বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অন্যতম। ভোট চুরি, দুর্নীতি ও ত্রাণ আত্মসাতের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে এবং জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় সরকারের আগে নির্বাচিত, ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত সব প্রতিনিধির অপসারণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অপকর্মে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে এ প্রতিনিধিরা নিজেরাই আত্মগোপনে চলে যান। ফলে জনগণ নিয়মিত সরকারি সেবা পেতে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন অস্থায়ীভাবে স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করছে। তবে প্রশাসকদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি এ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারি সেবা প্রদানের মান দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। গত ৮ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন। এর ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।’
বর্তমানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর কেবল জাতীয় নির্বাচন নয়, বরং সব ক্ষেত্রে একটি ন্যূনতম সংস্কার সাধনের প্রত্যাশা রয়েছে সাধারণ মানুষের। তবে এ মুহূর্তে স্থানীয় সরকার না থাকায় সরকারের একার পক্ষে সব ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করা সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকার ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে সরকার নিজেদের সংস্কার বাস্তবায়নকে সফল করার জন্য স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে বলে ধারণা করা যায়।
কয়েকদিনের মধ্যে অধিকাংশ কমিশনের সংস্কার রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা। এ রিপোর্টগুলোর ভিত্তিতে সরকার যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করবে, তখন স্থানীয় সরকার ছাড়া সেই সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কারণ স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকার ও জনগণের মাঝে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে সংস্কারে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার না থাকায় জনগণ সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে নানা ধরনের কষ্টকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগে যে সেবা এক-দুদিনের মধ্যেই পাওয়া যেত, বর্তমানে সেই সেবা পেতে সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হচ্ছে এবং এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। ফলে সরকারের কার্যক্ষমতা নিয়ে মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। শুধু সরকারি সেবা প্রদানই নয়, স্থানীয় সরকারের মেম্বার, চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা এলাকার সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সেক্ষেত্রে সরকার ধারণা করছে, যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করা যায় তবে তা দেশকে অনেকটা স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের জুনের মধ্যে যেহেতু একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তারা হয়তো একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার কথা ভাবছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্তমান সরকারের নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা প্রদর্শনের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদ্যমান ভুলত্রুটি শনাক্ত ও তা সংশোধনের একটি সুযোগ তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে সরকার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আর কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, সে বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে।
আরেকটি যে কারণে সরকার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে, তা হলো জাতীয় নির্বাচনের পর দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কতটা ধারণ করতে পারবে এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বলে ছাত্ররা মনে করছেন। কেননা নির্বাচিত সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই এখন পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে নানাভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন না করে তবে চব্বিশের অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা স্থানীয় সরকার কাঠামোয় বাস্তবায়ন হয়তো অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করাকে অধিক যুক্তিযুক্ত বলে অনেকেই, বিশেষত ছাত্র প্রতিনিধিরা মনে করছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা
তবে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো ঐতিহাসিকভাবে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার এবং দল গঠনের চেষ্টা করেছে।
জেনারেল আইয়ুব খান প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের নামে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলে সামরিক সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি জাতীয় নির্বাচন না দিয়ে বরং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি বেসিক ডেমোক্রেসি মডেল প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে ৭৩ হাজার বেসিক ডেমোক্র্যাট স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে এ প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মূলত এ পদ্ধতি স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিদের ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার একটি কৌশল ছিল।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা আগের সামরিক শাসকদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন ও জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৬ সালে ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ’ জারি করে তিন স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন এবং তার দলকে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন।
অন্যদিকে জেনারেল এরশাদও ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৮২ সালেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেন এবং ওই বছরই ‘থানা কাউন্সিল এবং থানা প্রশাসন পুনর্গঠন, অধ্যাদেশ’ জারি করেন। তার শাসনামলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী ছিল, যার ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হয়। তিনি ১৯৮৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করেন, যা তার দল জাতীয় পার্টিকে জনগণের কাছে পরিচিত করতে সহায়তা করে। এর এক বছর পর ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেন, যা তার দলকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে।
ফলে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, বর্তমান সরকারও কিংস পার্টি গঠন করার জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকার জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সীমা উল্লেখ করেছে, তবু রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে আগ্রহের সঙ্গে দেখছে না বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো আরো আশঙ্কা করছে যে যদি সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করে, তবে জাতীয় নির্বাচনও পিছিয়ে যেতে পারে, যা গণতন্ত্রের পথে একটি বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
সরকারের করণীয়
তবে সরকার যদি আন্তরিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে চায়, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পুনরায় সংলাপ আয়োজন করে এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাতে হবে কেন তারা এ মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে চায়। এতে দেশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কী কী সুবিধা হতে পারে এবং কীভাবে এটি একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।
পাশাপাশি সরকারকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করে সাজাতে হবে, যেন এটি কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত না করে। এতে সব অংশীজনই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুফল পেতে পারেন। একই সঙ্গে সরকারকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দিকেও গুরুত্ব দেয়া উচিত, যাতে শিক্ষাঙ্গনে সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায় এবং মব জাস্টিস প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
সরকারকে এটাও মনে রাখতে হবে যে বর্তমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় প্রশাসন ও সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, যার ফলে জনগণ পর্যাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর আইনগত কাঠামো পুনরায় সংস্কার করেই নির্বাচনের দিকে যাওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করছেন।
পাশাপাশি একটি বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও সরকারকে খুব সতর্ক থাকতে হবে যে এ স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি আয়োজন করা হয়, তবে এর মাধ্যমে যেন পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেতাত্মারা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। এটি নিশ্চিত করতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও আন্তরিক সহযোগিতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বোপরি একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল একাত্তর ও চব্বিশের অন্যতম প্রধান দাবি। এ বিষয়ে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপকে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না করে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তাহলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এটি একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
সৈয়দা লাসনা কবীর: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল: গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়