ভগ্ন অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই শৃঙ্খলা অনুপস্থিত। গত দেড় দশক সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন দুষ্টচক্রের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেগুলেটরি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠা হিসেবে ব্যাংকগুলোকে যথাযথ দেখভাল করতে পারছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বছর ধরে ক্রমেই কমছে। শেখ হাসিনার সরকার শেষ সময় পর্যন্ত

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই শৃঙ্খলা অনুপস্থিত। গত দেড় দশক সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন দুষ্টচক্রের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেগুলেটরি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠা হিসেবে ব্যাংকগুলোকে যথাযথ দেখভাল করতে পারছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বছর ধরে ক্রমেই কমছে। শেখ হাসিনার সরকার শেষ সময় পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থ পাচার এবং তা ঢাকতে মিথ্যা তথ্য প্রদান করা। দেশ থেকে গত ১৬ বছরে প্রায় ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এ দেশের সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা, মন্ত্রী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারীসহ অনেকেই বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা জন্ম নিয়েছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি আর্থিক খাত সংস্কারের মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা এখন জরুরি।

দেশের অর্থনীতিতে কর আহরণ পদ্ধতি মানুষের আয় অনুপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর প্রদান করে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। দেশের প্রায় ৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) আছে। তবে ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে, মাত্র ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ আয়কর প্রদান করেছে। প্রত্যক্ষ কর আহরণের হার কম হওয়ায় আমাদের পরোক্ষ কর আহরণের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে। পরোক্ষ করের ওপর অতিনির্ভরতার অর্থ হলো সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর ওপর বেশি অনুপাতে কর প্রদানে বাধ্য করা। দেশে ধনী-গরিবের কর প্রদানের আনুপাতিক যে বৈষম্য রয়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ সঠিকভাবে আয়কর আহরণ করতে ব্যর্থ হওয়া। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ কর আহরণ খাতের সংস্কার সমাজে আয়বৈষম্য দূর করতে অত্যাবশ্যক। আর যত দ্রুত তা শুরু করা যায় ততই মঙ্গল।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার থেকে একটি গোষ্ঠী হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাকে কখনো তদন্তের মুখোমুখি করা হয়নি। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রথম আলোচনায় আসেন। একইভাবে ২০১০ ও ২০১৬ সালেও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, বিগত সরকার বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে লাখ লাখ নতুন গ্রাহক নিয়ে আসা, শেয়ারবাজারকে অতিমূল্যায়িত করা, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্তদের বছরের পর বছর শেয়ারবাজারের দায়িত্ব দেয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর হওয়া প্রতারণার কোনো বিহিত ও বিচারের চেষ্টা করা হয়নি। বরং তাদের উল্টো রাষ্ট্রক্ষমতায় অন্তর্ভুক্ত করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের অন্যতম প্রধান খাত হলো শেয়ারবাজার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। একই সঙ্গে অতীতে যাদের কারণে শেয়াবাজারের লাখ লাখ টাকা লুট হয়েছে, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। 

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পতিত হওয়া শেখ হাসিনা সরকারের প্রধান দিকগুলোর একটি ছিল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। যদিও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সরকারকে অর্থনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজ বারবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও তারা পাত্তা দেয়নি। ২০০৮ সালে মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার টাকা। কিন্তু বিগত সরকার অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে অধিক সুদে ঋণ নেয়ায় ২০২৪ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ টাকায়। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে মাথাপিছু ঋণ বাড়তে থাকে। এর প্রধান কারণ ঋণ নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। এদিকে ১০ বছর ধরে বিনিয়োগ ২৩ শতাংশের ঘরে আটকে আছে (কালের কণ্ঠ, ৪ এপ্রিল ২০২৪)। একদিকে সরকার বেশি বেশি ঋণ নিয়েছে, অন্যদিকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি। দেশের টেকসই উন্নয়নে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিবর্তে মানব উন্নয়ন ব্যয় নিশ্চিত করা জরুরি। দেশে যদি শিক্ষিত, দক্ষ ও সুস্থ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়ে ওঠে তাহলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। 

স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ ছিল একটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ এবং পরবর্তী সময়ে পাট, চা ও চামড়া শিল্পের প্রসার ঘটে। অবশ্য গত দুই দশকে পাট ও চামড়া শিল্প আগের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০১ সালের পর বিএনপি সরকারের ভুল কৌশল পাট শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং পরবর্তী ১৫ বছরে তা কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে পরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ধ্বংস হয়ে যায় চামড়া শিল্প। পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ মূলত সুতা ও অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি করে নিয়ে এসে কাপড় এবং পোশাক তৈরি করে থাকে। খুব সামান্য পরিমাণ সুতা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। ফলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানি করে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে, তেমনি পোশাক তৈরির কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো মূলত সেবা খাতনির্ভর হয়। এতে একদিকে যেমন স্বল্প বিনিয়োগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়, তেমনি একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের ফলে সৃষ্ট গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেও দেশের জনগণ রক্ষা পায়। বাংলাদেশকে তাই শিল্প ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও ব্যবসাসংক্রান্ত সেবা খাতে সঠিক বিনিয়োগে আগ্রহী হতে হবে। সেজন্য সরকারের সঠিক আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৌশল গ্রহণ অত্যাবশ্যক। আমরা আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেদিকে সঠিকভাবে মনোযোগ দেবে এবং দেশের অর্থনীতিকে সেবা খাত নির্ভর করতে সক্ষম হবে।

মূল্যস্ফীতি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে একটি অন্যতম সমস্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা জুন ২০২৪-এ ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত জুলাইয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষকে স্বস্তি দিতে হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। 

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের পর বাংলাদেশের বাস্তবতায় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন হবে তা বলাই বাহুল্য। এমন বাস্তবতায় আগের সরকারের আমলে হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, জুলাই হত্যাকাণ্ড কিংবা বাংলাদেশের বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করা জরুরি। এজন্য জনগণের আস্থা ও ধৈর্য প্রয়োজন হবে। আর সেজন্য তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি তথা জীবনযাত্রার খরচ কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। আশা করি, বর্তমান সরকার সঠিকভাবে অর্থনীতির ক্ষতগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে। সেজন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা যেমন জরুরি তেমনি দেশের স্বার্থে সব নাগরিকের দায়িত্বশীল আচরণও অতি আবশ্যক। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের ভগ্ন অর্থনীতিকে সংস্কার করে সঠিক পথে পরিচালনা করাই হবে এ সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 

কায়সুল খান: গবেষক ও কলামিস্ট, নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল

আরও