'টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি যেন এক হারিয়ে যাওয়া পর্বতের স্মৃতি'

ভাসানীই প্রথম তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতার ইস্যুকে বারবার সামনে নিয়ে এসেছেন। যেমন তিনি ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ভাষার অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ব্রিটিশ গর্ভনেমেন্টের গোলামী করি নাই। ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: প্রথম খণ্ড)।

‘টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি যেন এক হারিয়ে যাওয়া পর্বতের স্মৃতি’ কবি আল মাহমুদের বিখ্যাত কবিতার লাইন। এই টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি আফ্রো-এশিয়ার নিপীড়িত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মহান মানুষটি চিরতরে পরপারে পাড়ি জমান। বিংশ শতকে ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলনের নায়ক, ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির অন্যতম নেতা; ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা—সেই মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

জন্ম-পরিচয়: ১৯৭৩ সালের সর্বশেষ পাসপোর্ট অনুযায়ী মওলানা ভাসানীর জন্ম ১২ ডিসেম্বর, ১৮৮০। জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের সয়া-ধানগড়া গ্রামে। পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খাঁ, মাতার নাম মজিরন বিবি। ডাক নাম চেগা মিয়া। শিশু বয়সে মারা যান তাঁর বাবা। এর কিছুদিন পর মহামারীতে মা। এরপর কালের অগ্রযাত্রায় চেগা মিয়াই একদিন ইতিহাসের নক্ষত্র হয়ে ওঠেন।

সাদাসিধে জীবন: ভাসানীর জীবন-যাপন কেমন ছিল তা একটা ঘটনার বর্ণনায় ফুটে ওঠে। সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, মওলানা ট্রেনে সফরসঙ্গীদের নিয়ে রওনা হন চট্টগ্রামের উদ্দেশে। তাঁর সঙ্গে একই কম্পার্টমেন্টে ছিলেন আবদুল হক, ডা. টি. আলী প্রমুখ। আখাউড়া জংশনে ট্রেন বদল করতে হবে। আখাউড়ার ন্যাপ নেতাকর্মীদের সংবাদ দেওয়া হয়েছিল, মওলানা সেখানে ট্রেন বদলাবেন। ওখানকার দুয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁর লাগেজ ঠিকমতো চট্টগ্রামের ট্রেনে তোলার। মওলানা স্টেশনে নেমে রেলওয়ের কর্মচারী ও জনতার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে দ্রুত গিয়ে চট্টগ্রামমুখী ট্রেনে ওঠেন। একজন দলীয় কর্মী একটি ছোট বালিশ নিয়ে তাঁর পিছে পিছে কম্পার্টমেন্টে ঢুকেন। এর মধ্যে আখাউড়ার যাদের ওপর মওলানার লাগেজ চট্টগ্রামের ট্রেনে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারা হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ওই ট্রেনের কামরায় হুজুরের লাগেজ পাওয়া যাচ্ছে না। মওলানার এক সহচর বললেন, কিসের লাগেজ? ‘হুজুরের জিনিসপত্র। ব্যাগট্যাগ।’ সহচর বালিশটি দেখিয়ে বললেন, হুজুরের সঙ্গে তো শুধু এই বালিশ আর একটা গামছা। ওনার একটা লুঙ্গি আমার কাপড়ের ব্যাগটায় আছে। আর তো কোনো জিনিস নাই। এইগুলোই তো লাগেজ। কর্মীরা লজ্জিত ও বিস্মিত হয়ে দ্রুত ট্রেনের কামরা থেকে নেমে যান (মওলানার লাগেজ কোথায়, সৈয়দ আবুল মকসুদ)।

কেমন মওলানা: জীবনে অনেকেই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন তার নামের আগে মওলানা কেন, ব্যক্তি বুঝে তিনি জবাব দিতেন। একবার মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত একজন মওলানা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর, আপনিও মওলানা, আমরাও মওলানা; আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? তিনি মুহূর্তের মধ্যে বললেন, ‘তোমরা সেই মওলানা যারা দূরে শয়তান দেখলে ‘লা হাওলা ওলা’ পড়, আমরা সেই মওলানা যারা শয়তানকে আগে কাছে ডাকি তারপর শয়তানের ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়ে শয়তানকে দিয়ে আমাদের কাজ করায়ে নেই।’

কখন থেকে তিনি ভাসানী: আবদুল হামিদ খান যে গ্রামে বাস করতেন সে গ্রামের নাম ছিল ভাসানের চর। দশ সহস্রাধিক অধিবাসী সংবলিত এ গ্রামের সবাই ছিলেন মওলানার ভক্ত-মুরীদান। গ্রামবাসী দিন দিন মওলানা সাহেবের সুনাম, যশ ও ব্যাপক পরিচিতি লক্ষ করে গর্বিত হতে থাকে, কারণ মওলানা তাদের গ্রামের বাসিন্দা। এরপরে ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসান চরে এক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন গ্রামের সবাই মিলে মওলানাকে ধরে বসেন এই বলে যে, তার নামের সঙ্গে গ্রামের নামটি জুড়ে দিতে হবে। তখন থেকে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায় ‘ভাসানী’ (জানা অজানা মওলানা ভাসানী, আবদুল হাই শিকদার)।

ভাসানীর রাজনৈতিক ধারা: ভাসানীর রাজনৈতিক ধারা তাঁর নিজস্ব। উপমহাদেশের কোনো প্রধান রাজনৈতিক ধারাকে তিনি অনুসরণ করেননি। রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি মাওপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাঁকে ‘লাল মওলানা’ নামে ডাকতেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, খেলাফতে আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তবে ১৯২৬ সালে আসামে প্রথম কৃষক প্রজা পার্টি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানোর মধ্য দিয়ে কৃষক নেতা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দেওবন্দের প্রভাবও ছিল। যার কারণে আমরা তাঁর রাজনৈতিক ধারায় কমিউনিজম ও ইসলামকে একসঙ্গে দেখেছি। তিনি একদিকে কমিউনিস্টদের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন; অন্যদিকে নিজের ঈমান-আকিদার সঙ্গে একতিলও আপস করেননি। তিনি নিজের চিন্তার মধ্যে এই আত্মীকরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা ও মওলানার মোনাজাত: ১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী আসাম থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর প্রথম সবচেয়ে বড় জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে। তৎকালীন সরকার সেই জনসভা পণ্ড করে দেওয়ার পদক্ষেপ নেয়। সরকারের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে জনতার ভেতর থেকে একদল লোক হৈ চৈ শুরু করে। তখন সভাপতির আসন থেকে উঠে এসে মওলানা ভাসানী মাইকের সামনে দাঁড়ান। বলেন, ভাইয়ো, সরকার আমাদের সভা পণ্ড করতে চায়। এ অবস্থায় আমরা সভা করব না। আপনারা শান্ত হয়ে যার যার জায়গায় দাঁড়ান। আমরা আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে সভা শেষ করব। এই কথা বলেই মওলানা ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ বলে মোনাজাত শুরু করলেন। সভার সব শ্রোতাও হাত তুলে ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ বলে দাঁড়িয়ে যায়। মোনাজাতকারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হিন্দু এবং কমিউনিস্ট ছিল। মওলানা আরবিতে দুয়েকটি মোনাজাতের দোয়া পাঠ করেই বলতে থাকেন: ‘হে দীন দুনিয়ার মালিক পরওয়ারদেগার, জালেমের অত্যাচার থেকে তুমি মজলুমকে রক্ষা করো।’ মোনাজাতে পরকালের কোনো কথা ছিল না। ছিল সরকারের অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের কথা। তা থেকে মুক্তির জন্য জেহাদ ঘোষণার কথা। মাঝে মাঝেই শ্রোতা-মোনাজাতকারীরা ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ বলতে থাকেন। কিন্তু মোনাজাত আর শেষ হয় না। মোনাজাতের মধ্যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। পাকিস্তানের দুই বছরের অন্যায়-অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইসলামের শিক্ষা—তাও বলা হয়। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মোনাজাত চলে। সমাবেশে তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতায় মওলানা যা বলতেন, মোনাজাতে সে কথাগুলোই বললেন। মোনাজাতে গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের বিশেষ শাখার লোকেরা হাত তুলে অংশ নেওয়ায় সেদিন তারাও ভাসানীর ‘বক্তৃতা’র কোনো নোট নিতে পারেননি (ভাসানী কাহিনী: এক ঘণ্টার মোনাজাত, সৈয়দ আবুল মকসুদ)।

ভাষা আন্দোলনে মওলানা: পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত মন্তব্য ও পূর্ব বাংলাবিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করার মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানীর সরকারবিরোধী ভূমিকা শুরু হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় এক জনসভায় খাজা নাজিমউদ্দিন মওলানা ভাসানীকে ‘ভারতের চর’ আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে ঘোষণা দেন। খাজা নাজিমউদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সেই কমিটির এক নম্বর সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সফরে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার খবর জেনেই ঢাকায় চলে আসেন এবং পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের প্রধান সমর্থক সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ লিখেছে, ‘মেডিকেল কলেজের সম্মুখে লক্ষ লোকের একটি গায়েবি জানাজায় নেতৃত্ব দেন ভাসানী।’ এভাবেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন মওলানা।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা: ভাসানীই প্রথম তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতার ইস্যুকে বারবার সামনে নিয়ে এসেছেন। যেমন তিনি ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ভাষার অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ব্রিটিশ গর্ভনেমেন্টের গোলামী করি নাই। ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: প্রথম খণ্ড)। পকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন জননায়কের এটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’-এ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বাধীনতা-স্বাধিকারের কথা বলেছিলেন। তখন তিনি পাকিস্তানের প্রতি বিদায়ী বচন ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেছিলেন। সুবিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘যদি পূর্ব বাংলায় তোমরা তোমাদের শোষণ চালিয়ে যাও, যদি পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃত না হয়—তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, তোমরা আমাদের কাছ থেকে একটি কথাই শুনে রাখ, আসসালামু আলাইকুম, তুমি তোমার পথে যাও, আমরা আমাদের পথে যাবো’ (কিশোর মওলানা ভাসানী, আবদুল হাই শিকদার)। এ কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বীজমন্ত্র নিহিত ছিল।

’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান নেতা: ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দি অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলি করে হত্যা করা হলে পরদিন মওলানা ভাসানী পল্টনের বিশাল এক জনসভার ডাক দেন। তিনি সেখানে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, ‘দুমাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম ও রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া না হলে ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ মওলানার এই ভাষণের পর বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল রাস্তায় নেমে আসে এবং স্বাধিকারের দাবিতে বিদ্রোহ রচিত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আইয়ুব সরকার সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। রচিত হয় আইয়ুব পতনের ইতিহাস।

১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় ও ভাসানীর স্বাধীনতা ঘোষণা: ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে আঘাত হানে সবর্কালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। অসুস্থ শরীর নিয়ে মওলানা ভাসানী প্রলয়বিধ্বস্ত উপকূল এলাকা পরিদর্শনে যান। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি দেখে খুব মর্মাহত হন। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গ্রন্থে লিখলেন, ‘২৩ নভেম্বর তড়িঘড়ি করে ভাসানী পল্টন ময়দানে এক জনসভা করেন। জাতির ইতিহাসে সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক জনসভা। ক্ষয়ক্ষতি বর্ণনার পরে সকলকে বিস্মিত করে তিনি সেই সভায় স্লোগান দেন: ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কবি শামসুর রহমান এর পরেই লিখলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রথম কবিতা ‘হায়, আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী’। তাঁর সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি ফের ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করলে যশোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মাতৃভূমি লিখল, “...এশিয়া, আফ্রিকা ও লাটিন আমেরিকার সংগ্রামী জনগণের মহান নেতা মওলানা ভাসানী গতকাল শুক্রবার ঢাকার পল্টন ময়দানের অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসমুদ্রের দাঁড়িয়ে ‘সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার মরণপণ সংগ্রামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করিয়াছেন।’

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মওলানা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মওলানা ভাসানী সন্তোষে ছিলেন। ৩ এপ্রিল সন্তোষে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে জ্বালিয়ে দিল মওলানার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু। ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে মওলানা পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সারা বিশ্বের কাছে আকুল আবেদন জানালেন প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। ২৫ এপ্রিল তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। প্রবাসী সরকার গঠনের পর অন্তর্কোন্দল চরম আকার ধারণ করলে ‘সেই দুঃসময়ে তাজউদ্দীন ধরনা দিয়ে পড়লেন নজরবন্দি মওলানার দেরাদুনের আবাসস্থলে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি ৩১ মে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বললেন, ‘আমাদের সামনে মাত্র দুটো পথ—হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু!’ (জানা অজানা মওলানা ভাসানী, আবদুল হাই শিকদার)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভারত সরকারের নজরবন্দি ছিলেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে কমিউনিস্ট আদর্শের অনুসারীরা ভিন্নভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে পরিচালনা করার জন্য তাঁকে প্রধান করে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ করলে তিনি ভারত সরকারের আরো বেশি নজরদারিতে থাকেন। ৯ সেপ্টেম্বর গঠিত মুজিবনগর সরকারের ছয় সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি।

ফারাক্কা লং মার্চ-জলদেবতার যুদ্ধের ডাক: ফারাক্কা লং মার্চ নিয়ে আহমদ ছফা লিখলেন, ‘মওলানা সাহেবকে ১৯৭৬ সালে যখন পিজি হাসপাতাল থেকে উঠিয়ে নেয়া হয় তখন তাঁর শরীরে ছিল আগুনের মতো জ্বর। তাঁকে যখন রাজশাহী পর্যন্ত নেয়া হলো। দেখা গেল তাঁর শারীরিক অবস্থার ভয়ংকর রকম অবনতি ঘটেছে। অনেকে মনে করলেন তাঁকে নিয়ে আর টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। সকলের মধ্যে একটা দোদুল্যমান মনোভাব দেখা দিল। তাঁর শরীরের এই অবস্থা, তার ওপর তুমুল বৃষ্টি। এই ধরনের আবহাওয়ায় মওলানাকে সীমানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই সকলে গড়িমসি করছিলেন। মওলানা সাহেবকে ব্যাপারটি জানানো হলে তিনি সেই প্রকাণ্ড হুঙ্কারটি ঝেড়ে দিলেন—‘কি মনে কর মিঞা, তোমাগো শরীরে মানুষের রক্ত নি আছে! চল, সামনে চল।’ অতএব আবার লং মার্চ শুরু হল। যেতে যেতে যখন সীমান্তের নিকটবর্তী কানসাট গ্রামটিতে মিছিল এসে থামল মওলানার অবস্থা তখন সঙ্গিন। ....এ রকম সংজ্ঞালুপ্ত অবস্থায় তিনি দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে কানসাটের জনসভাটিতে বজ্র কঠোর কণ্ঠে গুরুগম্ভীর ভাষায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী জীবনের শেষ বক্তৃতাটি কিভাবে তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, লং মার্চের অংশগ্রহণকারীরা এটাকে একটা আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে করেন। মওলানা তাঁর বক্তৃতায় বললেন, ‘গঙ্গার পানি আমাদের ন্যায্য হিস্যা, এটা আমাদের প্রাকৃতিক অধিকার, এই অধিকার মানুষের একার নয়, পশু-পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ প্রাণবান সবকিছুর একান্ত জন্মগত অধিকার। যারা এই অধিকার হরণ করছে তারা প্রাণের বিরুদ্ধে জুলুম করছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলে প্রাণের বিকাশ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে চাইছে। বাংলাদেশের প্রাণবান মানুষ এই জুলুম কিছুতেই মেনে নিতে পারে না এবং ভারত জুলুমবাজি করে শেষ পর্যন্ত কোনদিনই জয়যুক্ত হতে পারে না।’ আহমদ ছফা লিখলেন, ফারাক্কা লং মার্চ স্মৃতি উদযাপনের পোস্টারটিতে জীবনের অন্তিম ভাষণদানরত মওলানার ছবিটি দেখে কেন জানি আমার তাঁকে মনে হতে থাকল, ‘তিনি একজন জলদেবতা।’

পাকিস্তানে দুবার নিষিদ্ধ এক বই: মওলানা ভাসানীর আজীবন সাথী একটি মাত্র স্যুটকেস। দৈর্ঘ্য ১৬ ইঞ্চি। সম্পদ বলতে তার মধ্যে থাকে একটি গামছা, একটি লুঙ্গি, একটি খদ্দরের পাঞ্জাবি, মাথার একটি টুপি, কিছুটা তামাক পাতা আর চুনের একটা ডিবা। এই নিয়েই তিনি গেছেন ইউরোপ সফরে। ইউরোপে ভাসানীর স্বল্প সময়ের যাত্রার ঘটনাবহুল দিনগুলো নিয়ে লেখা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’। সারা বইজুড়ে পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। এই বইকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার দুবার নিষিদ্ধ করে। আইয়ুব খানের সময় ১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের জন্য লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে জরিমানাসহ সাজা দেয়। ১৯৬৫ সালে আবার নিষিদ্ধ করা হয় এই বই।

আর একজন ভাসানী চাই: স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীন বাংলাদেশে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রশ্নে সবচেয়ে সোচ্চার মানুষটি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। দেড় হাজার শহীদের বিনিময়ে এবং অর্ধ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আজকের নতুন বাংলাদেশে ভীষণ প্রয়োজন আর একজন ভাসানী। যিনি দুর্দিনে, প্রতিবেশী শক্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাণ্ড হুঙ্কার দিয়ে গর্জে উঠবেন—গড়ে তুলবেন নতুন বাংলাদেশ। যাঁর সাথে আপস’ বা ওই জাতীয় শব্দের সাথে কখনো দেখা হবে না।

ফয়সাল আকবর: শিক্ষক ও গবেষক

আরও