সময়ের ভাবনা

আশ্রয়ণ প্রকল্প ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নতি

গুণবতী আশ্রয়ণ প্রকল্পের কামরুল ইসলাম দিনমজুরের জোগালির কাজ করেন, দিনে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার। ছয় সন্তানের জনক, মাত্র দুই মাস হলো এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেছেন। তার স্ত্রী শিমুল ঘরের বারান্দায় বসে মুরগি কাটছিলেন, বয়স খুব বেশি হলে ২৫-২৭ হতে পারে। দেখলে আরো কম মনে হয়। এর মধ্যেই ছয় সন্তানের জননী। আমি কথা বলতে চাইলে খুব আগ্রহভরে

গুণবতী আশ্রয়ণ প্রকল্পের কামরুল ইসলাম দিনমজুরের জোগালির কাজ করেন, দিনে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার। ছয় সন্তানের জনক, মাত্র দুই মাস হলো আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেছেন। তার স্ত্রী শিমুল ঘরের বারান্দায় বসে মুরগি কাটছিলেন, বয়স খুব বেশি হলে ২৫-২৭ হতে পারে। দেখলে আরো কম মনে হয়। এর মধ্যেই ছয় সন্তানের জননী। আমি কথা বলতে চাইলে খুব আগ্রহভরে ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের নাম গুণবতী কিনা জানা নেই, এটা জায়গার নাম। তবে প্রকল্পটি মাত্র বাস্তবায়ন হয়েছে বলেই মনে হয়।

দুটি পাকা রুম, সামনে-পেছনে দুপাশে দুটো বারান্দা, পেছনের বারান্দায় রান্নার জায়গা, পাশে একটি ছোট বাথরুমও রয়েছে। একটি রুমে ঘরজুড়ে চৌকি পাতা। তাতে নানা রঙের মলিন কাঁথা, দুটি শিশু শুয়ে রয়েছে, পাশের রুমে কোনো চৌকি নেই। মেঝেতে একইভাবে বেশ কয়েকটি কাঁথা এলোমেলোভাবে ছড়ানো। নতুন হলেও মেঝেটি পরিষ্কার নয়। মাটি থেকে তেমন উঁচুও নয়, একটু বেশি বৃষ্টিতে পানি উঠে যেতে পারে। মনে হলো ধানি জমি কিছুটা উঁচু করে ঘরগুলো তৈরি হয়েছে। পেছনের দিকে কিছুটা জায়গা নারকেল, সুপারি পাতা দিয়ে ঢাকা, হয়তো বাড়ির মেয়েদের গোসলের জন্য।

কামরুল ইসলাম জানালেন, তিনি দুই মাস হলো এখানে এসেছেন এবং দেড় বছর আগে একটি বাড়ির জন্য আবেদন করেছিলেন। আরো জানালেন, রকম একটি বাড়ি পেয়ে তিনি খুব খুশি, তবে তার জমি-জায়গা নেই, তাই রোজগারের বন্দোবস্ত কীভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তিত। জোগালির কাজ করতে তাকে শহরে যেতে হবে।

এখানে মোট ২৩টি পরিবারের থাকার জায়গা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ঘরই তালাবদ্ধ। জিজ্ঞাসা করলে জানালেন, হয়তো ঈদ করতে বাড়িতে গিয়েছে। অর্থাৎ তাদের নিজস্ব বাড়িতে গিয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি একটু ভেতরে, সামনে অনেকটা খালি জায়গা, হয়তো চাষাবাদের জন্য। তবে বর্তমানে খালি। এগুলো সরকারি নাকি বেসরকারি জায়গা বোঝা গেল না। ইসলাম আরো জানালেন, তিনিও কিছুদিন পর তার নিজস্ব বাড়িতে যাবেন। মনে হলো, বাড়ির দখল নেয়া একটা বড় কাজ, তাই এখানে কিছুদিন বসবাস করা দরকার। প্রকল্পের বাড়িতে এসে তার জীবনমানের খুব উন্নতি হয়েছে, দারিদ্র্য নিরসন হয়েছে, তেমনটি বোঝা গেল না।

ছয়টি সন্তানের মধ্যে চারটিকে দেখতে পেলাম। মনে হলো, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের কাছে, অর্থাৎ মা-বাবার কাছে হয়তো বড় সন্তানদের রেখে এসেছেন, তাদের লেখাপড়া ইত্যাদির খেয়াল রাখার জন্য। কারণ এখানে কাছাকাছি স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ আছে কিনা জানা গেল না। এখানে ২৩টি পরিবারের একেকটিতে গড়ে চারটি করে শিশু থাকলে মোট প্রায় ১০০ শিশুর এখানে লালন-পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ, রাস্তা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদিসহ একটি সম্পূর্ণ আশ্রয়ণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন।

সরকারের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হয়ে গত ২৫ বছরে বেশ বিস্তার লাভ করেছে। প্রথমে একটি প্রাথমিক প্রকল্প হিসেবে নেয়া হলেও ক্রমে বৃহৎ পরিসরে বিস্তার লাভ করেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, এসডিজি ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রকল্পের সংযোগ রয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গৃহহীন জনমানুষের আবাসন সৃষ্টিতে ১৯৯৭ থেকে শুরু করে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশ আর্মি স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হাজার ৬৯৩টি ব্যারাক এবং নেভির তত্ত্বাবধানে আরো হাজার ৭০৭টি ব্যারাক স্থাপিত হয়েছে, যেখানে ধরনের প্রান্তিক মানুষের অন্তত থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এসব ব্যারাকে মোট কতসংখ্যক মানুষের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তা অবশ্য ঠিক জানা যায়নি।

দিনে দিনে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে। এর দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে কোস্টাল এলাকায়, যেমন বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মোংলা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া টেকনাফ উপজেলায় বাংলাদেশ নেভির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। বাকি জায়গায় আর্মির  মাধ্যমে  আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে ওঠে।  প্রাথমিকভাবে শুধু টিন দিয়ে ঘরগুলো তৈরি হলেও পরবর্তী সময়ে ইট দিয়ে বহুতলবিশিষ্ট বাড়িও তৈরি হয়। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নেভি আর্মির মাধ্যমে তৈরি ব্যারাকের সংখ্যা যথাক্রমে হাজার ৩০৫ হাজার ৮৬৩টি।

এছাড়া এর ব্যাপ্তি আরো বেড়েছে নোয়াখালীর ভাসানচরে মিয়ানমার থেকে বাধ্য হয়ে মাইগ্রেটেড মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার মাধ্যমে। বিপুলসংখ্যক মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে এখানে। সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, পানির পাম্প, দুর্যোগকালীন সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল, সুপারশপ, মসজিদ, পাকা রাস্তা, ওয়্যারহাউজ, হেলিপ্যাড ইত্যাদি। এটি পৃথিবীর ডিসপ্লেসড মানুষের জন্য আবাসনের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এছাড়া কক্সবাজারে কুরুল্কুশ বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প আরো একটি ব্যবস্থা, যা একটি এক্সটেন্ডেড আবাসন ব্যবস্থা হিসেবে চলমান।

সবগুলো ব্যবস্থাই বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসনীয় কার্যক্রম, যা হয়তো  ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসনের ক্ষেত্রে এগুলো বিশেষভাবে অবদান রাখবে। কোনো কোনো প্রকল্পে অল্প কিছু করে জমিও ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পরিবারগুলোর কিছু আয়ও হতে পারে।

দারিদ্র্য দূরীকরণে আশ্রয়ণ প্রকল্প অবদান রাখবে বলে মনে করা হয়। তবে সুবিধা যাতে প্রকৃত দুস্থদেরই দেয়া হয় এবং সুযোগ নিয়ে যদি তারা দরিদ্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তাহলেই কেবল নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত এসব প্রকল্পের সার্থকতা। এরই মধ্যে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শোনা যায়, এমনকি প্রকল্পে নাম লেখানোর প্রয়োজনে ঘুষ দিতে হয়েছে, না দিতে পারলে নাম কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে দেখা গেছে বেশ সচ্ছল পরিবারও আশ্রয়ণের সুবিধা পেয়েছে।

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিন্নমূল অথবা গৃহহীনদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা। এসব ব্যক্তির তালিকা তৈরিতে কোনো ডাটাবেজ গঠন করা হয়েছে কিনা, যাতে ভবিষ্যতে ফলোআপ করা যায় এভাবে যে, তাদের জীবনমানের কোন ধরনের উন্নতি হয়েছে, শিশুরাই-বা কীভাবে বেড়ে উঠছে কিংবা বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে জনগোষ্ঠীর পরিসংখ্যানে আশ্রয়ণ কতখানি অবদান রাখতে পেরেছে, সে রকম কোনো স্টাডি হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে তার দরকার রয়েছে। এতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সঠিকভাবে নেয়া যেতে পারে।

সরকারের ধরনের আরো কার্যক্রম রয়েছে। তার মধ্যে বয়স্ক ভাতা, বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। বর্তমানে সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রামের পরিমাণ বাজেটের প্রায় ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ বা জিডিপির প্রায় শতাংশ। এগুলোর অবশ্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ রয়েছে। যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিরসনে ব্যবস্থা, শিশুদের শিক্ষা প্রদানে মা-বাবাকে সহয়তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে সহায়তা। কিছু রিভিউতে দেখা গেছে সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্কুলের এনরোলমেন্ট বেড়েছেবিশেষ করে মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রেকর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, দুর্যোগের সময়ে খাদ্য চাহিদার সুযোগ হয়েছে। অবকাঠামো তৈরি স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। এসবই আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।

এগুলো সামনে রেখে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মূল্যায়নও জরুরি। ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হয়ে আশ্রয়ণগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিশুদের শিক্ষা, মানসিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কীভাবে অবদান রাখছে তা জানা গেলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরো বাস্তবভিত্তিক সুন্দর হতে পারে।

বাংলাদেশ আগামী চার বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান মতেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যা মৌলিক অধিকার। সরকারের এদিকে যথেষ্ট সজাগ রয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প তার একটি উদাহরণ। অসচ্ছল বলতে কাদের বোঝায় তা ঠিক জানি না। তবে এখনো প্রচণ্ড শীতের রাতে এসব গৃহহারাকে রাস্তার পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কোনোভাবে শীত থেকে রেহাই পেতে বা অতিগ্রীষ্মে খোলা বাতাসে রাস্তার পাশে বা মাঠের মাঝে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। রাজধানী শহরেই এর উদাহরণ রয়েছে, তাহলে মফস্বলে কী অবস্থায় রয়েছে তা বলা বাহুল্য। আমরা এমন দিন দেখতে চাই যখন ধরনের মানুষ আর রাস্তায় দেখা যাবে না, সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করা যাবে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। একটি হাসিখুশি প্রাণবন্ত বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উদাহরণ হয়ে থাকবে।

কামরুল ইসলাম আর শিমুলের মতো আরো হাজারো মানুষ এক টুকরো আবাসনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রয়োজন প্রকৃত আবাসন, যাতে তাদের জীবনমানের কিছুটা হলেও উন্নতি হয়, সন্তানরা লেখাপড়া শেখে বা কোনো ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, যেখানে সে দেশের জন্য শুধু বোঝা নয়; বরং দেশকে কিছু দিতে সক্ষম হয়।

 

ফেরদাউস আরা বেগম: প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)

আরও