এতদিন অর্থনৈতিক সংকটে ছিলাম। এখন এ মুহূর্তে রাজনৈতিক সংকটে পড়েছি বলে দৃশ্যমান। এরই মধ্যে পাঁচদিন অবরোধ ছিল। ঢাকা শহর অবরুদ্ধ। একদিন ছিল সারা দেশে হরতাল। বাস-গাড়ি পুড়েছে। পুলিশসহ তিন-চারজন মারা গেছে। সর্বত্র কী হবে, কী হবে—এমন একটা অবস্থা। মানুষ টেলিভিশনের সামনে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য। এদিকে আজ কার্তিক মাসের ২৩ তারিখ। সবেমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম উৎসব দুর্গা পূজা শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হয়েছে। বাজারে পাট উঠেছে। সামনে অগ্রহায়ণী ফসল যাকে আমরা বলি আমন। ফসলের পূর্বাভাস ভালো। সব সংকটের পরও বলতে হয় চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। সরকারের গুদামে ১৮-২০ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য মজুদ আছে। কৃষক অপেক্ষা করছেন নতুন ধানী ফসলের জন্য। চড়া আলুর দামের বাজারের খবর, নতুন গোল আলু বাজারে উঠেছে। দাম নাকি কেজিতে ১২০-১৫০ টাকা। শীতের সবজি উঠবে অচিরেই। দেশে কার্তিক মাসের ‘মঙ্গা’ এখন আর নেই। ভাতের হাহাকার নেই অথচ একসময় তা থাকত প্রকট। সৌভাগ্যক্রমে ওই পরিস্থিতি আজ আর নেই। এটা ‘কালের’ হিসাবে হেমন্তকাল। আসবে শীতকাল। পৌষ মেলা সামনে। নতুন ফসলের ভাত হবে ঘরে ঘরে। পিঠেপুলি হবে। কৃষকের আনন্দ-উৎসবের শেষ থাকবে না। এমন একটা পরিস্থিতিতেই বিরোধীদলীয় আন্দোলন, রাজনৈতিক কর্মসূচি। হরতাল, অবরোধ। দফা একটা। সরকারের পদত্যাগ। কেয়ারটেকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। সরকারি দল তা দিতে প্রস্তুত নয়। এ নিয়ে বিরোধ। মানুষ দেখছে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়! কে আসবে ক্ষমতায়, কে জিতবে জানুয়ারির নির্বাচনে। আসল কথা নির্বাচন হবে তো?
নির্বাচনের ফল সবাই মেনে নেবে তো? এসব প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে। অরাজকতা সৃষ্টি হবে না তো? আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বিঘ্নিত হবে না তো? প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ঠিক থাকবে তো? এরই মধ্যে আমদানিকারক, শিল্প মালিকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে তাদের ব্যবসা বিঘ্নিত হবে। এই যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে তা কোন প্রেক্ষাপটে?
সবাই অবগত যে দেড়-দুই বছর ধরে আমরা অস্বস্তিতে আছি অর্থনীতি নিয়ে। অস্বস্তি এখন সংকটে পরিণত হয়েছে। প্রথমে করোনা অতিমারী-২০১৯। এতে হাজার হাজার মানুষ দেশে প্রাণ হারায়। স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হয়। পারিবারিক জীবন বিঘ্নিত হয়। সাপ্লাই চেইন হয় বিধ্বস্ত। মানুষে মানুষে মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নানা প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতিকে ঠিক রাখার ব্যবস্থা হয়। খাদ্য জোগান দেয়া হয়। চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। এসব করে পরিস্থিতি যখন কিছুটা সামাল দেয়া হয়েছিল, যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, যখন কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, সেই সময়ে আচমকা নতুন উপদ্রব এসে হাজির হয়—মারাত্মক উপদ্রব। শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অহেতুক এ যুদ্ধ। বোঝাই যায় ‘বড়লোকের’ লড়াই, ক্ষমতার লড়াই, শক্তি প্রদর্শনের লড়াই। অস্ত্র বিক্রির ফন্দি। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফাটকা লাভের ফাঁদ। ব্যস আর যায় কোথায়? আন্তর্জাতিক বাজারে হুহু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তেলের দাম বাড়ে।
ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে। জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক বাড়ে। চাল-গমের বাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আমরা পড়ে যাই গ্যাঁড়াকলে। আমরা আমদানিনির্ভর একটা দেশ। তৈরি পোশাক আর জনশক্তি রফতানি ছাড়া আর সবকিছুই আমাদের আমদানি করতে হয়। তেল, চিনি এমনকি পেঁয়াজ, ডিম, আলু, কাঁচামরিচ, আদা, রসুনসহ যাবতীয় ভোগ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমাদের আমদানি করে খেতে হয়। সরকার এ অবস্থায় রাজস্বের ব্যবস্থা করতে না পেরে তেল, গ্যাস, অকটেন, পেট্রল ও ডিজেলের দাম এক লাফে অনেক বাড়িয়ে দেয়। বাজার ওঠে আসমানে। মূল্যস্ফীতি হয় অস্বাভাবিক হারে, যা এখন প্রায় ১০ শতাংশের মতো। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। ডলারের দাম বেড়ে যায়। আমদানীকৃত পণ্যের দাম বাড়ে বিভিন্ন কারণে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এক কারণ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আরেক কারণ এবং বর্ধিত মূল্যের ওপর শুল্ক ধার্যকরণ হচ্ছে আরেক কারণ। পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫-৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারে (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে) নেমে আসে। ‘আন্তর্জাতিক মহাজন’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আসে সাহায্য করতে। নানা কঠিন শর্তে তাদের কাছ থেকে তিন বছরে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে, তাদের শর্ত পূরণ একটা কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ডলারের দাম খোলাবাজারে ঠিক হবে—এক শর্ত। তেল, গ্যাস বিদ্যুতের ওপর থেকে ভর্তুকি কমাতে হবে। আরো কত কী? রাজস্ব বাড়াতে হবে। অথচ সরকার রাজস্ব বাড়াতে পারছে না। রিজার্ভ ক্ষয় কমাতে সরকার আমদানি সংকুচিত করেছে। আমদানি সংকুচিত হলে রাজস্ব আদায় কম হবে। আবার ডলারের দাম বাড়লে সব জিনিসের দাম বাড়বে। অথচ আইএমএফ এবং দেশীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দারুণ বিপদ। পরস্পরবিরোধী দাবি আইএমএফের। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমায় আমাদের আমদানি ঋণপত্র (এলসি) বিদেশী ব্যাংকগুলো গ্রহণ করতে চায় না। ভিন্ন ব্যবস্থায় বেশি ব্যয়ে এলসি খুলতে হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে, কাঁচামালের অভাবে শিল্প-কারখানা অনেক বন্ধ হচ্ছে। কাঁচামাল আমদানি, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি, ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে অনেক। এতে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন কমেছে। এতে বলাবাহুল্য রফতানির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। ব্যাংকে তারল্যের অভাব। বর্ধিত দামে ডলার কিনতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অথচ আমানত সেভাবে বাড়ছে না। ঋণ বেড়েই চলেছে। বাজারে ডলার নেই। হুন্ডিওয়ালারা বিদেশেই বাংলাদেশীদের হাত থেকে ডলার কিনে বিদেশেই রেখে দিচ্ছে। ফলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ দিন দিন কমছে। রফতানির পরিমাণ সেভাবে বাড়ছে না। সরকারি ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে। সরকারের রাজস্বে অভাব ঘটায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির টাকা খরচ হচ্ছে কম।
নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের ভোগব্যয় কমছে বলে কাগজে খবর ছাপা হচ্ছে। মানুষ ঋণ করছে আগের চেয়ে বেশি। বহুপণ্যের ব্যবহার মানুষ ছেড়ে দিচ্ছে। গরিব আরো গরিব হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার নিচে নতুন করে অনেক মানুষ চলে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ‘ক্যাশের’ অভাব দেখা দিয়েছে। সরকার এক কোটি পরিবারের খাদ্যের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কী হবে—এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। গ্রামাঞ্চলে অনেক ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠছিল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে জুট শিল্প। জুট দিয়ে সৈয়দপুরে শীতকালের জন্য কম্বল তৈরি হয়। বিশাল ব্যবসা। শীত আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সৈয়দপুরের জুটের ব্যবসা জমে ওঠেনি। শীতকালের ব্যবসার আরো কিছু দিন আছে। সেসব ব্যবসাও জমে উঠছে না। চাদর, কম্বল তো আছেই। এর সঙ্গে আছে অনেক সহযোগী পণ্য। এসবের বাজার জমছে না। বিনিয়োগ নেই। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের/ঋণের প্রবাহ কমেছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রাখছেন। নতুন অনিশ্চয়তা। অবশ্য ঋণের সংকট, ডলারের সংকট, আমদানির সংকট আছে। এসব কারণে নতুন বিনিয়োগ নেই। বিদেশীরা ঋণ নিয়েও আসছে না। তারাও ‘এফডিআই’ নিয়ে আসছে না।
সমস্যার আকার বোঝার জন্য একটু বিস্তারিত আলোচনা করলাম। যাতে সমস্যার গভীরতা বোঝা যায়। সংকটের আকার ও প্রকার বোঝা যায়। এমন একটা গভীর সংকটের সময়ে সামনে আসছে জাতীয় নির্বাচন। পাঁচ বছর পর এ নির্বাচন। নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। দৃশ্যত যা মনে হচ্ছে তা শান্তিপূর্ণভাবে হওয়ার কারণ নেই। বিদেশীরাও অনভিপ্রেতভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়ে পড়ছে, যা কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ নয়। সরকারি দল এবং বিরোধী দলের অবস্থান বিপরীতমুখী। আলোচনা, সংলাপ, সমঝোতার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত নেই। এ অবস্থায় প্রশ্ন এই ‘সংকট’ কী স্বল্প সময়ের জন্য, না তা হবে দীর্ঘদিনের জন্য? যদি হয় দুই মাসের জন্য তাহলে এর ফল অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে হবে একরকম। আবার যদি নির্বাচনোত্তরকালেও এ সংকট চলে, তাহলে এর পরিণতি হবে আরেক রকম। এ পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন, আমরা কী তাহলে হরতাল-অবরোধের জমানায় পৌঁছে গেলাম আবার। হরতাল, অবরোধে আমরা অভ্যস্ত। বহুবার আমরা এসবের মুখোমুখি হয়েছি। বস্তুত গত ৫০-৫২ বছরের অভিজ্ঞতা এসব নিয়েই। তবে ইদানীং ১০-১৫ বছর আমরা এসব থেকে মুক্ত ছিলাম। এর ফল আমরা পেয়েছি। ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আমরা অর্জন করতে পেরেছি। বিশ্ব আমাদের প্রশংসা করছে। অনেক সূচকে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও ভালো। তবে কি ওই পরিস্থিতি থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। আবার হরতাল, অবরোধে ফেরত যাচ্ছি? অথচ আমরা জানি না একদিনের হরতাল বা অবরোধে জাতীয় অর্থনীতির কত ক্ষতি হয়। এ হিসাব কার কাছে আছে আমার জানা নেই। তবে কয়েকদিন আগে ‘এফবিসিসিআই’ নেতা আমাদের জানিয়েছেন একদিনের হরতাল অবরোধে আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি হয় ৬ হাজার কোটি টাকা। তাহলে হিসাব করা যায় দুই মাসের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাদের কত ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন। আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যবসা বিঘ্নিত হবে। এর ফল কী তা লিখে প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। দেশীয়ভাবে ‘সাপ্লাই চেইন’ বিঘ্নিত হওয়া মানে দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়া। সব জিনিসের দাম বাড়া। আরেকটা পরিণতি মারাত্মক। মানুষের আয় কমবে। শ্রমজীবী মানুষের আয় কমবে। রিকশাওয়ালা, চাবিওয়ালা, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, দিনমজুরের রোজগার কমছে। মানুষ আরো ঋণে জর্জরিত হবে। দৈনন্দিন কাজ হবে দারুণভাবে বিঘ্নিত। এ পরিস্থিতি কি কাম্য? নিশ্চয় নয়। তাহলে কী করণীয়? অর্থনীতির স্বার্থেই রাজনৈতিক সংকট সমাধান করা। সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ে আমরা চিরকাল যুদ্ধরত থাকতে পারি না।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক