দেশে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ নেই। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যমান সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না শিল্প-কারখানাগুলো। দেশীয় উৎসের গ্যাসের সঙ্গে এলএনজি আমদানি করে সংকট সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। তবে অর্থ ও ডলার সংকটের কারণে আমদানিও পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে বিপুল ব্যয়ে আমদানি করা গ্যাস স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে লোকসান দিতে হচ্ছে সরকারকে। এ লোকসান পূরণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। গ্যাস বিতরণকালে কারিগরি ও চুরির কারণে দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাস নষ্ট হচ্ছে, যাকে বলা হয় সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত ক্ষতি। পাঁচ বছর আগেও বিতরণ কোম্পানি তিতাস ও বাখরাবাদের সিস্টেম লস ছিল ৫-৬ শতাংশ। এখন তা প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এ খাতে সিস্টেম লস বেড়েই চলেছে। সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস অভাবনীয় হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে দেশের গ্যাস খাতে। মূলত পুরনো পাইপলাইন, লিকেজ, চুরি ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে কারিগরি ত্রুটিতে বাড়ছে এ ক্ষতির পরিমাণ। গ্যাস খাতে সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় সাফল্য দেখালেও বাংলাদেশ তেমন কিছুই করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিকল্পনার অভাব। ফলে দেশে ক্রমেই বাড়ছে এ খাতে সিস্টেম লস। সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে পাইপলাইন নির্মাণ এবং চুরি ও লিকেজ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। গ্যাস খাতে সিস্টেম লস কমানো গেলে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি গ্যাস আমদানিও কমবে বলে আশা করা যায়।
গ্যাস খাতের লোকসান অর্থাৎ সিস্টেম লস কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদসহ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ার প্রধান পাঁচটি শহরে পাঁচ বছর আগে গ্যাসের সিস্টেম লস (সঞ্চালন ও ডিস্ট্রিবিউশন) ছিল গড়ে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। মূলত পাইপলাইন লিকেজ, চুরি ও কারিগরি ত্রুটিজনিত কারণে এটি হতো। তাই গ্যাস খাতে আর্থিক ক্ষতি কমাতে এ পাঁচ শহরে ১ হাজার ৪৭০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করে পাকিস্তান সরকার। গ্যাস রক্ষণাবেক্ষণে বসানো হয় টাউন বর্ডার স্টেশন (টিবিএস)। এতে শহরগুলোয় গ্যাসের সিস্টেম লস ক্রমান্বয়ে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সামগ্রিক হিসাবে দেশটির গ্যাস খাতের সিস্টেম লস এখন ৫ শতাংশের কিছু বেশি। টিবিএস প্রযুক্তি পুরনো পাইপলাইনে লিকেজ চিহ্নিতকরণ, চুরি বন্ধ করা, ছোট এলাকায় লিকেজ মেরামত এবং গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ শনাক্ত করতে বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তান সিস্টেম লস কমালেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত পারেনি। বাংলাদেশকে গ্যাস খাতে সিস্টেম লস কমাতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে পাইপলাইনে গ্যাস বিতরণ করে ছয়টি কোম্পানি। এসব কোম্পানির মধ্যে বেশির ভাগ গ্রাহক তিতাসের। কোম্পানিটির আওতায় মোট ২৮ লাখ ৮৩ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছেন (২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাবে)। গ্রাহক ও গ্যাসের ব্যবহারভেদে তাদের সিস্টেম লস জানুয়ারির হিসাবে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর বাইরে বাকি পাঁচটি কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা সীমিত। জ্বালানি বিভাগের এক হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছর বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সিস্টেম লস যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৩ ও ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশে গ্যাস সংকটের এ সময়ে একটি বৈধ সংযোগ পেতে দুর্ভেদ্য আমলা চক্রের বাধার মুখে পড়তে হলেও অবৈধ সংযোগ দেয়া থেমে নেই। একদিকে লোক দেখানো অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান চলে, অন্যদিকে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গতিতে চলে চক্রগুলোর অবৈধ সংযোগ দেয়ার তৎপরতা। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কয়েক দিনের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে গ্যাস সংযোগ। বিপুল গ্যাস চুরিকেও সিস্টেম লস দেখিয়ে কার্যত এ চোর চক্রকে সুরক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া কারিগরি ত্রুটি ও অপরিকল্পিত পাইপলাইন নির্মাণের কারণেও গ্যাস খাতে সিস্টেম লস কম নয়। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার আর দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে সিস্টেম লস ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।
গাজীপুরের কাশিমপুরে গত জানুয়ারিতে তিতাসের অভিযানে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার গ্যাসের অবৈধ বিতরণ লাইন উচ্ছেদ, ৪৫০টি অবৈধ আবাসিক গ্যাস বার্নারের সংয়োগ বিচ্ছিন্ন ও ৫০০ মিটার পাইপ অপসারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উদ্যোগী হয়ে ৯ মার্চ ঢাকার ধানমন্ডিতে দুটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, অবৈধ সংযোগ দেয়া, মিটার টেম্পারিং করা, কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো এবং বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্প শ্রেণীর গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। চুরিকে সিস্টেম লস হিসেবে দেখিয়ে সিস্টেম লসের বোঝা সরকার ও বৈধ গ্রাহকের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। এতে সরকারের ভর্তুকি ও ব্যক্তির ব্যয় বাড়ছে। গ্যাস খাতের সিস্টেম লসে প্রতি বছর আর্থিকভাবে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সরকারের।
দেশে রয়েছে জ্বালানি গ্যাস উৎপাদনে নানা সংকট। এর ফলে নতুন বাসাবাড়িগুলো গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন করে ঘরবাড়িতে আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না। ফলে অনেকে রান্নার কাজে এখন বোতলজাত এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি রাজধানীসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারকে গ্যাস চুরি বন্ধ করার একটি কার্যকর উপায় অবশ্যই অবিলম্বে বের করতে হবে। লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে গ্যাস চুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। গ্যাস চুরি মূলত চলে অসৎ ও স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায়। এদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি হয়ে পড়েছে। সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে হলে মিটারিং সিস্টেমের আধুনিকীকরণ ও উন্নত করা দরকার। বিতরণ ও সঞ্চালন, সব জায়গায়ই মিটারিং সিস্টেম জোরদার করতে হবে। সঞ্চালন লাইনের গ্যাস প্রবেশের পথে যেমন মিটার দিতে হবে, তেমনি গ্যাস বিতরণ লাইনে যাওয়ার পথটিতেও দিতে হবে মিটার। মিটারিং সিস্টেমের পাশাপাশি স্বচ্ছ মনিটরিং সিস্টেম করতে হবে।
গ্যাসের সিস্টেম লস কমাতে রোডম্যাপ দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। সেখানে সিস্টেম লসের একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। দেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এ উদ্যোগের বাইরে থাকছে তিতাস ও বাখরাবাদ কোম্পানি। পুরনো পাইপলাইন ও অবৈধ সংযোগ বিবেচনায় তিতাস ও বাখরাবাদের সিস্টেম লস সর্বনিম্ন ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বিতরণ কোম্পানিগুলো চাইলে এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা কঠিন কিছু নয়। এক্ষেত্রে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। যেহেতু কোম্পানির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের একটি চক্রের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে, তাই দ্রুত তদন্ত করে প্রথমে নিজ কোম্পানির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি এসব অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর ওই স্থানে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে গ্যাস চোরচক্র পুনঃসংযোগ না নিতে পারে। সারা দেশে কয়েক লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। বছরের পর বছর এসব সংযোগ চলছে, যা রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতি। সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানের পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে। তাই রাষ্ট্রের স্বার্থে দ্রুততম সময়ে সব অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ ও গ্যাস চুরি বন্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।