সরকারের কথা ব্যবসায়ীরা শোনেন না—এ কথা কি বিশ্বাস করা যায়? নিশ্চয়ই না। সরকারের ক্ষমতা ও অধিকার অফুরন্ত। তার হাতে আইন রক্ষাকারী বাহিনী, নানা ধরনের আইন এবং আইন বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে অনেক ব্যবস্থা। রয়েছে কোর্ট-আদালত। এক কথায় সরকার পারে না—এমন কিছু এ জগতে নেই। না, এর পরও দেখা যায়, সরকার সবকিছু পারে না। সরকার অনেক কিছুতে ব্যর্থ। ব্যর্থ বড় শক্ত কথা। বলা যায় সরকার অসহায়। এ কথা কীভাবে বলছি। বলছি খবরের একটি শিরোনাম পাঠ করে। শিরোনামটি হচ্ছে ‘আলুর সিন্ডিকেট মানুষের টাকা শুষে নিয়েছে, কিছু করতে পারিনি’ (৬.১০.২৩)। কী মারাত্মক অভিযোগ। কে করেছেন এ অভিযোগ। অভিযোগটি করেছেন আর কেউ নন, প্রভাবশালী কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, ‘সিন্ডিকেট করে আলুর কোল্ড স্টোরেজগুলো সাধারণ মানুষের টাকা শুষে নিয়েছে। আমরা অসহায় হয়ে দেখেছি, কিছু করতে পারিনি। আমরা বেশি চাপ দিলে তারা বাজার থেকে আলু তুলে নিয়ে যায়।’ কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আলুতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আলুতে আমাদের ঘাটতি নেই। গত বছর আলুতে কৃষক দাম পাননি, তাই এ বছর তারা বেশি আলু চাষ করেননি। সে সুযোগে এ বছর সিন্ডিকেট করে একটা অবস্থা সৃষ্টি করেছে। সিন্ডিকেটের কারণে আমাদের মাঝেমধ্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।’ উদ্ধৃতিটি একটু বড় হয়ে গেল। উপায় নেই। অবস্থাটা বোঝার জন্য, অসহায়ত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে উদ্ধৃতিটি বড় করলাম। বলা বাহুল্য, মন্ত্রী মহোদয় এসব কথা বলেছেন একটা প্রেক্ষাপটে। প্রেক্ষাপট হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দাম অমান্য করার ঘটনা।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ‘উড়ন্ত’ বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ছয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। বলা হয়, এ দাম ব্যবসায়ীদের মানতে হবে। যে ছয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় সেগুলো হচ্ছে—আলু, ডিম, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, খোলা চিনি ও রান্নার গ্যাস। নির্ধারণের পর অনেক দিন গত হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত দাম এখনো বাজারে কার্যকর হয়নি। ব্যবসায়ীরা যথেচ্ছ হারে এসব পণ্যের দাম যার কাছ থেকে যেমন পারা যায় সেভাবে নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতেই কৃষিমস্ত্রী ‘সিন্ডিকেটকে’ দোষারোপ করে বক্তব্য রেখেছেন। অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছেন। এর আগে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের কথা বলেছিলেন। তার মুখে ও কথায় ছিল একই সুর। ‘সিন্ডিকেট’ যা ইচ্ছা তাই করছে। বাজার থেকে পণ্য উধাও করে নেবে এ ভয়ে সরকার কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না বলে তিনি দুঃখ করেছিলেন। এরও আগে আমাদের শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার তার এক সাক্ষাৎকারে সিন্ডিকেটের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন তাদের দাপটের কথা। অবশ্য আমাদের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ সম্পর্কে বহুবার বহু কথা বলেছেন। তিনি সরকারের ভেতরে সরকারের কথাও বলেছিলেন। এসব এখন অতীত। কিন্তু যা অতীত নয়, তা হচ্ছে সিন্ডিকেট। সব পণ্যেই এ সিন্ডিকেটের জন্ম হয়েছে।
ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতারা এখন অনেক সাবালক। তারা দিনে দিনে অনেক বড় হয়েছেন। ধনী হয়েছেন, ধনাঢ্য হয়েছেন, কেউ কেউ অতিধনী হয়েছেন। এর মধ্যে আছে চাল, ডাল, নুন, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, আদা, রসুন, সয়াবিন থেকে শুরু করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য। এরা নিজেদের টাকায় যতটুকু বড় হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি বড় হয়েছেন ব্যাংকের ‘ লোনে’, ব্যাংকের টাকায়। তারা এখন মনে হচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। একসময় আমাদের ব্যবসায়ীরা নানা ব্যবসায় পয়সা কামাতেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন, কিন্তু তারা ভোগ্যপণ্য নিয়ে কারসাজি করতেন না। বেশ কয়েকটি ‘হাউজ’ এখনো আছে যারা ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় আসেনি। তখনকার ব্যবসায়ীরা মনে করতেন আর যা-ই হোক ভোগ্যপণ্য নিয়ে, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে খেলাধুলা করা উচিত নয়। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। এখন দেখা যাচ্ছে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্যকেই টাকা বানানোর অন্যতম অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করছেন। তা না হলে এমন কেন হয়? যে গোল আলুতে আমরা বরাবর উদ্বৃত্ত, সে আলুও সিন্ডিকেটের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের অভাব হয়। টাকা দিয়েও চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন আমাদের একজন জনপ্রিয় শিল্পীকে দিয়ে আলুর উপকারিতার ওপর গান রচিত হয়েছিল। দিনের পর দিন তা ‘টিভিতে’ আমরা শুনেছি। এমন কী ঘটল দেশে যে আলুর অভাব ঘটল? সরকারি বিভাগগুলো বলছে আলুর উৎপাদন পর্যাপ্ত। সরবরাহ ঠিক আছে। চাহিদাও ঠিক আছে। তাহলে বাজারে কোন যুক্তিতে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হবে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায় না। যার জবাব পাওয়া যায় তা হচ্ছে সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেট থাকবে। তাহলে করণীয়?
একটা করণীয় কথা আমি বলতে পারি। সিন্ডিকেট যখন ভাঙা যাবে না, তখন তো আর বসে থাকা যায় না। অন্তত একটি কাজ তো করা যায়। তাদের ওপর তো করারোপ করা যায়, তাদের অতিরিক্ত আয়ের ওপর, ‘উইন্ডফল গেইনসের’ ওপর তো করারোপ করা যায়। এর যুক্তি কী? এটা একটা উদাহরণ দিই, সেটা গত বিশ্বমন্দা কালের ঘটনা। বারাক ওবামা তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। মন্দার সময় তিনি বড় বড় বেতনধারী নির্বাহী ও ব্যাংকারদের বললেন বেতন-ভাতা কম নিতে। তারা সমন্বয়ে বলে উঠলেন—অসম্ভব। বেতন-ভাতা-বোনাস ইত্যাদি আমাদের পাওনা। এটা চুক্তির বিষয়। আমরা বেতন-ভাতা বোনাস কেন কম নেব? এটা আমাদের অধিকার। বারাক ওবামা তখন বলেছিলেন ঠিক আছে এটা তোমাদের অধিকার; রাষ্ট্রের, সরকারেরও ক্ষমতা ও অধিকার আছে। তোমাদের ওপর অধিকতর ট্যাক্স করার। বেতনভোগী নির্বাহীরা বিষয়টি বুঝলেন। ট্যাক্সের সঙ্গে পারা যাবে না। তারা নরম হলেন। বিষয়টির সম্মানজনক পরিসমাপ্তি ঘটল। এক ধমকে কাজ হলো। অবশ্য ধমক নয় শুধু, ধমক যে বাস্তবে পরিণত হবে তার ইচ্ছাশক্তিও প্রেসিডেন্ট দেখিয়েছিলেন। এ উদাহরণ দিলাম এ কারণে যে সরকার ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে পারছে না, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কিন্তু তাদের ওপর করারোপে বাধা কোথায়? সরকার নির্বাহী আদেশবলে তা করতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনায়াসে তা করতে পারে। দরকার শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা। প্রশাসনিক আদেশ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। অথচ এটা করা দরকার। কারণ কী? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর কর বাড়ানোর জন্য ভীষণ চাপ আছে। এ মুহূর্তে দেশে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের’ (আইএমএফ) একটি পর্যবেক্ষণ দল কাজ করছে। তারা আমাদের রাজস্ব আদায়ে নিম্নগতি দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বলে খবরে দেখলাম। অবশ্য তাদের অসন্তোষ প্রকাশের কারণেই যে বাড়াতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। অমাদের প্রয়োজনেই রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে—এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত খুবই নিচু। বহুদিন ধরে চেষ্টা হচ্ছে কর রাজস্ব বৃদ্ধির। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অথচ এর জন্য ‘এনবিআর’ ভীষণ চাপের মুখে। ‘এনবিআর’ চাপে পড়ে কীভাবে, কী করবে অনেক সময় বুঝে উঠতে পারছে না। পথ না পেয়ে এমন সব পন্থা গ্রহণের পথে যাচ্ছে, যা খুবই অজনপ্রিয়। যেমন সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর কর। ছিল সেটা ‘ফাইনাল সেটেলমেন্ট’। করা হলো একে করযোগ্য। অবশ্য পরে তা তুলে নেয়া হয়। জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট নিবন্ধনে অতিরিক্ত করারোপ করতে গিয়ে দেখা গেল আবাসন ব্যবসার মর মর অবস্থা। শেষ পর্যন্ত করের হার কমানো হলো। এমন অনেক উদাহরণ আছে। অথচ এ দুর্দিনে রাজনৈতিক আদেশ পেলে ‘এনবিআর’ অত্যন্ত দক্ষভাবে ‘উইন্ডফল গেইনসের’ ওপর করারোপ করতে পারে। যেমন ‘সারচার্জ’ প্রয়োগ।
প্রশ্ন হবে ‘উইন্ডফল গেইনস’-এর হিসাব কীভাবে হবে? ধরা যাক আলুর কথা। কত আলু কোল্ড স্টোরেজে ঢুকেছে তার রেকর্ড অছে। কত আলু কোল্ড স্টোরেজ থেকে বেরিয়েছে তার রেকর্ড আছে। বলা হতে পারে কম দামে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বেরিয়েছে। কিন্তু কথা আছে। বিক্রির টাকা ব্যাংকে ঢুকেছে। ব্যাংকে রেকর্ড আছে কত টাকা ঢুকেছে। অধিকাংশ কোল্ড স্টোরেজেই ব্যাংকের ঋণ আছে। অতএব, আলু ঢোকানো, আলু বের করার হিসাব ব্যাংকেও আছে। এসব রেকর্ডপত্র দেখলেই বোঝা যাবে অতিরিক্ত আয় তারা কত করেছে। এছাড়া রয়েছে অনেক ‘মেথড’ যা ‘এনবিআর’-এর কর্মকর্তারা জানেন। এটা করলে ফল হতে পারে। এদিকে আলুসহ অন্যান্য ‘উইন্ডফল গেইনসের’ ব্যবসায়ীরাও দাবি করতে পারবেন যে তারা দেশের এ প্রয়োজনের দিনে বেশকিছু অবদান রেখেছেন। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলাম, ট্যাক্স তো আদায় করলাম। অধিকন্তু সিন্ডিকেটের ব্যবসাও কিছুটা নিরুৎসাহিত হলো।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক