ঢাকার যানবাহনের ৪৯ শতাংশই মোটরসাইকেল ও অযান্ত্রিক

উন্নত গণপরিবহন সেবা ছাড়া ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় মানুষের নিত্যদিনের যাতায়াতের জন্য সেখানে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে সড়কে গাড়ির সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকে, শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হয়।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় মানুষের নিত্যদিনের যাতায়াতের জন্য সেখানে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে সড়কে গাড়ির সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকে, শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হয়। কিন্তু ঢাকার সড়কে এর ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এখানে একদিকে উন্নতমানের গণপরিবহন সেবা খাত গড়ে তোলা যায়নি, অন্যদিকে বেড়েছে মোটরসাইকেল ও অযান্ত্রিক গাড়ির সংখ্যা। বণিক বার্তার প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ঢাকার প্রায় প্রতিটি মোড়েই যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা মোটরসাইকেলচালক এবং ঢাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বাদে সব রাস্তা আর মোড়ে দেখা মিলছে পায়ে নয়তো ব্যাটারিচালিত রিকশার। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় বর্তমানে সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছে এ ধরনের বাহন। ছোট ছোট এসব যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহনের কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। সেই সঙ্গে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঢাকার জন্য সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) হালনাগাদ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক সমীক্ষা পরিচালিত হয়। অবশ্য যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজ এখনো চলমান। এ সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ঢাকায় যত যানবাহন চলছে, তার ৪৯ শতাংশ মোটরসাইকেল এবং রিকশা-ভ্যানের মতো অযান্ত্রিক বাহন (সড়ক পরিবহন আইনে ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার মতো বাহন ‘‌মোটরযান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত নয়)।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, মোটরসাইকেল, রিকশা, প্রাইভেট কার, থ্রি-হুইলারের মতো যানবাহন ঢাকার সড়কের বেশির ভাগ দখলে রাখছে। এসব ছোট ছোট যান বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে। কারণ এসব যানবাহনকে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনা বেশ কঠিন কাজ।

২০১৪ সালে যেখানে মোটরসাইকেল ছিল যানবাহনের মাত্র ১১ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশে। একই সঙ্গে বেড়েছে রাইডশেয়ারিংয়ের জনপ্রিয়তা, যা দুই চাকার এ বাহনটির বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশার মোট সংখ্যা কত তা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে, ঢাকায় এ ধরনের বাহন রয়েছে ১৬ লাখের বেশি। এগুলোর বেশির ভাগই কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চলছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উতরানোর উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই বলে আসছেন বড় বাসভিত্তিক গণপরিবহন ব্যবস্থার কথা। সেই সঙ্গে ছোট যানবাহনের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে।

দুঃখজনকভাবে এখন পর্যন্ত গণপরিবহন সেবার মানোন্নয়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং ছোট বাহনগুলো এক ধরনের চাপ ‍সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, যার দৃষ্টান্ত চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে। ঢাকায় পায়ে চালিত ও মোটরচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনও হয়েছে। এভাবে তারা বরং নীতিনির্ধারকদের চাপের মধ্যে রেখেছে।

এ পরিস্থিতির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সব তদারকি সংস্থা দায়ী। বিআরটিএ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের অব্যবস্থা ও সমন্বয়হীনতার ফলে ঢাকার সড়কে অনিয়ন্ত্রিত ও অনুমোদিত পরিবহনের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে মোটরচালিত রিকশার আধিক্য বেড়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার একটা নিরাপদ মডেল তৈরি এবং এ ধরনের রিকশা নিবন্ধন দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে, যেগুলো দিয়ে পর্যায়ক্রমে বর্তমানের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে নিরাপদ অটোরিকশা দিয়ে রিপ্লেস করা হবে। এটা আশার কথা হলেও ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে উন্নত মানের গণপরিবহন প্রচলনের বিকল্প নেই। অবশ্য ঢাকায় ছোট যানবাহনের পরিবর্তে উন্নত ও আধুনিক বাস প্রবর্তনের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন হোক এ প্রত্যাশা রয়েছে।

ঢাকার যানজট ও সড়ক নিরাপত্তা সংকটের সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। কিন্তু এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বড় বাসভিত্তিক পরিবহন, আধুনিক ট্রানজিট ব্যবস্থা এবং ছোট যানবাহন ব্যবস্থাপনায় সুস্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা, জনসচেতনতা ও প্রশাসনিক সহযোগিতা জরুরি।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনায় যে ঢাকার সড়কের বর্তমান দুর্দশা তা অস্বীকারের অবকাশ নেই। অনুমোদনহীন ব্যাটারিচালিত রিকশার ঢাকায় প্রবেশ ও স্থানীয়ভাবে সংযোজন ও উৎপাদন—এসবই হয়েছে কার্যত কার্যকর নীতিমালা ও সুষ্ঠু নজরদারির অভাবে। তাই সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

রাজধানীতে এত ছোট যানের আধিক্য হওয়ার পরও অধিকাংশ মানুষ যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন হিসেবে বাসের ওপর নির্ভরশীল। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকা ও আশপাশে গণপরিবহনের যাত্রীদের ৫৮ শতাংশ বাসে যাতায়াত করে। বাস-মিনিবাস, সিএনজি অটোরিকশা ও কার—এ তিন শ্রেণীর যানের মধ্যে বাস-মিনিবাসে ৭২ শতাংশ ট্রিপ (যাত্রা) হয়। যদিও সড়কে চলাচলকারী বেশির ভাগ বাস ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর বাস বলে অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং যদি উন্নত মানের গণপরিবহন হিসেবে বড় ও ফিট বাস সড়কে নামানো যায় তবে মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতের দিকে আরো ঝুঁকবে বলে আশা করা যায়।

ছোট যানবাহন পুরোপুরি বন্ধ করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবাস্তব। তাছাড়া এর সঙ্গে বহু মানুষের জীবিকা অর্জনের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। তাই পুরোপুরি বন্ধ না করে ছোট যান চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়মাবলির যথাযথ পরিপালন আবশ্যক এবং দীর্ঘমেয়াদে এসব যানের চালকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ততদিন পর্যন্ত সড়কের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের মতো বিভিন্ন যানবাহনের চলাচল নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তথ্য বলছে, দেশে প্রতিদিন যত সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তার প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী ফিটনেসবিহীন যান। সুতরাং এসব যান চলাচল বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মূলত এমন সব নীতি ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে, যা ঢাকার সড়কের দীর্ঘদিনের সমস্যার টেকসই সমাধান দেবে।

আরও