সড়কে আয়ের মাত্র ২১% ব্যয় হয় রক্ষণাবেক্ষণে

উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়তে রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে

উন্নত সড়ক ব্যবস্থা যেকোনো দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনজীবনের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে দুঃখজনকভাবে, নিম্নমানের নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশের বেশির ভাগ সড়ক টেকসই হয় না।

উন্নত সড়ক ব্যবস্থা যেকোনো দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনজীবনের মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে দুঃখজনকভাবে, নিম্নমানের নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশের বেশির ভাগ সড়ক টেকসই হয় না। সাধারণত একটি সড়ক নির্মাণের পর তা ১০-১৫ বছর টেকসই হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণের পর তা দুই বছরের বেশি টেকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা খানাখন্দে ভরে ওঠে সড়ক। আবার সামান্য ক্ষয়প্রাপ্ত সড়কগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একসময় প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি প্রায় সময়ই উপেক্ষিত থেকে গেছে। বিশেষ করে সড়ক থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের পরও তা রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয় চাহিদার তুলনায় অনেক কম, মাত্র ৩৩ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ২১ শতাংশ। যেখানে সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। বলা বাহুল্য, প্রয়োজনের তুলনায় এ ব্যয় অত্যন্ত নগণ্য হওয়ায় দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের একটি বড় অংশই থেকে যাচ্ছে ভাঙাচোরা দশায়। এডিবির ওই প্রতিবেদনে প্রতি বছর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে কত টাকা প্রয়োজন সেটিও উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক, যার ৪৫ শতাংশ পাকা। আর এসব সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর ২৬ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা প্রয়োজন।

  • এ বাস্তবতায় উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়তে হলে প্রথমেই প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ কম হওয়ায় দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের উল্লেখযোগ্য অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় ভাঙাচোরা অবস্থায় থাকবে, এটি কখনই প্রত্যাশিত নয়। তাও আবার যখন এ খাত থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ আয় হয়। তবে যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ যথাসময়ে কাজ করতে না পারা। এর পেছনেও অপ্রতুল বরাদ্দের দায় রয়েছে। ‌অর্থের অভাবে সময়মতো সড়ক মেরামতের কাজ না হওয়ার কারণেও তা বেহাল অবস্থায় চলে যায়। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় চক্রাকারে বাড়তে থাকে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মতো সংস্থাগুলো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকলেও বরাদ্দ সংকটে তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
  • দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সওজ। সংস্থাটির আওতাভুক্ত জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার। অন্যদিকে দেশের পাকা সড়ক নেটওয়ার্কের সিংহভাগ অংশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে এলজিইডি। ১ লাখ ৬১ হাজার কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক রয়েছে সংস্থাটির আওতাধীন। এলজিইডি মূলত উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। জানা যায়, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি বছর একটি চাহিদা প্রতিবেদন তৈরি করে সওজ, যার আলোকে বরাদ্দের জন্য প্রস্তাব করে সংস্থাটি। প্রয়োজনের বিপরীতে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রাপ্ত বরাদ্দের বিষয়ে সওজ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, অনেক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের অভাবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। অর্থাৎ একদিকে বরাদ্দ কম, অন্যদিকে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা—সহজেই অনুমেয় এসব কারণ দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের মানোন্নয়নকে আরো কঠিন করে তুলেছে। এদিকে বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, এলজিইডি টেকসই সড়ক নির্মাণে জোর না দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। কেবল গত অর্থবছরের হিসাবেই প্রতি কিলোমিটার পল্লী সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয়েছে নির্মাণের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অর্থ। এভাবে সরকারি টাকা অপচয় না করে সরকারকে তাই টেকসই সড়ক নির্মাণের দিকে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
  • সুতরাং কেবল রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অনিয়মগুলো দূর করতে হবে। একই সঙ্গে নজর দিতে হবে সড়ক ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দিকে। সড়ক ব্যবহারের মাধ্যমে আয়কৃত অর্থের একটি অংশ রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি, সময়মতো সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। এতে রাস্তাগুলোর স্থায়িত্ব বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে সরকারের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমে আসবে। এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও সঠিক নীতিমালা জরুরি।
  • বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নে একটি টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এডিবির প্রতিবেদনে সড়কের ১২টি খাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যদি সরাসরি রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলে রাখা যায়, তবে প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ সময়মতো সম্পন্ন করা সম্ভব। আর দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করলে দেশের সড়ক নেটওয়ার্ককে ভাঙাচোরা দশা থেকে মুক্ত করা যাবে। তবে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর টেকসই উন্নয়নে নির্মাণ মান ভালো হওয়া অন্যতম পূর্বশর্ত।
  • টেকসই যোগাযোগ অবকাঠামো কেবল যাতায়াত বা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে প্রয়োজন, তা নয়। নিরপাদ সড়কের জন্য এটি প্রয়োজন। রক্ষণাবেক্ষণ খাতে অবহেলার ফলে সড়ক ব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। এতে যানবাহন মেরামত ও ব্যবসায়ীদের খরচ, জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যায়। পাশাপাশি ভাঙাচোরা সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনার হারও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অন্যতম অন্তরায় সড়ক অব্যবস্থাপনা। বাণিজ্য সম্প্রসারণে এটি একটি বাধা হিসেবে কাজ করে। সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা সত্ত্বেও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দের এ ঘাটতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ খাতে ব্যয় আরো বাড়বে এবং এসব ভোগান্তিও দীর্ঘায়িত হবে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই কার্যকর তহবিল গঠন, সময়মতো সংস্কারকাজ সম্পন্ন এবং বরাদ্দ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। সরকারের সদিচ্ছা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমেই এ সংকট নিরসন সম্ভব।

আরও