বেশি না, মাত্র বছর চারেক আগে, করোনা অতিমারীতে থমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। এ শতাব্দীর প্রথম এক-চতুর্থাংশে কভিড-১৯ মহামারীর মতো বিশ্ব আলোড়িত ঘটনা আর নেই। ২০২০-এর মার্চে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী শহর উহান থেকে শুরু হওয়া এ অতিমারী সময়ে সময়ে নতুন সংক্রমণের ঢেউ বইয়ে দিয়ে এখন পর্যন্ত দুনিয়াব্যাপী প্রায় সত্তর কোটি মানুষকে সংক্রমিত করেছে। ওয়ার্ল্ডমিটারের গত সপ্তাহের পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৭০ লাখের অধিক। জ্ঞানবিজ্ঞানে উৎকর্ষের মানদণ্ডে মানবসভ্যতা যেকোনো যুগের চেয়ে এখন উচ্চতম স্থানে অবস্থান করলেও ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস দুনিয়ার সুপারপাওয়ারদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। ২০২০ সালের মে-জুনে ইউরোপ-আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে করোনাভাইরাস সদর্পে তার মরণ কামড় বসিয়েছিল, যার ফলে থমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্বের যোগাযোগ কাঠামো। তাবৎ বিশ্বের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, অণুজীববিদ, মলিকুলার বায়োলজিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, ফারমাসিস্টরা একযোগে সমাধানের পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন। একদিকে লকডাউন, শাটডাউন, কোয়ারেন্টাইন ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, অন্যদিকে করোনা রোগ নির্ণয়ের আরটি-পিসিআর টেকনোলজি, চিকিৎসা প্রদান, ভ্যাক্সিন ডিজাইন, ভ্যাক্সিন উৎপাদন, ভ্যাক্সিন বিতরণ ও সামগ্রিক ব্যবস্থা সমন্বয় সাধনের এক মহা কর্মযজ্ঞ চলছিল। অবশেষে ২০২২-এর মাঝামাঝি এসে কমতে থাকে কভিড আক্রান্তদের মৃত্যুর মিছিল, নিয়ন্ত্রণে আসে মহামারী।
মহামারী বা অতিমারী জনজীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা আমরা সবাই সে সময় বুঝেছি। করোনার ভয়াবহতা শেষ মানেই যে আমরা সংক্রামক রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তি পেয়েছি তা নয়। সংক্রামক রোগগুলো তার পূর্বের রূপ পাল্টে আরো ভয়াবহরূপে যেকোনো সময় মহামারীর আকার ধারণ করে মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। ইতিহাসের পরিক্রমায় অন্তত পঞ্চাশ লাখ মানুষের প্রাণ হরণ করে নেয়া মহামারীর সংখ্যা প্রায় ১০টি, যার অন্তত চারটি গত ১০০ বছরে অবলোকন করেছে এ বিশ্ব। এই যে এখন উগান্ডায় ‘ডিঙ্গা ডিঙ্গা’ নামে একটি সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এরই মধ্যে ৪০০ নারী ও কিশোরী আক্রান্ত হয়েছে এ ভাইরাসে। ভাইরাসটিকে বিশেষজ্ঞরা ১৫১৮ সালের ফ্রান্সের ‘ডেন্সিং প্লেগ’-এর সঙ্গে তুলনা করছেন। আবার অক্টোবরের শেষদিকে ‘রিপাবলিক অব কঙ্গো’-তে এক অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন পর্যন্ত প্রায় দেড়শ প্রাণ কেড়ে নেয়। প্রথমদিকে এ সংক্রমণকে তারা ‘ডিজিজ এক্স’ নাম দিলেও গত সপ্তাহে কঙ্গোর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এটি শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহকারী ম্যালেরিয়ার একটি নতুনরূপ। ২০২৩ সালে আফ্রিকায় মহামারী আকার ধারণ করে এম্পক্স ভাইরাস, যা কেড়ে নিয়েছে প্রায় হাজার খানেক প্রাণ। এ বছরই লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করে এরই মধ্যে পাঁচ হাজার জীবন কেড়ে নিয়েছে। পরিবেশ দূষণ ও মেরু অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঘটনাগুলোও এ রকম নিত্যনতুন ভাইরাস কিংবা পুরনো ভাইরাসের নতুন রূপে ফিরে আসতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
এ অদেখা এবং অজানা এ সংক্রামক রোগজীবাণুর বিস্তরণ, নিয়ন্ত্রণ ও দমনের জন্য সুব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। যোগাযোগের এ সময়ে দেশের সীমানা বন্ধ করে মহামারী মোকাবেলা সম্ভব নয়। মহামারী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত প্রচেষ্টা, বিশ্বজনীন উদ্যোগ প্রণয়ন এবং স্থানীয় পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন তদারকি ও ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় প্রতি বছরের ২৭ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক মহামারী প্রস্তুতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানানো হয়। গত ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস ‘আন্তর্জাতিক মহামারী প্রস্তুতি দিবস’ সামনে রেখে তার বিবৃতিতে বলেন, ‘করোনার ভয়াবহতা হয়তো আমরা পার করে এসেছি, কিন্তু করোনা আমাদের যে অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে, তা সঠিকভাবে কাজে না লাগাতে পারলে কিছুদিন পরপর এমপক্স, কলেরা, পোলিও কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন প্রকরণ আমাদের সামগ্রিক ধ্বংসের কারণ হবে। পূর্বের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে বিশ্বব্যাপী একযোগে কাজ করতে পারলেই কেবল সর্বজনীন ও টেকসই চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ২০২০ সালের ঐতিহাসিক মহামারী নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্রের স্বাক্ষরকারী বিশ্বনেতারা এ বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।’ এ বছর আন্তর্জাতিক মহামারী প্রস্তুতি দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আজ এবং প্রতিদিন, সবাই মিলে নিশ্চিত করি সবার জন্য সবখানে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ বিশ্ব’। এ স্লোগান থেকেই বোঝা যাচ্ছে, উদ্যোগ গ্রহণে কালক্ষেপণ আমাদের ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
স্থানীয় জনস্বাস্থ্য সমস্যার বাস্তবতা সামনে রেখে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সব অংশীজনের মতামত নিয়ে জাতীয় মহামারী প্রতিরোধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রস্তুত করে তোলা এবং এর পরিসর বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে নাগরিকদের রোগজীবাণু সংক্রমণের ব্যাপারে জানানো ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ কিংবা ধর্মীয় নেতারা থেকে শুরু করে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টসহ সবার অংশীদারত্বের ভিত্তিতে মহামারী প্রতিরোধ প্রস্তুতিমূলক একটি সামাজিক প্লাটফর্ম গঠন করা হলে সচেতনতা তৈরির কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রতিষ্ঠান প্রধানরা অথবা এ বিষয়ে ধারণা রাখেন এমন একজন শিক্ষক প্রতি তিন মাস অন্তর ১ ঘণ্টার একটি সেশন আয়োজন করতে পারেন। বিজ্ঞানভিত্তিক ক্লাব কিংবা স্থানীয় যুবসংঘগুলোও মহামারী বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। এত গেল প্রতিরোধের কথা, কিন্তু মহামারী আঘাত হানলে প্রতিকারের ব্যবস্থাপনা সাধন করাও জরুরি। চিকিৎসা অবকাঠামোর উন্নয়ন এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য খাত। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ অব ক্রিটিক্যাল কেয়ার জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুযায়ী দেশে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ২ হাজার ১৩৯ এবং এইচডিইউ বেডের সংখ্যা ৭১৫, অর্থাৎ ক্রিটিক্যাল সময়ে চিকিৎসা উপযোগী বেডের সংখ্যা ২ হাজার ৮৫৬। সে অনুযায়ী, দেশে প্রতি ৫৯ হাজার মানুষের জন্য একটি আইসিইউ/এইচডিইউ বেডের ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই রাজধানী শহর ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ/এইচডিইউ বেডের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। করোনা মোকাবেলার অভিজ্ঞতার আলোকে চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে দ্রুততার সঙ্গে মহামারী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জীবাণুর সংক্রমণ ও প্রতিষেধক তৈরিতে গবেষণার জন্য গবেষণা বরাদ্দ রাখতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ‘করপোরেট-সামাজিক দায়িত্ব’ পালনে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
২০৩০ এজেন্ডা বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে পৌঁছতে হলে একটি সহনশীল ও সুদৃঢ় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো বিনির্মাণ ভিন্ন মহামারীকালীন ভয়াবহতা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। যুগে যুগে মহামারী এসে জনপদের পর জনপদ খালি করে দিয়েছিল, আর সেই মিছিলের সর্বশেষ উদাহরণ ছিল কভিড-১৯। মহামারী সমস্যা একটি সামগ্রিক সমস্যা, তাই প্রত্যেকেরই নিজের জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। ক্ষুদ্র জীবাণুর সংক্রমণ সমূলে নিরাময় সম্ভবপর না হলেও যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করলে মহামারীর প্রকোপ অনেকাংশে লাঘব করা যাবে, তা বলাই যায়।
মো. মেহেদী হাসান সোহাগ: সহকারী অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়