পর্যালোচনা

পরিসংখ্যানের রাজনৈতিক অর্থনীতি

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক অকালপ্রয়াত সহপাঠী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন সহকারী প্রধান আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একটি প্রকল্পের মাঠ জরিপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার কাছেই শুনেছি তত্কালীন মাঠ জরিপে সংগৃহীত ডাটা বা উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি আর মানের কথা। পরবর্তী সময়ে লন্ডন বিজনেস স্কুলে অধ্যাপক এন্থনি হুরিহান বলেছিলেন, ‘ইনপুটের মান খারাপ হলে আউটপুটের মান খারাপ হতে বাধ্য।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক অকালপ্রয়াত সহপাঠী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন সহকারী প্রধান আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একটি প্রকল্পের মাঠ জরিপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার কাছেই শুনেছি তত্কালীন মাঠ জরিপে সংগৃহীত ডাটা বা উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি আর মানের কথা। পরবর্তী সময়ে লন্ডন বিজনেস স্কুলে অধ্যাপক এন্থনি হুরিহান বলেছিলেন, ইনপুটের মান খারাপ হলে আউটপুটের মান খারাপ হতে বাধ্য।

ইদানীং বাংলাদেশে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (বিবিএস) কর্তৃক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে খামখেয়ালিপনা বা ইংরেজিতে যাকে বলে ডাটা মেসেজিং নিয়ে আমি খুব একটা আশ্চর্য হইনি। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী শওকত আজিজের সময়ও একবার ধরনের বিতর্ক উঠেছিল। তবে আমার আশ্চর্য লেগেছে, এর কী দরকার ছিল? আইএমএফের হিসাব বা প্রাক্কলন মতে, প্রবৃদ্ধি যদি দশমিক শতাংশ হতো, তাতেই মন্দ কী? অনেক দেশেই এই করোনাকালে অর্থনীতি সংকুচিতও হয়ে গেছে।

গত কয়েক দশকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি আর্থসামাজিক নানা সূচকে প্রভূত উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশকে এখন বলা হচ্ছে উন্নয়ন মিরাকল বা ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স এসবই প্রতিফলিত হয় তথ্যে। যদিও সরকারের যেসব সংস্থা এসব তথ্য-পরিসংখ্যান তৈরি করে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা কাজের গুণগত মান নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এতে বরং আস্থা হারাচ্ছে দেশের পরিসংখ্যানের মান, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিসংখ্যান পেশা। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন সময়ে শুমারি, খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) পরিসংখ্যানগত তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এসব কাজে তথ্যের উৎস পদ্ধতিগত বিষয়গুলো ভালোমতো অনুসরণ করা হলেও ঠিক সময়ে তথ্য প্রকাশে দুর্বলতা রয়েছে সংস্থাটির।

এদিকে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই)-সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই অমিল হতে দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্যের। আবার সরকারি দুটি সংস্থার মধ্যেও একই তথ্য নিয়ে দুই ধরনের উপস্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে রফতানি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।

প্রশ্ন উঠেছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের তথ্য নিয়েও। ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে গড়ে প্রতি মাসে এডিপি ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের শেষ মাসে অর্থাৎ জুনে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), যা মোট ব্যয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ।

শ্রমশক্তি দেশের কর্মসংস্থানের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এবং নীতি সিদ্ধান্ত নিতে প্রকাশ করা হয় লেবার ফোর্স সার্ভে। ২০১৩ সালে যে জরিপ করা হয়, তার ফল প্রকাশ পায় ২০১৫ সালে। সর্বশেষ এটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। এতে মূলত ২০১৬-১৭ সালের তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর গত তিন বছরে কোনো শ্রম জরিপই প্রকাশ পায়নি।

রাজস্ব আয় নিয়েও বেশকিছু তথ্যগত পার্থক্য দেখা দিয়েছিল (শুনেছি এখনো আছে) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। আবার সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের (টোটাল ডমেস্টিক বরোয়িং) পরিমাণ নিয়ে তথ্যগত পার্থক্য দেখা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ বিভাগের মধ্যে। মুদ্রানীতির তথ্য প্রণয়নের ক্ষেত্রে উৎস পদ্ধতি এখনো ভালো মানের হলেও সময়মতো প্রকাশের বিষয়ে রয়েছে দুর্বলতা।

সরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানগত দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোরেও। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা আরো তীব্র হয়েছে। দেশের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০১৪ সালে। সে বছরে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে প্রায় ৮০ পয়েন্ট পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্কোর পয়েন্ট কমে ৬২ দশমিক - দাঁড়িয়েছে। তথ্যসূত্র উৎস, পদ্ধতি বা কর্মকৌশল এবং সময়কাল তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এই মূল্যায়ন করে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে ২৫টি মানদণ্ডের বিপরীতে গড় স্কোর নির্ধারণ করে সংস্থাটি। সূচকটি তৈরিতে দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রের তথ্যের সরবরাহ পদ্ধতিগত এবং সময় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সূচক, ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট বা জিডিপির হিসাব, লেবার ফোর্স সার্ভে, বাণিজ্য (আমদানি-রফতানি) এইচআইইএস, দরিদ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজস্ব মুদ্রানীতিবিষয়ক তথ্য, বাজেট, ব্যালান্স অব পেমেন্ট, সব বিভাগের আর্থসামাজিক তথ্য।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক বিবেচনায় মূলত তথ্যের উৎস দুর্বলতা, পদ্ধতি বা মান নির্ধারণে দুর্বলতা, নির্ভুলতা নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করতে না পারার কারণেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তথ্যের মান দুর্বল হচ্ছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের ঠিক ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে ভারতের পয়েন্ট ছিল ৭৫ দশমিক ৬। এছাড়া ভুটান ৬৩ দশমিক , শ্রীলংকা ৮১ দশমিক , পাকিস্তান ৭১ দশমিক , নেপাল ৭৪ দশমিক আফগানিস্তান ৫০ পয়েন্ট পেয়েছে। সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় ৬৯ দশমিক ১। আবার বাংলাদেশের তানজানিয়ার পয়েন্ট প্রায় সমান। উল্লেখ্য, তানজানিয়ায় আইন করে জিডিপির তথ্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো জরিপ বা গবেষণার জন্য যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, সঠিকভাবে প্রশ্নপত্র তৈরি, তথ্য সংগ্রহকারীদের নিয়োজন, প্রশিক্ষণ, সুপারভিশন এবং কার্যক্রমগুলোকে প্রি-টেস্ট করা। আবার খাদ্যসংক্রান্ত যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়, সেখানে খানার সদস্যরা কীভাবে তাদের খাদ্য সংগ্রহ সরবরাহ করছে, সেটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে।

সম্প্রতি অনেককেই বলতে শুনেছি এক জিডিপির তথ্য দিয়েই মনে হয় বিবিএস সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। এর পরই রয়েছে মানুষের গড় আয়ুর এত দ্রুত বৃদ্ধি। সক্ষমতা বা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আর্থিক বা জনবলের কোনো সংকট আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। সংকট শুধু স্বায়ত্তশাসনে। প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সেদিন এক অবসরপ্রাপ্ত সচিবকে বলতে শুনলাম ২০১৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে তার অবস্থান তলানিতে গেছে।

পত্রিকায় পড়েছি গত কয়েক বছরের ব্যবধানে শ্রম জরিপ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সর্বশেষ জরিপে শ্রমশক্তির বিভিন্ন তথ্য চার প্রান্তিকে বিভাজন করে দেয়া হলো। অনেকেই আশা করেছিলেন, এর পর থেকে তা প্রতি বছর প্রকাশ হবে। কিন্তু তিন বছর হতে চলল, সেটিও আর প্রকাশ হয় না। কেননা সেখানে নাকি উঠে এসেছে দেশে কর্মহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

আমার এক বন্ধু বললেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কেউই ভেতরে যেতে চান না, এমনকি কারো দায়বদ্ধতাও নেই। সবাই আছেন ঊর্ধ্বতনদের খুশি করার লড়াইয়ে। সেদিন এক বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে অনেকটা আক্কেলগুড়ুম। তারা নাকি জানেন, কার নির্দেশে এগুলো হচ্ছে।

আর সাবেক পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব তো সরাসরি অভিযোগ করেছেন। আগে নাকি প্রবৃদ্ধি হার ঠিক করে পরে সংখ্যা মেলানো হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ কী? পরিসংখ্যানগত তথ্য-উপাত্তের অসঙ্গতি নিরসনে কেউ দ্রুত এগিয়ে না এলে বাংলাদেশে অচিরেই বিশ্বাসহীনতার অর্থনীতি চালু হবে। তাহলে সব সম্ভাবনা নিয়েও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে অনিশ্চিত।

আমাদের সংখ্যায়, বিশেষ করে সরকারি সংস্থার তথ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতেই হবে।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

আরও