অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে পারে ক্ষুদ্র উদ্যোগের বিকাশ

সিএমএসএমই খাতের বিকাশে উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও বাজার নিশ্চিত করা জরুরি

গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই)। বিশ্বজুড়েই ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এ খাত।

গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই)। বিশ্বজুড়েই ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এ খাত। সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি করছেন ঠিকই, তবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজনে এ খাতের ভূমিকা এখনো আশানুরূপ নয়। এক্ষেত্রে অর্থায়ন প্রাপ্তির জটিলতা, দক্ষতার অভাব, রাজস্ব নীতিমালা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে দেশের তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে বিশেষ করে সেবা খাতের বিকাশ একান্ত অপরিহার্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে সিএমএসএমই খাতের বিকাশ। এজন্য এ খাতের উন্নয়নের পথ সুগম করতে মানুষের ভাবনা ও চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে এবং সুযোগের বৈষম্য দূর করতে হবে। পাশাপাশি উদ্যোগ উন্নয়নে সমাজের প্রান্তিক জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

দেশে বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় কর্মসংস্থানে গতিশীলতা নেই। নতুন শিল্প গড়ে না ওঠায় বেকারত্ব ক্রমেই বাড়ছে। বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধিহীন জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। স্থবির কর্মসংস্থানে গতি ফেরাতে হলে সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও বিনিয়োগের বিকল্প নেই। ঋণদানকারী সংস্থাকে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি উদ্যোক্তাকে কারিগরি প্রশিক্ষণ, বাজার তথ্য সরবরাহ, প্রযুক্তিগত ধারণাসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করাও জরুরি। অর্থাৎ উদ্যোক্তার ব্যবসা পরিচালনার মতো সক্ষমতা তৈরিতে ঋণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। সিএমএসএমই খাতকে বিকশিত করতে সঠিক কৌশল ও নীতি গ্রহণ জরুরি। এমএসএমই খাত বিকাশ প্রধানত ছয়টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ‘খসড়া এসএমই নীতি-২০২৫’-এ। সেগুলো হলো—ক. অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ, খ. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ, গ. বাজার প্রবেশের সুযোগ, ঘ. উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ, ঙ. ব্যবসা সহায়ক সেবা প্রাপ্তির সুযোগ, চ. প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ।

বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের অর্থনীতিতে সিএমএসএমই খাতের অবদানের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তবে এ খাত নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের তথ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সে তথ্য অনুযায়ী, দেশে কুটির শিল্পসহ প্রায় ৭৮ লাখ এমএসএমই শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ খাতে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ জনবল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত আছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপি প্রায় ৪৫১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার হলেও এমএসএমই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির মাত্র দশমিক ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের এমএসএমই খাত জিডিপিতে প্রায় ৮০ শতাংশ, চীনের ৬০ শতাংশ এবং জাপানের ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ অবদান রাখে, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। জার্মানির বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের, যা প্রায় ৮২ শতাংশ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে এবং মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রায় ১৭ শতাংশ অবদান রাখে। এশিয়ায় চীন ও ভারতের এমএসএমই খাত রফতানিতে আরো বেশি কার্যকর, যেখানে এমএসএমই থেকে মোট রফতানির ৪০ শতাংশেরও বেশি আসে। এ হার থাইল্যান্ডে ২৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯ ও ইন্দোনেশিয়ায় ১৬ শতাংশ। ফলে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের মতো উন্নত অর্থনীতিগুলোয়ও এমএসএমই খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাতের অবদান আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ এ খাতের উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় আকারের শিল্পের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এসএমই খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে ১৯৭৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের এসএমই খাতের উৎপাদনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এরপর থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এ খাতের উৎপাদন ৫-৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই স্থিতিশীল ছিল। ১৯৯২ সালের পর এ খাতের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৪ সালে এসএমই খাতের উৎপাদন দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ২০০০ সালে এটি আরো বেড়ে ৯ হাজার ৪৩৩ কোটি হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরে এটি ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে ২০০৫ সালে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকায়। এর ১০ বছর পর ২০১৫ সালে এসএমই খাতের উৎপাদন দাঁড়ায় ২০ হাজার ৪০ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল নাগাদ এটি বেড়ে ৪৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তবে বর্তমানে কৃষিভিত্তিক পণ্যসহ ছোট আকারের নানা ধরনের উৎপাদন ও সেবামুখী সিএমএসএমই উদ্যোগগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এতে গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সিএমএসএমই উদ্যোগের বড় একটি অংশই কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় গড়ে উঠেছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা ও ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির জন্য সহজ অর্থায়ন সুবিধা প্রয়োজন। সরকারের দিক থেকে সিএমএসএমইদের জন্য অর্থায়ন বাড়ানো ও সহজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদিও এখনো অনেক সিএমএসএমই উদ্যোগ অর্থায়ন সুবিধার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা। ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসারের সুবাদে অনেক নারী উদ্যোক্তা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হচ্ছে সিএমএসএমই খাতের মাধ্যমে। ছোট আকারের কৃষি উদ্যোগ কিংবা পশুপালন খামার, ছোট আকারের উৎপাদনমুখী শিল্প কিংবা সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অসংখ্য উদ্যোক্তা নিজেদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি আরো অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এসব উদ্যোগের কোনো কোনোটি ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে নিজেদের আরো বড় পরিসরে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও টেকসই শিল্পায়নে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ খাতের বিকাশে ঋণদানকারী সংস্থাগুলোকে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, জমির ব্যবস্থা, বাজারের তথ্য প্রদান, প্রযুক্তি সক্ষমসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ নিশ্চিত করা উচিত। এসব সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে খাতটির পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব। এছাড়া খাতটির উন্নয়নে দরকার পর্যাপ্ত অর্থায়ন সুবিধা নিশ্চিত করা, রফতানির সুযোগ বৃদ্ধি ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে সিএমএসএমই উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিতকরণ। সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা এ খাতের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খসড়া এসএমই নীতি-২০২৫-এর আওতায় এসএমই খাতের জন্য সহায়ক নীতি সহায়তা, প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা এবং উদ্যোক্তাদের আর্থিক ও ব্যবসায়িক সেবা সহজতর করার জন্য একটি স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। এসএমই খাতের বিকাশে সরকারের এ নীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে প্রত্যাশা। এসএমই খাতের বিকাশে ব্যবসায়িক কাজে সম্পৃক্ত সব ধরনের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল কার্যক্রমের আওতায় আনয়ন, রাজস্ব কাঠামোর সংস্কার, শুল্ক ব্যবস্থাপনা সহজ করা, লজিস্টিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, অর্থায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, সিএমএসএমইর বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে দক্ষতা বাড়ানো ও পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আসন্ন বাজেটে সিএমএসএমই খাতকে গুরুত্ব দেয়া হবে—এ প্রত্যাশা সবার।

আরও