নতুন ১০ বিশ্ববিদ্যালয় চালু

সব দিক বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ শিক্ষকসহ মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫। এর মধ্যে ২৫টিই প্রতিষ্ঠা

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ শিক্ষকসহ মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫। এর মধ্যে ২৫টিই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে। অধিকাংশ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হয়নি মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ। অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব নিয়েই চালু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কর্মজীবনেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বেড়েছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। সরকারের শেষ সময়ে আরো ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন গত বছর সংসদে পাস হয়েছে। আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের খসড়া একই বছর সংসদে চূড়ান্ত হয়। এছাড়া বাকি ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ইতিবাচক মতামত দিয়েছিল। পুরনো অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে শিক্ষক সংকটসহ নানা সমস্যা। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিরসন করে মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা দরকার। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু মোটেই ভালো উদ্যোগ হবে না। শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত না করে এভাবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হলে উচ্চ শিক্ষার মানে আরো অবনমন ঘটবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালুর ক্ষেত্রে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব সংকট রয়েছে তা নিরসন করে মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করাও দরকার।

বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক, আবাসন, অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সংকট রয়েছে। ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি প্রোগ্রামে ন্যূনতম একজন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ শর্তই পূরণ করতে পারছে না দেশের ১৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কোনো অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক ছাড়াই। প্রায় এক দশক আগে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩টি বিভাগে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে দুজন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪টি বিভাগে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে দুজন অধ্যাপক। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন অধ্যাপক রয়েছেন। এ তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বশেফমুবিপ্রবিতে কোনো সহযোগী অধ্যাপক নেই এবং বশেমুরবিপ্রবি ও ববিতে সহযোগী অধ্যাপকের সংখ্যা যথাক্রমে ২০ ও ১১ জন। শিক্ষায় কম বাজেট এবং পরিকল্পনাহীন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোই এর প্রধান কারণ। তাই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে বাজেটের বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়া উচিত। মোট কথা, পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো ও শিক্ষক সংকটের সমাধান করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিকে এগোনো উচিত। বিগত সরকার যে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে, সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রেখে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট সমাধানের বিষয়ে বর্তমান সরকারকে ভাবতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ১৮৯টি সদস্য দেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির বিপরীতে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ভুটান। দেশটিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ মোট জিডিপির ৮ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া এ বরাদ্দের হার ভারত ও মালদ্বীপে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ও আফগানিস্তানে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ও জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অথচ ইউনেস্কোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ বাজেটের ১২ শতাংশের ওপর উঠছে না। এমনকি জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, বর্তমানে বেকারদের বড় অংশই উচ্চ শিক্ষিত এবং গত পাঁচ বছরে দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এ বেকারদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৭ লাখ ৯৯ হাজার, মোট বেকারের প্রায় ৩১ শতাংশই উচ্চ শিক্ষিত। এর আগে ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এ বেকার তরুণ গোষ্ঠীর মধ্যে ৪ লাখ ৫ হাজার জন ছিলেন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। সে হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় চার লাখ। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু না করে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটানো না গেলে সমাজে বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। এটি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, নীতি-নৈতিকতা, আইন, সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে, যা জাতিকে চরম মাত্রায় ভোগাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। তাই শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে এ খাতের বিনিয়োগে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ অতীব জরুরি।

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে তাদের মধ্যে নানা পার্থক্য বিদ্যমান। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও চীন সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির কথা বলা যায়, কিন্তু একটি জায়গায় তারা এবং যেকোনো উন্নত দেশ একই মতাদর্শে বিশ্বাসী—মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে তা তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি।

দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষককে বাদ দিয়ে বিগত বছরগুলোয় দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকের মারাত্মক সংকট রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ফলে বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালগুলোর উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করায় পদগুলো শূন্য হয়। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উপাচার্য নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু উপাচার্য নিয়োগ দিতে গিয়ে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় সরকারকে। যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষক না পাওয়ায় দীর্ঘদিন এসব পদ খালি রাখতে হয়েছে। বিগত সরকার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট সমাধান না করে এবং শিক্ষার মানের গুরুত্ব না দিয়ে কেবল সংখ্যা বাড়িয়েছে। মান ও পরিকল্পনাহীন বিশ্ববিদ্যালয় চালুর মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার মানে মারাত্মক অবনমন ঘটানো হয়েছে। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে দলীয় শিক্ষকের পদায়নের মাধ্যমে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দলীয় অনুগতদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা খাতের মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে যোগ্য অভিজ্ঞদের মূল্যায়ন করা দরকার। এটি করা না গেলে জাতিকে আরো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।

শিক্ষার মান নিশ্চিতে শিক্ষকদের নিয়োগ পদ্ধতি ও পদোন্নতি নীতিমালা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক রাজনীতির কারণে পুরো ব্যবস্থাটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আগে ক্লাসের ভালো শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতেন বা শিক্ষক হতে চাইতেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দলীয় পরিচয় থাকলেই যোগ্যতার শর্ত শিথিল করেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেগজনক। অনেক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষার্থী দেশে ভালো সুযোগ না পেয়ে এবং বেতন কম হওয়ায় তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এতে ক্ষতি দেশেরই হচ্ছে। তাই শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা কঠিন ও যুগোপযোগী করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য একটি যুগোপযোগী বেতন স্কেল তৈরি করতে হবে। শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটাতে হলে এ দুটোকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু না করে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব সংকট রয়েছে তা নিরসন করে মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

আরও