করোনা ও বাংলাদেশ

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কিছু কথা কিছু সুপারিশ

‘দুঃখের দিনে পাখিরা কি গান গাইবে? বিষাদের গান গাইবে’!! বারটোল্ট ব্রেখ্ট, জার্মান দার্শনিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক বিপন্ন পণ্য: বিশ্ব পুঁজিবাদ সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রুতগতিতে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে উল্কার বেগে ছুটছে। ফলে কোনো কোনো দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রচার করতে শুরু করেছেন যে সাম্যবাদী সমসুযোগের সমাজ ব্যবস্থার সম্ভবত কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ‘কার্ল মার্কস ইজ ডেড’, বেইজিং এর তিয়ানমিয়ান স্কোয়ারে বিস্মৃত মাও সে তুং, হো চি মিন সিটির স্কোয়ারে শায়িত হো চি মিন। হাভানা স্কোয়ারের কোথাও নেই ফিডেল কাস্ত্রোর ভাস্কর্য, তবু তার উপস্থিতি অনুভবনীয়, চুরুটবিহীন হাসিও আকর্ষণীয়। হাভানার বহু জায়গায় চে গুয়েভারা দৃশ্যমান, চিরতরুণ। কৃষক শ্রমিকের লাল ঝাণ্ডা কি আর উড়বে না?

দুঃখের দিনে পাখিরা কি গান গাইবে? বিষাদের গান গাইবে!!

বারটোল্ট ব্রেখ্ট, জার্মান দার্শনিক, নাট্যকার প্রাবন্ধিক

বিপন্ন পণ্য: বিশ্ব পুঁজিবাদ

সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রুতগতিতে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে উল্কার বেগে ছুটছে। ফলে কোনো কোনো দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রচার করতে শুরু করেছেন যে সাম্যবাদী সমসুযোগের সমাজ ব্যবস্থার সম্ভবত কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কার্ল মার্কস ইজ ডেড, বেইজিং এর তিয়ানমিয়ান স্কোয়ারে বিস্মৃত মাও সে তুং, হো চি মিন সিটির স্কোয়ারে শায়িত হো চি মিন। হাভানা স্কোয়ারের কোথাও নেই ফিডেল কাস্ত্রোর ভাস্কর্য, তবু তার উপস্থিতি অনুভবনীয়, চুরুটবিহীন হাসিও আকর্ষণীয়। হাভানার বহু জায়গায় চে গুয়েভারা দৃশ্যমান, চিরতরুণ। কৃষক শ্রমিকের লাল ঝাণ্ডা কি আর উড়বে না?

বিশ্ব পুঁজিবাদ হঠাৎ ভয়ানক ধাক্কা খেল এক অজানা, অদৃশ্য কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান ক্ষুদ্র নভেল করোনাভাইরাসের কাছে। প্রায় অজানা করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীকে দাবড়িয়ে তুলাধুনা করেছে। ধনী, দরিদ্র, সৎ, দুর্জন, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, আমলা, শিক্ষক, কৃষক জনতাকে। কারো পালানোর পথ নেই। করোনাভাইরাস ছাত্র, শ্রমিক সবাইকে একটি কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেরাষ্ট্র ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে আসবে তো?

প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন মূলকথা নয়, মূলকথা সুন্দর জীবন-জীবিকা এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমঅধিকার সমসুযোগ, যার অনুপস্থিতির কারণে কি করোনাভাইরাসের প্রতিশোধমূলক প্রয়াস, যা থেকে কারো রক্ষা নেই? ফরাসি মার্কসীয় অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি কী ভাবছেন? নাকে-মুখে রক্ত সঞ্চার স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, বরং মৃত্যুর সিগনাল। অন্যায় লুটেরা মুত্সুদ্দি শ্রেণী আজ সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্যের কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার তাদের কোনো পথ খোলা নেই। উন্নয়নের স্বপ্নের রাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশী দুর্নীতিবাজরা হঠাৎ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন, চোখে অন্ধকার দেখছেন। অন্ধকার রুমে কালো বিড়াল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মুক্তি যেন সুদূরপরাহত।

তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ চীনের উহানকে ছাড়িয়ে গেছে, শিল্প স্বাস্থ্য খাত পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কেবল সুষ্ঠুভাবে চালু আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী, সিএমএইচ এবং কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠেছে। হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে, কয়েক শিক্ষকের করোনা মৃত্যুর ঘটনায় প্রায় লকডাউন

স্বাস্থ্য ব্যয় বিল অক্সিজেনস্বল্পতার আলাপ না- বা হলো। দেশের প্রায় ৫০০০ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ১০ শতাংশ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একজন ডাক্তারও সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান দূরে থাকুক, নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না। ঝড় উঠবে সেখানে। অর্থনীতির সংবাদ আরো দুর্বিষহ।

বোমা ফাটিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)দরিদ্রতার হার ২০ থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশ হবে। উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের হিসাবে বছরই বাংলাদেশে দরিদ্রতা বেড়ে ৪২-৪৩ শতাংশে পৌঁছবে। ভয়ানক তথ্য, হিসাবে খুব ভুল নাও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে অন্যূন ৫০ লাখ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হবে। অতিরিক্ত দুই কোটি দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবার খাদ্য সংকটে আছে, তাদের আয় ভয়ানকভাবে কমেছে, দ্রুত অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। এসব সমস্যার মূলে রয়েছে সুশাসনের অভাব গণতন্ত্রহীনতা এবং লাগামহীন দুর্নীতি।

উহানে করোনার ঢেউ দেখে এসএ টিভির মার্চের (২০২০) টকশোয় সরকারকে সতর্ক করে আমি বলেছিলাম, ঝড় আসছে, হাসপাতাল সামলান, ভেন্টিলেটর নয়, বেশি প্রয়োজন নেবুলাইজার পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ এবং এক মাসের মধ্যে দ্রুত প্রশিক্ষণ দেয়া কয়েক হাজার সার্টিফিকেটধারী অবেদন চিকিৎসক যারা ভেন্টিলেটর চালাবেন, ইনটুবেশন করবেন এবং যাদের শ্বাসনালি দ্রুত কেটে বাতাস প্রবেশের দক্ষতা থাকবে মূল সমস্যায় নজর না দিয়ে কভিড চিকিৎসার চিকিৎসক সেবিকাদের তিন-পাঁচ তারকা হোটেলে থাকা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। প্রাইভেট হাসপাতালের সঙ্গে লেনদেন করা হলো, দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়া হলো, সেবা নিশ্চিত করা হলো না। নিবেদিত চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মান দেয়া হলো না। যারা পালাচ্ছেন তাদের উপঢৌকন, অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অধিকতর দুর্নীতি অজুহাতের সুযোগ করে দেয়া হলো।

অতর্কিত করোনা সংক্রমণে বাংলাদেশে কয়েকজন মন্ত্রীর প্রলাপ উক্তি বৈসাদৃশ্য। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় তৃতীয় প্রবাহ হবে ভয়ানক, যা দ্বারপ্রান্তে অথচ আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের উন্নয়ন অন্বেষণ ২০২০-২১ বাজেট সম্পর্কিত তত্ত্ব-উপাত্ত আলোচনায় দেখিয়েছেন যৌক্তিক প্রবৃদ্ধি দশমিক শতাংশের অধিক সম্ভব নয়, উৎপাদনশীল জিডিপি কমবে ১২ দশমিক শতাংশ, প্রবাসী রেমিট্যান্স আয় কমেছে, কয়েক দেশে প্রবাসী অভিবাসী বাংলাদেশীদের কর্মচ্যুতি ঘটেছে। ১৭৪টি রাষ্ট্রে বাংলাদেশের কোটি ২০ লাখ অভিবাসী কাজ করেন, সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বরং কমছে এবং পোশাক শিল্পের আয় স্থবির হয়ে পড়েছে, নীরব ছাঁটাই চলছে, শিক্ষায় সবার সমান সুযোগ নেই, সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা ভোগ করে মাত্র ৯৬ লাখ পরিবার। প্রাপ্তির সঙ্গে আছে দুর্নীতির উইপোকা, বেকারত্ব বাড়ছে শতাংশ হারে, অসহায় শিক্ষিত বেকাররা।

২০২০-২১ : দুঃসময়ের বাজেট কিন্তু আলোচনায় উত্তাপ নেই

দুঃসময়ে গতানুগতিক বাজেটে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ অবসৃত থাকে, পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে কর্মদক্ষতায় প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ছে বাংলাদেশের শ্রমিকের উৎপাদনক্ষমতা।

) দুঃসময়ের বাজেট নিয়ে আলোচনার উত্তাপ নেই। দেশের এতজন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ব্যাংকার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিবিদ কেউ সাহস করে সত্য কথা জনসাধারণকে জানাচ্ছেন না। সবাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষমাণ। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, এমনকি তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুসহ সবাই, তাদের সংশয় কেন? তারা তো শেখ হাসিনার নির্ভরশীল রাজনৈতিক সহকর্মী।

) বিএনপি তাদের স্ট্যান্ডিং উপদেষ্টা কমিটির সভায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নিবিড়ভাবে পড়ে, অধ্যয়ন করে একাধিক আলোচনা-সমালোচনা করে মননশীল সুষ্ঠু সুপারিশ সরকারকে জ্ঞাত না করে ভুল করছে। দেশকে তো বাঁচাতে হবে। এটা কেবল শেখ হাসিনার দায়িত্ব নয়, খালেদা জিয়ারও।

) জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংসদ সদস্যরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন কেন? সুচিন্তিত বাগ্মিতার সংসদ উত্তপ্ত রাখুন, ভয় পাবেন না, নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করুন। সংখ্যার চেয়ে সাহস বড়।

) এরশাদ সাহেব বেঁচে থাকলে বাজেটের প্রতিটি বিষয় পড়ে বুঝে উপযুক্ত সমালোচনা উন্মুক্ত করতেন, জিএম কাদেরের মতো আচরণ করতেন না। জিএম কাদের অনুগ্রহ করে সচেতন হোন। জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আপনার অনেক কাজ বাকি।

) ওবায়েদুল কাদের অনুগ্রহ করে মুখ বন্ধ রাখেন, বিরোধীদলীয় সব সমালোচনার উত্তর দিতে হয় না, এটা রাজনৈতিক অসহিঞ্চুতা, অর্থমন্ত্রীকে উত্তর দেয়ার সুযোগ দিন। বাজেট অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব, আপনার নয়।

) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সর্বদলীয় রাজনৈতিক সভা ডাকুন, বিপদ মুক্তির বাজেট উদ্ভাবনের জন্য। নতুবা কোনো লাভ হবে না দেশের না দেশবাসীর, ওষুধের দাম কমবে না, কৃষক শ্রমিক তার শ্রমের ন্যায্যমূল্য পাবেন না, আইসিইউ প্রতারণা বাড়বে, মৃত্যুর পরও চিকিৎসার বিল দিতে হবে, ফড়িয়ারা রাজত্ব করবে, শহরবাসী অত্যধিক মূল্যে ফলমূল, শস্য কিনে প্রতারিত হবে। স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য অব্যাহত থাকবে, ক্ষুধা-দারিদ্র বাড়বে, সঙ্গে যৌন নিপীড়ন, নৈরাজ্য ব্যাপক দুর্নীতি।

পরিশোধতব্য সুদ ২০২০-২১ বাজেটে

আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রাপ্য বিদেশী ঋণের সুদ এবং পিপিপি, ভর্তুকি দায়বদ্ধতা পরিশোধ করতে লাখ ৪১১ কোটি টাকা প্রয়োজন, যা ২০২০-২১ বাজেটের মোট বরাদ্দের ১৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। খাদ্য, দুর্যোগ, কৃষি, পানিসম্পদ স্থানীয় সরকারের মোট বরাদ্দের ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশের চেয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। স্বাস্থ্যসেবা পরিবার কল্যাণ, প্রাথমিক গণশিক্ষা এবং মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ৭৯ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। স্মরণতব্য ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজন ১৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ বরাদ্দ। সংসদে সম্পর্কে প্রশ্ন না ওঠা দুর্ভাগ্যজনক। পরিশোধতব্য বিদেশী ঋণের বিষয়টি জনসাধারণের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ব্যর্থতা রাজনীতিতে তাদের অপরিপক্বতার পরিচায়ক দুঃখজনক।

বাংলাদেশের জনপ্রশাসন মাথাভারী, নিত্যনতুন সিনিয়র সচিবের জন্ম হচ্ছে, বাজেটের মোট বরাদ্দের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জনপ্রশাসনের পেছনে ব্যয় হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ভালোবাসা

দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক কর্মী গ্রামগঞ্জের সাধারণ কৃষক শ্রমিকের জন্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের অফুরন্ত ভালোবাসা, তার হূদয়ের দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত, তাদের খাদ্যনিরাপত্তা দেয়া, কৃষক শ্রমিক সন্তানের শিক্ষা অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল তার জীবনের ব্রত। সবাই তার একান্তজন, আত্মীয়তুল্য। যাকে একবার শেখ মুজিব দেখেছেন, তাকে তিনি স্মরণ রেখেছেন স্নেহডোরে। কেন্দ্রিকতা তাকে করাচি ইসলামাবাদের শাসনের কথা বারবার স্মরণ করিয়েছে নির্মমভাবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রিকতা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সমসুযোগ সমোন্নয়নের প্রধান বাধা ছিল কেন্দ্রিকতা, যানজট, শাসনজট সময়মতো স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চনার নির্মম মাফিয়া শাসন। পাকিস্তান ভাঙার অন্যতম কারণ কেন্দ্রিকতা, ধর্মের অপব্যবহার কেন্দ্রিকতা দুর্নীতির সোপানও বটে। মুখে রক্ত সঞ্চারের মতো। শহরের সব সুযোগ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামবাসীর জন্য, সঙ্গে নির্মল বাতাস লোকজ সংস্কৃৃতির বিস্তার।

তৃণমূলের অধিকার আদায় জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই। আগস্ট অবধি চলছিল গভর্নরদের প্রশিক্ষণ। তিনি বুঝেছিলেন, পূর্ব পকিস্তানে শিল্প নেই কিন্তু ব্যাপক কৃষি সম্ভাবনা আছে। আছে শিল্পের উৎপাদন সৃষ্টির, তাই কৃষি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান খাদ্যনিরাপত্তার বাহন, পদ্ধতি হবে ইউরোপীয় সমবায় ব্যবস্থাপনা, মেজর খালেদ মোশাররফের ছোট ভাই রাশেদ মোশাররফকে ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন সমবায় পদ্ধতি অবলোকন অধ্যয়নের জন্য। উদ্যোগ নিয়েছিলেন মৌলিক সংস্কারের, যা আজও অসম্পূর্ণ। ব্যর্থতার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এড়াতে পারেন না। পরিবর্তনকে আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? দেশ দেশবাসীকে ভালোবাসাই শেখ হাসিনার শক্তি। গণতন্ত্রে আসন পরিবর্তন কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। প্রকৃতির নিয়ম।

দ্রুত বিপদ মুক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি সরকারি বিনিয়োগ করতে হবে বেসরকারি কৃষি উৎপাদনে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা তদারকিতে উদ্বৃত্ত হয়ে ফিরে আসবে সব বিনিয়োগ। ব্যাংক খেলাপির ঝামেলায় ঘুম হারিয়ে যাবে না। শিল্পপতিদের বিশ্বাস করা যায় না; কিন্তু কৃষককে বিশ্বাস করা যায়, তারা মিথ্যাচার কম করেন, কারণ তারা ধর্মে বিশ্বাসী নীতিবান, তাদের ক্ষুধা সীমিত। মত্স্য, পানিসম্পদ, পোলট্রি, স্বাস্থ্যসেবা, ডেইরি খাদ্যনিরাপত্তায় ব্যাপক বিনিয়োগ নিশ্চিত করুন নির্ভাবনায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে সঠিক নিবন্ধন, সঠিক কৃষককে সময়মতো ঋণদান সময়মতো দুর্নীতিমুক্ত ঋণপ্রাপ্তি। তৃণমূলে সম্পৃক্ত পরিশ্রমী, ক্ষুদ্র ঋণ দ্রুত প্রসার করে নারীদের ক্ষমতায়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। ক্ষুদ্র ঋণের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী . মুহাম্মদ ইউনূস, ব্র্যাকের প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ আশা শফিকুল হক চৌধুরীর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য।

. স্থানীয় শাসন কমিশন গভর্নর নিয়োগ দান

বৃৃহত্তর জনসাধারণের কল্যাণই রাজনীতি। সঠিক সময়ে নির্ভয়ে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়ন নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক কর্মীকে মাথা উঁচু করে থাকা রাজনৈতিক নেতায় উন্নীত করে, ইতিহাসে স্থান করে দেয়। প্রাণপ্রিয় নেতার অসমাপ্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিযোগিতামূলক স্বনির্বাচিত, স্বশাসিত ৬৪ জেলা স্টেট সৃষ্টির লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে কমিশন গঠন করুন, ৬৪ জন গভর্নর নিযুক্তি দিন তৃণমূল রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, পুলিশ সামরিক কর্মকর্তা, বিচারক-বিচারপতি, দানশীল ব্যবসায়ী, প্রখ্যাত সাংবাদিকদের মধ্য থেকে। ছয় মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেন্দ্র জেলা স্টেটে প্রশাসনিক সামঞ্জস্য থাকবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে দ্রুত উন্নয়ন হবে কিন্তু দুর্নীতি বহুলাংশে কমবে, সমঅধিকার সমসুযোগ সৃষ্টি হবে, জবাবদিহিতা থাকবে, সুখের পায়রার বাকবাকুম শুনতে হবে না, জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিকভাবে নিজ জেলা স্টেটে সপরিবারে অবস্থান হবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারি কর্মকর্তাদের বেলায়ও নিয়ম কঠোরভাবে প্রযোজ্য হবে। তাদের সন্তানদের নিজ নিজ জেলা স্টেটে অধ্যয়ন করতে হবে স্থানীয় কৃষক শ্রমিকের সন্তানদের সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে। দুই জায়গায় পরিবার রাখা মানে দুর্নীতিতে সজ্ঞানে অংশগ্রহণ, কর্তব্যে অবহেলা স্থানীয় উন্নয়নে মনোযোগ না দেয়া। স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন সৃষ্টির লক্ষ্যে দুটি প্রশাসন ক্যাডার সৃষ্টি বিবেচ্য হওয়া উচিতব্যাপক জেলা স্টেট ক্যাডার সীমিত কেন্দ্রীয় প্রশাসন ক্যাডার। কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পররাষ্ট্রনীতি, আকাশ-সমুদ্রপথ, আন্তঃজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা, আয়কর ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। পুলিশ হবে জেলা স্টেট সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। কোটা নয় প্রতিযোগিতাই হবে প্রশাসনে প্রবেশপথ। বয়সসীমা অহেতুক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সামরিক বাহিনীতে যোগদানে বয়সসীমা বিবেচ্য হতে পারে, অন্যত্র নয়। সব কর্মচারী-কর্মকর্তাকে অবশ্যই ধূমপান, পান সেবন মাদকাসক্তমুক্ত হতে হবে, এগুলো দুর্নীতির প্রথম ধাপ। সবার আয়কর তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক।

স্থানীয় শিক্ষিতদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হবে জেলা প্রশাসনে, কৃষি উৎপাদন সমবায়ে কৃষি বাজারজাত সমবায়ে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশ হবে। কমিউনিস্ট বাম রাজনৈতিক নেতারা তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার পুরস্কার অর্জন করতে পারবেন কোনো না কোনো জেলা স্টেটে, তাদের শাসনের ধরন নিশ্চয়ই ভিন্ন হবে। নির্মল পরিবেশে আধুনিক শিক্ষা সংস্কৃতির নতুন শহর গড়ে উঠবে জেলা স্টেটে, কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকার সমমানের স্বাস্থ্য শিক্ষা সুবিধা, সঙ্গে মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় লোকশিল্প নিয়ে। শান্তির দ্বীপ হবে সব জেলা স্টেট, সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীর জীবনযাত্রা হবে নিরন্তর নিরাপদ আনন্দময় এবং সম্পত্তিতে সমান অধিকার। জনসংখ্যা ভেদে প্রতি জেলা সংসদে ৪০ থেকে ৮০ জন বিধায়ক সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। সর্বোচ্চ ১০ জনের মন্ত্রিসভা, প্রশাসন শীর্ষে গভর্নর। কেন্দ্র নিয়োগ দেবে জেলা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের জেলা স্টেটের সিভিল সার্জনের পরামর্শে, কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সব চিকিৎসক, সেবিকা কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীদের নিয়োগ উন্নয়ন নির্ধারণ করবে জেলা স্টেট কর্তৃপক্ষ।

. ৫০০০ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র

সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্য সুবিধা ছাড়া আধুনিক জীবনযাত্রা অসম্পূর্ণ অকল্পনীয়। করোনা প্রতিরোধে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মূল ভূমিকা, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক সেবিকারা মূল সেনানী। এখানে বিনিয়োগ হবে অর্থবহ এবং অবশ্য প্রয়োজনীয়। কেবল যন্ত্রপাতি ক্রয় নয়, যন্ত্রপাতির সহায়তায় সময়মতো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানই লক্ষ্য। চিকিৎসক সেবিকাদের জ্ঞান সেবার উন্নয়ন হবে করোনা অন্যান্য মহামারী থেকে আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্র।

আগামী ১০-১৫ বছরে একটি ইউনিয়নের লোকসংখ্যা পৌঁছবে ৫০-৭০ হাজারে। জনগণের চিকিৎসাসেবা স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য ফুট উঁচু, ৮০০ অধিক রানিং ফুটের নিরাপত্তা বেষ্টনী, গভীর নলকূপ ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা, সঙ্গে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিচালকের জন্য ১০০০ বর্গফুটের বিনা ভাড়ায় পারিবারিক বাসস্থান, মেট্রন, একজন দন্ত চিকিৎসক, একজন ফিজিওথেরাপিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট, দুজন নবীন চিকিৎসক দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের জন্য ৬০০ বর্গফুটের আটটি ফ্রি বাসস্থান, মেডিকেল, ডেন্টাল, নার্সিং, ফিজিওথেরাপি ছাত্র টেকনিশিয়ানদের জন্য ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, বিনোদন কক্ষ, ডাইনিং রুম, টয়লেট সুবিধাসমেত হাজার ৫০০ বর্গফুটের ডরমিটরি এবং ২০ শয্যার ইনডোর হাসপাতাল, চিকিৎসকের চেম্বার, প্যাথলজি, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম ছোট অপারেশন কক্ষ বাবদ ৫০০০ বর্গফুট স্থাপনা হবে জনগণকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য সুবিধা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রমাণ।

যেসব চিকিৎসা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সম্ভব হবে না সেগুলো রেফার হবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নত চিকিৎসার জন্য। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসকরা কমিউনিটি ক্লিনিকেও প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসা পরামর্শ দেবেন, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী দাইদের ক্রমাগত আধুনিক চিকিৎসা তথ্য জ্ঞাত করাবেন। তদুপরি তারা মেডিকেল অন্যান্য ছাত্রদের শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব পালন করবেন যার জন্য একটা শিক্ষকতা ভাতা পাবেন। তিন মাস মেয়াদি কোনো একটা সার্টিফিকেট অধ্যয়ন পরীক্ষা দিয়ে জুনিয়র বিশেষজ্ঞ পদে উন্নীত হবেন। কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাতা পাবেন। বিনা ভাড়ায় বাসস্থান সুবিধা পাবেন। গ্রামবাসীকে নিরন্তর চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের জন্য জনগণের পুরস্কার।

সব সরকারি বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল নার্সিং কলেজ এক বা একাধিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত হবে উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা প্রদানের অংশ হিসেবে। ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধ দরিদ্র শ্রেণীর সঙ্গে পরিচিতি দেশপ্রেমের অংশ এবং শিক্ষাদানের প্রধান হাতিয়ার। [চলবে]

 জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী: ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

আরও