সংবিধানে বিভক্তীকরণ নীতি এবং দ্বন্দ্ব ও সংঘাতমুখর জনগোষ্ঠী

সংবিধানকে প্রাথমিকভাবে নথিভুক্ত সামষ্টিক কিছু নিয়মাবলি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়েও সংবিধান বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করার কাজে।

শৈশব থেকেই একজন ব্যক্তি জেনে আসে—সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তার রক্ষক। কিন্তু ‘একটি রাষ্ট্রের সংবিধান কার প্রতিনিধিত্ব করে?’ কিংবা ‘সংবিধানের মালিকানা কার বা কাদের?’—এ প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবার কাছেই অজানা রয়ে যায়।

সংবিধানকে প্রাথমিকভাবে নথিভুক্ত সামষ্টিক কিছু নিয়মাবলি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়েও সংবিধান বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করার কাজে।

সব মিলিয়ে সংবিধানকে জনগণের নথিপত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় যা রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সমতাভিত্তিক সম্পর্ক নির্মাণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার পথ তৈরি করে। অর্থাৎ সংবিধান প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের এবং জনগণই সংবিধানের মালিক। সংবিধান কোনো একক ব্যক্তি, একক গোষ্ঠী কিংবা একক সম্প্রদায়ের নয় বরং একটি রাষ্ট্রে সংবিধানই কেবল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে।

পৃথিবীজুড়ে যেমন জীববৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে, তেমনি মানুষের মাঝেও আছে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। একটি রাষ্ট্রে বহু পরিচয়ের, জাতির, ধর্মের, সংস্কৃতির, আদর্শ-দর্শনের মানুষ বাস করে। তাদের সবার মাঝেই আছে চিন্তা, কর্ম, ব্যবহার, আচার-আচরণের পার্থক্য। অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও জাতিগত-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দৃশ্যমান। একটি রাষ্ট্রের সংবিধানের ক্ষেত্রে পরিচয়গত শতবৈচিত্র্যের মাঝেও কি প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব, যদি সেই সংবিধানে মানুষের বৈচিত্র্যময় পরিচয়কে কেন্দ্র করে কোনো বিভক্তীকরণ না করা হয় এবং ভিন্নতাকে পুঁজি করে কোনো একক ব্যক্তি-গোষ্ঠী-ধর্মকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বৈষম্যহীনভাবে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।

কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন, পরিবর্তন ও সংস্কারের কাজ মূলত রাষ্ট্রের পরিচালক ও প্রশাসকদের হাতে বন্দি থাকে। রাষ্ট্রের পরিচালক ও প্রশাসকরা তাত্ত্বিকভাবে জনগণের প্রতিনিধি হলেও প্রায়ই তাদেরকে শোষকের চরিত্রে অবতীর্ণ হতে দেখা যায় এবং শাসকগোষ্ঠী তার শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের ভেতরে বিভিন্ন বিভাজন সৃষ্টি করে। জনগণের অন্তর্নিহিত সম্প্রীতি, সংহতি ও ঐক্য ভেঙে দিয়ে বিভেদ-বিচ্ছেদ-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে পারলেই শাসকগোষ্ঠী আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এবং এজন্যই তারা সংবিধানকে সমগ্র জনগণের না রেখে কোনো একক ব্যক্তি, একক গোষ্ঠী কিংবা একক ধর্মের করে তোলে। নির্দিষ্ট কোনো জাতি কিংবা ধর্মকে অগ্রাধিকার ও অধিক মর্যাদা দিয়ে তারা অন্যান্য জাতি-ধর্ম কিংবা ভিন্ন পরিচয়ের মানুষের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে, অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে।

রাষ্ট্রের বিভক্তীকরণ নীতি সর্বদাই জনগণের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিপক্ষমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। কারণ এ ধরনের নীতি রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের অধিক ক্ষমতা-মর্যাদা-অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ববাদী করে তোলে এবং কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠী চিরতরেই অন্যান্য পরিচয়ের মানুষের ওপর নানা ধরনের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। শোষিত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও নানাভাবে এ দমন-নিপীড়ন প্রতিরোধের চেষ্টা করতে থাকে। এভাবেই জনগণের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়‌, যা ভিন্ন পরিচয়ের মানুষকে একে অন্যের প্রতিপক্ষের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। দৈনন্দিন দ্বন্দ্বের অন্তরালে রাষ্ট্রের পরিচালক ও প্রশাসকরা যেমন পরোক্ষভাবে জনগণকে শাসন করতে থাকে, তেমনই প্রত্যক্ষভাবে তাদের বৃহত্তর পর্যায়ের শাসন-শোষণ করার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। কেননা দৈনন্দিন দ্বন্দ্বের অপার সাগরে সরকারের সরাসরি দমন-নিপীড়ন ও শোষণ জনগণের কাছে অদৃশ্য থেকে যায়। এভাবেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্তীকরণ নীতি গ্রহণ করে শাসকগোষ্ঠী তার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

সাংবিধানিকভাবে না হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্তীকরণের রাজনীতির উৎপত্তি ঘটে ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮৫৭ সালের আগে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতবর্ষের জনগণের ভেতরে কোনো দ্বন্দ্বের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না বরং ধর্মীয় ও জাতিগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রমাণ মেলে বহু নথিপত্রে। এমনকি ১৮৫৭ সালে ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এ অঞ্চলের জনগণ। ১৮৫৭ সালের পর থেকেই মানুষের মধ্যে প্রতিপক্ষমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি হতে থাকে।

১৮৭১ সালে ব্রিটিশ ভারতের জনশুমারিতে তৎকালীন একজন ব্রিটিশ প্রশাসক হেনরি ওয়াটারফিল্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতীয় জনগণের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়গত বিভক্তি করেন। ওয়াটারফিল্ড ভারতীয় জনগণকে বিভক্ত করে মূলত হিন্দু ও মুসলমান পরিচয়ে। যদিও ভারতবর্ষে আরো অনেক সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল, তিনি তাদের বৃহত্তর পর্যায়ে বিভক্তি না ঘটিয়ে ‘অন্যান্য’ শব্দে আখ্যায়িত করেছে। জনশুমারিটি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে। জনশুমারিতে দেখানো হয়, ভারতবর্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের তুলনায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু।

এ বিভক্তীকরণ নীতি ১৮৭৫ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হলেও একাডেমিকভাবে এর চর্চা হতে দেখা গেছে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই। যেমন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেমস মিল তার বই ‘দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’তে ভারতীয় ইতিহাসকে বিভক্ত করেছিলেন তিন ভাগে—হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ। এছাড়া তৎকালীন অন্যান্য ব্রিটিশ গবেষক ও প্রশাসকের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থা হিন্দু ধর্মের অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত। তাই ব্রিটিশরা তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হিন্দুদের, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করেছিল, যার জন্য হিন্দু সম্প্রদায় ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিপক্ষমূলক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

উল্লেখ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বিভক্তীকরণের মাধ্যমেই হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়। তাই বোধহয়, তার সাত বছর পরই, ১৮৮২ সালে তামিলনাড়ুতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বহু সংঘাতের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৮৫৭ সালে সব ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে সিপাহীদের বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল। তারপর তাদের দীর্ঘ ৯০ বছরের শাসনের জন্য এ বিভক্তীকরণ নীতি নিশ্চয়ই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার ছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্তীকরণ নীতির ব্যবহার দৃশ্যমান ছিল পাকিস্তান শাসনামলেও। ব্রিটিশদের বিভক্তীকরণ নীতির ওপর ভিত্তি করেই জন্ম হয়েছিল হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান, অর্থাৎ ইন্ডিয়া ও মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। ‘মুসলমানদের’ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর নানা নিপীড়ন চালিয়েছে। বহু রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়নের মধ্যেও সাংবিধানিক বিভক্তীকরণের প্রভাবে এ দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিচ্ছেদ-বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল। তাই পূর্ব বাংলায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল ১৯৫০ কিংবা ১৯৬৪ সালের মতো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকারের তীব্র নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একমাত্র উপায় ছিল ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে একত্রিত হওয়া এবং রাষ্ট্রের শাসক ও প্রশাসকদের বিভক্তীকরণের চক্র ভেঙে দেয়া। কেবল তাই হয়তোবা আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি।

বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা যত জাতিগত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব দেখতে পাই, তার প্রতিটির মূলে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পরিসরে সাংবিধানিকভাবে এ দেশের মানুষের বিভক্তীকরণ। যেমন ১৯৭২-এর সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসী নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পরিচয় অস্বীকার করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে বাঙালি জাতির অধিক ক্ষমতা-মর্যাদা-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ঠিক সে সময় থেকেই বাঙালি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যেমন সহজে তাদের অঞ্চলে বাঙালিদের বিচরণ মেনে‌ নিতে পারে না, বাঙালিরাও তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত আধিপত্য খাটিয়ে পাহাড়ের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর বিভিন্নভাবে নিপীড়ন চালায়। এর সূত্র ধরেই স্বাধীনতার পর থেকে আমরা বাঙালির সঙ্গে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বহু সংঘাত দেখতে পাই। যেমন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ‌। এছাড়া সমতলের বিভিন্ন আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও বাঙালিদের সংঘটিত দমন-নিপীড়নের দৃশ্য আমরা দেখতে পাই।

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ সংযোজন এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’-কে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এ সংশোধনীগুলোও বিভক্তীকরণ নীতির মধ্যেই পড়ে। কেননা বাংলাদেশ যেমন এক জাতির রাষ্ট্র না, তেমনই এ রাষ্ট্রে আছে একের অধিক ধর্মবিশ্বাসের মানুষ। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্ম হিসেবে ইসলামকে এবং সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান পড়ে দেখলে মনে হয় এটি আদৌ সমগ্র জনগণের নথিপত্র নয়, বরং কোনো‌ একক গোষ্ঠী কিংবা একক ধর্মাবলম্বীদের নথিপত্র‌। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান নানা বিভক্তীকরণের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের।

রাষ্ট্রের এসব বিভক্তীকরণ নীতি জনগণের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই জনগণের মধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন সংঘাত ও সহিংসতার মাধ্যমে। জনগণের মাঝে সংঘাতপূর্ণ ও সহিংস অনুভূতি সৃষ্টির মাধ্যমে একটি সরকার কীভাবে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে এবং কীভাবে জনগণের ওপর অদৃশ্য দমন-নিপীড়ন প্রতিষ্ঠিত করে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি আওয়ামী লীগের শাসনামলে। উল্লেখ্য যে আওয়ামী লীগের আমলেই বিভক্তীকরণের রাজনীতি ছিল সবচেয়ে বেশি।

স্বৈরাচারী শক্তির পতনের মাধ্যমে বর্তমানে সংবিধান সংস্কারের একটি আলোড়ন উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সংবিধান সংস্কার কমিশনও গঠন হয়েছে। ইতিবাচক বিষয় হলো, সংস্কারের পূর্বে বহুজনের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন কমিশনের প্রধান‌ ও সদস্যরা। চিন্তার বিষয় হলো, অনেকেই সাংবিধানিক বিভক্তীকরণকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে সংস্কারের ক্ষেত্রে কোনো একক গোষ্ঠীর বিশেষাধিকারের পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করছে।

এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশনপ্রধান ও অন্যান্য সদস্যকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এ দেশ কোনো‌ নির্দিষ্ট জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পরিচয়ের নয়। এ দেশ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠদের নয়। একইভাবে এ রাষ্ট্র কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে‌ না। সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে বিভক্তীকরণ নীতির ধারণাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে এমন একটি সংবিধান তৈরি করতে হবে, যা সম্মিলিতভাবে প্রতিনিধিত্ব করবে প্রতিটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পরিচয়ের মানুষের। নতুন সম্ভাবনার এ বাংলাদেশে দেশটা যেন সবার হয়। কারো বেশি কিংবা কারো কম নয়। কেবল তখনই আমরা গড়ে তুলতে পারব বিভক্তিহীন ঐক্যের বাংলাদেশ।

রাশিক তাহির: লেখক ও প্রাবন্ধিক

আরও