যমে ১ লাখ টন সিমেন্ট আমদানির উদ্যোগ নিয়েছিল। দুঃখজনক ব্যাপার ছিল বিভিন্ন কারণে সেই সর্বনিম্ন দরদাতা শেষ পর্যন্ত সিমেন্ট জোগান দিতে পারেননি। তাদের স্থানীয় এজেন্টের বিরুদ্ধে টিসিবি আদালতে মামলাও রুজু করেছিল। এই কায়দায় টিসিবি বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, ওষুধ এমনকি ইস্পাত শিল্পের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ইনগট (কাঁচামাল) আনার জন্যও নির্দেশিত হয়েছিল। কিন্তু টিসিবির বাজারে হস্তক্ষেপের মতো সনাতনী উদ্যোগ গেল প্রায় ৪০-৪৫ বছরে কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। পারবেও না বলেই অনেকে এখন বিশ্বাস করেন।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে গঠিত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নিকট অতীতে কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে উদাহরণ নেই। আলু-পেঁয়াজ, এমনকি রমজানে দাম বাড়ে এমন পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতি, দক্ষ জনবল, মূলধনের অভাবসহ নানা কারণেও দুর্বল হয়ে পড়ছে একসময়ের কিছুটা কার্যকর প্রতিষ্ঠানটি। সংস্থাটিকে গতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও বাস্তবায়ন হয়নি। পত্রিকান্তরে জেনেছি টিসিবি কর্মকর্তাদের অভিযোগ, দুই ধরনের জটিলতার কারণে টিসিবিকে শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। প্রথমত, পণ্য কেনায় টিসিবির হাতে যথেষ্ট তহবিল নেই। দ্বিতীয়ত, সরাসরি পণ্য আমদানি ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে আইনি বাধা। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলধন ও জনবল সংকট প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনবলের অভাবে টিসিবির যে আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে, তাও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। একই সঙ্গে সংস্কারের অভাবে নিজস্ব ও ভাড়া করা গুদামগুলো দিন দিন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে। মানসম্পন্ন পণ্য কিনে এসব গুদামে রাখলেই তা মানহীন হয়ে পড়ছে। কারো অজানা নয়, টিসিবির ভৌত অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাসহ বেশকিছু অসুবিধার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজারে তারা প্রতিযোগিতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
টিসিবিকে শক্তিশালী করতে সরকারি ক্রয়নীতির আওতামুক্ত রাখা, অগ্রিম আয়কর ও ভ্যাটমুক্ত রাখাসহ কয়েক দফা সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গঠিত উপকমিটি। প্রতিবেদনে তিনটি নতুন গুদাম, একটি কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, একটি জরাজীর্ণ গুদাম সংস্কারসহ তিনটি স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। সরকারি কাউন্টার গ্যারান্টি সুবিধা দেয়া এবং আপত্কালীন খাদ্য সংকটে টিসিবির কেনা পণ্যের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ, বিপণনক্ষমতা বাড়াতে ও গুদাম ভাড়া কমাতে সাতটি জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ এবং সংস্কারের পরামর্শও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবি ক্রমেই গুরুত্ব হারাতে বসেছে বা সত্যি করে বললে হারিয়ে ফেলেছে।
বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থা এখন অনেক বড়। লাখ লাখ কোটি টাকার পণ্যবাজার বাংলাদেশে। এ বাজার চাহিদায় সীমিত মজুদ দিয়ে কিছুই হবে না। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন বাজার নিয়ন্ত্রণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে টিসিবির একটা নিজস্ব মূলধন থাকা দরকার। এ মূলধন পেলে টিসিবি স্বাধীনভাবে পণ্য ক্রয় ও ভোক্তা পর্যায়ে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়তো সক্ষম হতো।
নব্বইয়ের দশকে মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর বেসরকারি খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে টিসিবির কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত হয়ে যায়। তবে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলেও এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকারের ভূমিকা রাখা উচিত বলে অনেক নীতিনির্ধারক এখনো মনে করেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোট চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে কোনো অসাধু চক্র অযৌক্তিকভাবে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি বা দাম বাড়াতে না পারে, তা দেখাও সরকারের দায়িত্ব বলে অনেকের বিশ্বাস। তাদের মতে, টিসিবি হলো সরকারের সেই ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা যায়।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন বাজার নিয়ন্ত্রণে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জন্য টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তা নির্দিষ্ট করা জরুরি। প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনপূর্বক একে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা প্রয়োজন। বাজার সঠিকভাবে কাজ না করলে টিসিবিকে ভূমিকা রাখার মতো সক্ষমতা প্রদান করতে হবে। নতুবা সরকারের অর্থের অপচয়ই শুধু হবে, জনগণ কোনো সুফল পাবে না। টিসিবিতে সমস্যার অন্ত নেই। এত সমস্যা নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করা এবং তা থেকে জনগণের সুফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ পরিস্থিতিতে টিসিবির মজুদ সক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসহ পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যাপারটি আবারো হয়তো ভেবে দেখা যেতে পারে।
তবে ব্যক্তি উদ্যোগের এই যুগে টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান খুব কাজের হবে বলেও মনে হয় না। আমাদের মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ বা পারটেক্স গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে টিসিবির মতো ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাজারে হস্তক্ষেপও সম্ভব নয়। যাতায়াত ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে কেজিপ্রতি ৫-১৫ টাকা সাশ্রয়ের জন্য অনেক দূরে যেতে বা লাইনে দাঁড়াতে বেশির ভাগ লোকজনই রাজি নয়। উপরন্তু, টিসিবিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি কোষাগারের ব্যয় বিবেচনায় নিলে এই শ্বেতহস্তীকে টিকিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজন নিয়মিত বাজার মনিটরিং আর বাজারে কার্যরত বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ। একটি বৃহৎ ও নিত্য পরিবর্তনশীল ভোগ্যপণ্যের বাজারে সামান্য আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রয় ক্ষমতার সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি আমাদের মতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখার কথাও নয়।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক