দিবস

ডায়াবেটিস এবং এর চিকিৎসা ধারার বিবর্তন

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) এবার ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের থিম বা মর্মবাণী নির্ধারণ করেছে ‘আগামীর সুরক্ষার জন্য শিক্ষা’। স্লোগানটি আইডিএফের ডায়াবেটিস চিকিৎসার তিন বছর মেয়াদি (২০২১-২৩) কর্মপরিকল্পনা ‘ডায়াবেটিস চিকিৎসসেবার পরিধির বিস্তার ও অন্তর্ভুক্তিকরণ’ দর্শনের দ্বিতীয় বর্ষের কর্মভাবনাকে ঘিরে রচিত হয়েছে। বস্তুত রোগ হিসেবে

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) এবার ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের থিম বা মর্মবাণী নির্ধারণ করেছে আগামীর সুরক্ষার জন্য শিক্ষা স্লোগানটি আইডিএফের ডায়াবেটিস চিকিৎসার তিন বছর মেয়াদি (২০২১-২৩) কর্মপরিকল্পনা ডায়াবেটিস চিকিৎসসেবার পরিধির বিস্তার অন্তর্ভুক্তিকরণ দর্শনের দ্বিতীয় বর্ষের কর্মভাবনাকে ঘিরে রচিত হয়েছে। বস্তুত রোগ হিসেবে খোদ ডায়াবেটিসের শনাক্ত ধারণা এবং এর চিকিৎসাপদ্ধতি প্রক্রিয়ায় যে বিবর্তন ঘটেছে বা ঘটছে, তার উপলব্ধি বা শিক্ষাকে জনসচেতনতায় আনতে আইডিএফের এবারের উদ্যোগ। বছর এটি আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কারণে, ২০২২ সাল ইনসুলিন আবিষ্কারের শতবর্ষ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে।  

ডায়াবেটিস গত কয়েক হাজার বছর ধরে মানব জাতিকে প্রভাবিত করে আসছে। গত ১০০ বছরে ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণগুলো এবং ইনসুলিন আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে গত শতাব্দীতে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার উদ্ভাবনগুলো কেবল ইনসুলিনে থেমে থাকেনি; রোগ সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণাও বের হয়ে আসছে। নতুন ওষুধ তৈরি করা হয়েছে, যা শুধু রক্তে শর্করার মাত্রাকেই ঠিক রাখে নাএর সঙ্গে হূিপণ্ডসম্পর্কিত জটিলতাকেও মোকাবেলা করে, যেটা ডায়াবেটিক রোগীদের মৃত্যুর হার হ্রাস করেছে।

ইনসুলিন আবিষ্কারের শতবর্ষ

আজকাল বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমেই যে বিষয়টি আসে সেটি হলো এর মৌখিক চিকিৎসা। অধিকাংশেরই জানা নেই, ১৯২২ সালে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট আবিষ্কৃত ইনসুলিনটি ডায়াবেটিস রোগীদের জীবন দীর্ঘায়িত করার প্রথম সফল ওষুধ। ডায়াবেটিস ওষুধের অত্যাধুনিক অগ্রগতিতে ইনসুলিনের আবিষ্কার তাদের এক অনবদ্য অবদান। ১৯২৩ সালে তাদের এজন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।

ইনসুলিন হরমোনটি অগ্ন্যাশয় থেকে নিসৃত হয়। এটি দেহের ব্যবহারের জন্য শর্করাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিনজনিত ব্যাধির কারণে বিভিন্ন ধরনের ডায়াবেটিসের সৃষ্টি হয় . ডায়াবেটিস টাইপ-: সাধারণত এটি শিশুদের মধ্য দেখা যায়। এটি তখনই ঘটে যখন দেহ ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। . ডায়াবেটিস টাইপ-: সাধারণত মাত্রাতিরিক্ত ওজনের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। এটি ঘটে যখন দেহ ঠিকমতো ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। . গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: গর্ভকালীন নারীদের মধ্যে দেখা যায়, প্লাসেন্টাল হরমোনের কারণে ইনসুলিনের মাত্রা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে শরীর তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না।

ইনসুলিন আবিষ্কারে ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিবর্তন ঘটে। কয়েকটি বৈজ্ঞানিক দল তাদের গবেষণায়, অস্কার মিনকোভস্কি এবং জোসেফ ভন মেরিং দেখতে পেয়েছেন যেসব কুকুরের অগ্ন্যাশয় সরিয়ে ফেলা হয়েছিল তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে। ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট গবেষণার ব্যাখ্যা দেন, যারা ডায়াবেটিস হওয়া কুকুরের স্যালাইন দ্রবণে অগ্ন্যাশয়ের নির্যাস দিয়ে বাঁচার বা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ লাভ করেছেন। এই ব্যাখ্যার বাতাবরণে জেমস কলিপ এবং জন ম্যাকলেয়ড বাছুরের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন সংগ্রহ করে তা পরিশোধন পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করেন এবং মানুষের ব্যবহারোপযোগী করে তোলার মাধ্যমে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন।

১৯২২ সালের জানুয়ারিতে বিজ্ঞানীদের চেষ্টার উদ্দীপনা বা প্রেরণা ছিলেন ১৪ বছর বয়সী লিওনার্ড থম্পসন, যার জীবনে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল, যিনি ডায়াবেটিসের কঠিন অবস্থায় ছিলেন এবং তার অবস্থাও গুরুতর ছিল। পরিশোধিত ইনসুলিন প্রথম ডোজ পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার রক্তে শর্করার মাত্রা আকাশচুম্বী ৫২০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে মাত্র ১২০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারে নেমে যায়। চাক্ষুস তার অবস্থার উন্নতি হয়েছিল, তিনি ইনসুলিন গ্রহণ চালিয়ে গিয়েছেন এবং বেঁচে ছিলেন। ইনসুলিনের জন্য লিওনার্ড থম্পসনের মৃত্যুর দ্বার থেকে বেঁচে আসাটা বিশ্বজুড়ে সব ডায়াবেটিস রোগীর জন্য আশার আলো হয়ে ওঠে।

১৯৮২ সাল থেকে ইনসুলিনের উৎপাদনের জন্য আর প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়নি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অগ্রগতির ফলে ব্যাক্টেরিয়া থেকে মানব ইনসুলিন উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ইনসুলিন পেন আবিষ্কার করা হয়েছিল, এর ফলে ঘটে এর কার্যকারিতার অপরিহার্য উন্নতি, সুবিধাগুলো এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনের চূড়ান্ত নিশ্চয়তা। ১৯৯৭ সালের দিকে ইনসুলিনের পুরনো আবিষ্কারগুলো মানবদেহের উপযোগী অনুয়ায়ী পরিবর্তিত হয়ে আসে। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের এবং তাদের পরিবারের জন্য তাদের নিজস্ব দৈনিক সময়সূচি এবং ক্রিয়াকলাপ অনুসারে ইনসুলিন গ্রহণের উপযোগী করে তাদের জীবনমানকে আরো উন্নত করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ইনসুলিন ১০০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কেবল রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রার ওপর দেখায় না। মূত্রাশয়ের রোগ, লিভারের রোগ এবং হার্টের রোগ থেকেও ডায়াবেটিসের হুমকি থাকে। যার কারণে আজ ডায়াবেটিসের ওষুধ কেবল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়েই মনোনিবেশ করে না। পরিবর্তে তারা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি সম্পূর্ণ হোস্টকে অন্যান্য সিস্টেমেটিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সম্বোধন করছে, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দ্বারা ওষুধ অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় নতুন পদ্ধতিটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওষুধের সর্বশেষ উদ্ভাবনটি তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে যে কেবল তার খুব কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই নয় এটি ডায়াবেটিসজনিত হার্টের রোগ থেকে অল্পসংখ্যক হাসপাতালে ভর্তি এবং কম মৃত্যুতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করছে।

সাম্প্রতিক কালে ডায়াবেটিস হওয়ার নতুন একটি কারণ আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। গবেষণার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের নতুন যে কারণ আবিষ্কার করা হয়েছে, সেটি হলো আইএপি (ইন্টেস্টিনাইল অ্যালকেলাইন ফসফেটাস) কমে যাওয়া। আর আইএপি কমে যাওয়া ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। যাদের আইএপি কমে যায়, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। আবিষ্কারের বিষয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ চিকিৎসায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। মূল গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাবেক সহকারী অধ্যাপক এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির উপদেষ্টা মধু এস মালোর ভাষ্যমতে, গত বছরে ৩০-৬০ বছর বয়সী ৫৭৪ জন ব্যক্তির ওপর গবেষণা করে ডায়াবেটিসের নতুন কারণ সম্পর্কে জানা গিয়েছে। গবেষণার ফল এরই মধ্যে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ছাপা হয়েছে। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বারডেম, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক।

ইনসুলিন আবিষ্কারের পর গত ১০০ বছরের ইতিহাসে যা ফুটে উঠেছে তা হলো বিজ্ঞান চিকিৎসায় কিছু শ্রেষ্ঠ মানুষ দ্বারা ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃঢ সংকল্পতা, গবেষণা এবং দক্ষতা। জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৮৯) কর্তৃক ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বারডেমসহ ডায়াবেটিস চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরন্তর চেষ্টায় ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনমানের উন্নতির জন্য রয়েছে অব্যাহত প্রয়াস। বিশ্বের অপরাপর ডায়াবেটিক সমিতি সংগঠনের তুলনায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি একমাত্র অন্যতম, যা একাধারে ক্লিনিক্যাল চিকিৎসা, গবেষণা ডায়াবেটিস শিক্ষা কার্যক্রম এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে চলেছে। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার জনগণের তরফে সংহত এবং সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জাতিসংঘকে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির হয়ে বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে। সে থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনে ২০০-এর অধিক সদস্য সংগঠনে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কোম্পানি পেশাজীবী সংগঠন ডায়াবেটিক রোগীদের মাঝে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানান প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে।

 

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক চিফ কো-অর্ডিনেটর এবং বর্তমানে ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য

 

আরও