গ্যাস পানি বিদ্যুতে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা

জনপরিষেবা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান জরুরি, মূল্যবৃদ্ধি নয়

মানুষের জীবনমানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি। এগুলো এখন মানুষের মৌলিক জনপরিষেবা। বিগত সরকারের আমলে বছরের পর বছর এসব সেবার দাম বাড়ানো হয়েছে।

মানুষের জীবনমানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি। এগুলো এখন মানুষের মৌলিক জনপরিষেবা। বিগত সরকারের আমলে বছরের পর বছর এসব সেবার দাম বাড়ানো হয়েছে। এসব সেবার দাম ঠিক কী কারণে বাড়ানো হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানে না দেশের জনসাধারণ। বিগত সরকারের সময়ে এসব সেবা খাত উন্নয়নের নামে গ্রাহকের পকেট কাটা হয়েছে। এসব খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম-দুনীতির অনুসন্ধান জরুরি। অহেতুক ব্যয় কমাতে পারলে এসব সেবার দাম কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে এসব খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করছে তাতে এসব খাতের ব্যয় তো কমবেই না বরং সেবার দাম আরো বেড়ে যাবে।

শ্রম ও মূলধনের পাশাপাশি জ্বালানি হলো উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অর্থাৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। জ্বালানির দাম বাড়লে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে সামগ্রিক চাহিদা বা উৎপাদন কমে যায়। এমনকি তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়। বিগত সরকারের আমলে ঢাকা ওয়াসার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। যদিও এসব জনপরিষেবা বা ইউটিলিটির মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বিগত সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাট ও লুক্কায়িত বা গোপন নানা ব্যয়কেই (হিডেন চার্জ) দায়ী করা হয়। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনসাধারণের বড় প্রত্যাশা ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতির তীব্র চাপ থেকে রেহাই দিতে জনগণের জনপরিষেবা খাতের ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। এজন্য খাতগুলোর দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধের পাশাপাশি অযাচিত ব্যয় কমিয়ে আনা হবে। বাস্তবতা হলো ব্যয়ের কারণ অনুসন্ধান এবং তা কমানোর উদ্যোগ না নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এসব জনপরিষেবার দাম বাড়ানোর নানা উদ্যোগ, প্রস্তাব ও পরিকল্পনা করছে। এতে জনসাধারণের ব্যয়ের বোঝা আরো বেড়ে যাবে। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ জনজীবনকে আরো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। অভ্যুত্থানে পতিত বিগত সরকারের বিভিন্ন সময়ে নেয়া প্রকল্পগুলো যৌক্তিকতার নিরিখে আগে পর্যালোচনা হওয়া উচিত। সেটি করা গেলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিতে খরচ কমানো অনেকাংশেই সম্ভব।

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি ও শিল্পায়নের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের গ্যাস সরবরাহ। স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান আসায় স্বল্প মূল্যে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে এটি দেয়া গেছে। এতে স্বল্প মূল্যে পণ্য উৎপাদন করা গেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের ৮৬ শতাংশই আমদানিরনির্ভর। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে আমদানির ব্যয় বেড়ে যায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে। ফলে জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অন্য পণ্য আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। বিগত সরকারের সময়ে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। দেশে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে স্থানীয় গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করা যায়নি। যে হারে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, সে হারে গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যায়নি। অভিযোগ আছে, বিগত সরকার সহজ জ্বালানি সংকট সমাধান হিসেবে জ্বালানি নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। আবার এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বিগত সরকারঘনিষ্ঠরা কমিশন বাণিজ্য করেছেন। এমনকি কমিশন বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে গুটিকয়েক কোম্পানিকে এলএনজি আমদানির করতে দেয়া হয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে আমদানির প্রতিযোগিতামূলক বাজার। এসবের প্রভাবে হওয়া বিপুল পরিমাণ লোকসান ঠেকাতে গিয়ে বর্তমান সরকারও আগের সরকারের মতো দাম বাড়ানোর নীতিতে চলছে। অথচ সিস্টেম লসের নামে প্রতি বছর যে পরিমাণ গ্যাস চুরি হয়, তার সঠিক অনুসন্ধান করা দরকার। বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ গ্রহণ, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া পরিশোধ, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ক্রয়চুক্তিতে বিদ্যুতের দাম ডলারে পরিশোধের সুযোগ রাখা, বিপুল দামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি, সাশ্রয়ী মূল্যের কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ব্যয়বহুল বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার কারণে অপ্রয়োজনীয় খরচ বেড়েছে। এসব খরচ কমানোর জন্য বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি দ্রুত পর্যালোচনা, ক্রয়চুক্তির লুক্কায়িত খরচ শনাক্ত এবং ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা প্রয়োজন।

অন্যতম পরিষেবা পানির দাম বিগত সরকার দফায় দফায় বাড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রত্যাশা তৈরি হয়, শহুরে জীবনে ব্যয়চাপ কমাতে পানির দাম যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এর উল্টো পরিস্থিতি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্প্রতি রাজশাহী ওয়াসা পানির দাম ৩০ শতাংশ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যা বণিক বার্তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এভাবে বারবার পানির দাম বাড়ানোয় গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়ছে। অথচ ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিপুল পরিমাণ সিস্টেম লস, শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগগুলোর কার্যকর অনুসন্ধান দৃশ্যমান নয়। এছাড়া পানি পরিশোধনাগার নির্মাণ, প্রকল্পে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়জনিত বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির বিষয়েও কোনো তদন্ত হয়নি।

প্রায় তিন বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে গত দুই অর্থবছরজুড়েই দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস তথা জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর ওই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে বলে দাবি করে বিবিএস। এরপর সেপ্টেম্বরে আরো কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দেখানো হয়। তবে অক্টোবর ও নভেম্বরে এ হার আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়। অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার দেখানো হয় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর নভেম্বরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। এরই মধ্যে শতাধিক পণ্যের শুল্ক-ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। আবার এখন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির দাম বাড়ানো হলে জনগণের ওপর চাপ আরো বাড়বে। সরকার বিভিন্ন সেবার দাম বাড়ালেও জনগণের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে নির্দিষ্ট ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। সার্বিক বিষয়েই সরকারের ভাবা উচিত।

উল্লিখিত পরিষেবাগুলোর দাম বাড়ানোর আগে বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, অর্থ পাচার, অনিয়ম করে যেসব বিনিয়োগ ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে, তার অনুসন্ধান জরুরি। অনিয়ম-দুর্নীতিসহ হিডেন চার্জের মতো বিষয়গুলোয় এখন হাত দেয়া দরকার। গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এগুলো এখন উদ্ঘাটন করা এবং সামনের দিকে যেন অতিমূল্যায়িত বিনিয়োগ না হয়, সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। এলএনজি আমদানি কমিয়ে নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করা উচিত। দাম না বাড়িয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে পরিষেবার দাম কমাতে হবে।

আরও