হাঁটার পরিবেশ সবচেয়ে খারাপ মতিঝিলে

পুরো রাজধানীই পথচারীবান্ধব নয়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর পাঁচটি বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাতগুলোয় নাগরিকদের হাঁটার পরিবেশ খারাপ। বিশেষ করে মতিঝিলের ফুটপাতে হাঁটার সুবিধা নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর পাঁচটি বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাতগুলোয় নাগরিকদের হাঁটার পরিবেশ খারাপ। বিশেষ করে মতিঝিলের ফুটপাতে হাঁটার সুবিধা নেই বললেই চলে। যদিও নগরবিদদের মতে, মতিঝিলের নকশা করা হয়েছিল পথচারীবান্ধব হিসেবেই। এখানে হকারদের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী আর হকারের দখলে চলে গেছে। কিংবা সিটি করপোরেশন নিজ থেকে পার্কিংয়ের জন্য ফুটপাত ইজারা দিয়েছে।

ফুটপাতের এমন চিত্র মূলত রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাতে। যে শহরের যানজটে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন কর্মক্ষম মানুষের ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, সেখানে সময় বাঁচিয়ে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে কারো হেঁটে পৌঁছানোর পরিবেশ নেই। একদিকে ঢাকার সড়কের অনুপাতে ফুটপাতের সংখ্যা কম, অন্যদিকে ফুটপাতগুলো খুব বেশি প্রশস্ত নয়। আবার বেশির ভাগ ফুটপাত হকারদের দখলে। নির্বিঘ্নে হাঁটার সুবিধা নেই। বিশেষ করে শারীরিক প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, মহিলা ও শিশুদের হাঁটার জন্য অনুপযুক্ত ফুটপাতগুলো। পণ্যের পসরা সাজিয়ে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও হকাররা দোকান খুলে বসেন ফুটপাতে। উপরন্তু ইদানীং মোটরসাইকেল, সাইকেলের মতো যানও ফুটপাতে চলতে দেখা যায়। আবার ফুটপাতের পাশে নির্মাণাধীন বিল্ডিং থেকে ইট পড়ে পথচারীর মৃত্যু পুরনো ঘটনা এখানে। এমনকি ঢাকার সড়কে দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা বেশি।

অথচ যেকোনো উন্নত শহরের ফুটপাত যানজট এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেখানে সড়কে যানবাহন ও যাত্রীর তেমন চাপ থাকে না। কারণ বেশির ভাগ বাসিন্দাই ১৫-৩০ মিনিট কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় হেঁটে চলাচল করে। ঢাকার সড়কেও হরেক রকম গাড়ির চাপ সামলানোয় সহায়ক হতে পারত দখলমুক্ত ফুটপাত। পাশাপাশি শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর হাঁটার অভ্যাস গড়ে উঠত। একই সঙ্গে মানুষের কর্মঘণ্টা ব্যাহত না হয়ে কাজের পরিসর আরো বাড়ত, যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সহযোগী হতো।

এদিকে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ ও প্রকল্প নেয়া হলেও কোনো সরকারের আমলেই ঢাকার ফুটপাত ঘিরে কোনো টেকসই উদ্যোগ দেখা যায়নি। সকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গিয়ে কোনো ফুটপাত দখলমুক্ত করলেও সন্ধ্যা হতে হতে সেখানে বসে যেত নতুন দোকানপাট। আবার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর পাশে সবচেয়ে বড় বাজার বসতে দেখা যায়। যেমন মিরপুর সড়কে অবস্থিত নিউমার্কেট। ওই সড়কে যানজটের অন্যতম কারণ ফুটপাতজুড়ে দোকান, যা যান চলাচলের পথ সংকুচিত করে তোলে। আবার বাংলাদেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে ফুটপাতগুলো জড়িত। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দেয় ফুটপাতের দোকানগুলো। এ পরিস্থিতিতে হকারদের উচ্ছেদ করে ফুটপাত ব্যবহারযোগ্য করার সিদ্ধান্ত আদৌ বাস্তবায়যোগ্য কি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদা আছে বলেই হকারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে কমছে হাঁটার সুবিধা। হকারদের উচ্ছেদ করে সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের জন্য সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে।

এর বাইরে একটি সমাধান হতে পারে, ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দেয়া। একই সঙ্গে তাদের জন্য বহুতলবিশিষ্ট অবকাঠামো তৈরি করে দেয়া, যাতে ভূমির ওপর চাপ কমে। তবে যেসব সড়কের ফুটপাতে হকারদের জন্য জায়গা রাখা হয়নি, সেসব ফুটপাত হকারমুক্ত করে অন্যত্র স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেয়া হোক। পাশাপাশি পথচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলায়ও মনোযোগ দিতে হবে।

ঢাকার অধিকাংশ ফুটপাত দখলের পাশাপাশি পথচারী পারাপারের জায়গাগুলো ভীষণ রকমের অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। পর্যাপ্তসংখ্যক ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ও ওভারপাস যেমন নেই, তেমনি এসব অবকাঠামোর গুণগত মান এবং অবস্থান নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাগুলোও পথচারীবান্ধব নয়। পথচারীর জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে তা তুলনামূলক যৎসামান্য। আবার প্রধান সড়কগুলোয় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারের মতো অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে পথচারীদের হাঁটার পথ। তাই হাঁটার পরিবেশ তৈরিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণও জরুরি।

যোগাযোগ ‍বিশেষজ্ঞদের মতে, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তুলতে ‌খুব বেশি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের এগিয়ে আসতে হবে ফুটপাত প্রকৃতপক্ষে ব্যবহারযোগ্য করতে।

স্রেফ নামেমাত্র ফুটপাত নয়, নির্বিঘ্নে হাঁটার উপযোগী ফুটপাত বর্তমানে জরুরি হয়ে পড়েছে। বুয়েটের তথ্য বলছে, প্রতি বছর এ যানজটে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ফুটপাত ব্যবহার উপযোগী হলে তা যানজট নিরসনে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। তাছাড়া দেশ নানামুখী অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। সেসব সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়ও এ সড়কের বিশৃঙ্খলা। কারণ সময়ের অপচয় ও দুর্ঘটনা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা আরো বেশি আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

চারদিকে যেহেতু সংস্কারের আলোচনা, সেখানে সড়ক ব্যবস্থাপনা অগ্রাধিকার পাবে—এ প্রত্যাশা রয়েছে। পরিকল্পিত একটি শহর গড়ে তুলতে দেশের কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে সুন্দর ও বাসযোগ্য শহরের জায়গা ঢাকা হয়ে উঠেছে একটি দূষিত, দুর্ঘটনাপ্রবণ শহর। দেশকে যারা এগিয়ে নেয়ার সক্ষমতা রাখে, সেই নাগরিক প্রতিনিয়ত আটকে যাচ্ছে যানজটে, ফুটপাতে। জনবহুল এ শহরে ফুটপাতগুলো ঢেলে সাজালে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক সংকট কেটে যেত। পাশাপাশি দেশের ব্যবসা পরিবেশেরও উন্নয়ন ঘটত।

আরও