শিল্প খাতের ক্যাপটিভনির্ভরতা

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা ছাড়া ক্যাপটিভনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়

বিগত সরকারের আমলে এসব সুপারিশ-উপদেশ অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, যার ফলে জ্বালানি খাত ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠেছে।

শিল্প-কলকারখানায় নির্বিঘ্ন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় দেশের শিল্প-কারখানাগুলোয় একের পর এক গড়ে উঠেছে গ্যাসভিত্তিক নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা (ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট)। বর্তমানে এর ওপরই নির্ভর করছে শিল্প উৎপাদন। এতে চাপ পড়েছে প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাসের ওপর। চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ। এ বাস্তবতায় বিদ্যুৎ শিল্পে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হলে শিল্প-কারখানার ক্যাপটিভনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেও জাতীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এ অনিশ্চয়তার কারণেই ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টগুলো গড়ে উঠেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ক্যাপটিভনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি। কারণ দেশে যেভাবে আবাসন ও শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট ঘনীভূত হচ্ছে তাতে আমদানি কোনো সমাধান নয়। একদিকে জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার সবসময়ই ভূরাজনীতি, উৎপাদন ও নানা কারসাজিতে পূর্ণ থাকে। অন্যদিকে বর্তমানে যেসব সমস্যায় দেশের অর্থনীতি জর্জরিত, তাতে আমদানির সক্ষমতাও নেই। বরং বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি, বিশেষ করে এলএনজি আমদানিনির্ভরতার কারণে বর্তমানে দেশ জ্বালানি নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা এলএনজির ওপর অতিনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ ছিল, নবায়নযোগ্য ও দেশীয় জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের।

বিগত সরকারের আমলে এসব সুপারিশ-উপদেশ অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, যার ফলে জ্বালানি খাত ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন উপেক্ষা করার দরুন বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান। দেশীয় যেসব গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদনে আমরা বরাবরই কম গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। গোষ্ঠী স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য দিতে গিয়ে জ্বালানি খাতের সমস্যা সমাধান তো হয়নি, বরং পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে গেছে। এর ভুক্তভোগী পুরো দেশ। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বিদ্যমান সব গ্যাস ক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে হবে। গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর অনাবিষ্কৃত এলাকায় নতুন করে খনন কার্যক্রম চালালে সেখানে আরো গ্যাস পাওয়া যেতে পারে, যা বিদ্যমান সংকটকে প্রশমিত করতে পারে।

তবে অভ্যন্তরীণ উৎসে গ্যাস কূপ অনুসন্ধান ও উত্তোলন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমানে কীভাবে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টগুলোয় গ্যাসের ব্যবহার কমানো যায় সেটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে গ্যাস সাশ্রয়ে।

সাধারণত একটি ক্যাপটিভ প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে। এজন্য প্রতি বছর সরকার অনুমোদিত ১৫ পিএসআই গ্যাসের প্রেসার প্রয়োজন। কিন্তু বছরে সর্বোচ্চ ১ থেকে ৭ পিএসআই প্রেসার থাকে। আবার ক্যাপটিভের যন্ত্রপাতি মান্ধাতার আমলের হওয়ায় বেশি গ্যাস ব্যবহার করেও সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। অথচ তাপ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা ও কার্যকর জেনারেটর ব্যবহার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্যাপটিভের সক্ষমতাকে ৭৩ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব বলে সম্প্রতি ‘‌ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশন ফর ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বাংলাদেশ: ওভারভিউ অ্যান্ড রিকমেন্ডেশনস’ শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে। এখানে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যাপটিভের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে বছরে প্রায় ৪২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন কিউবিক ফিট (বিসিএফ) প্রাকৃতিক গ্যাস সাশ্রয় করা যাবে।

সুতরাং গ্যাস সংকটের বাস্তবতায় সর্বপ্রথম ক্যাপটিভের যন্ত্রপাতির আধুনিকায়নে জোর দেয়া আবশ্যক। এতে ক্যাপটিভগুলোর সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাবে এবং গ্যাসের ব্যবহার কিছুটা হলেও কমে আসবে। আবার সেই গ্যাস জাতীয় গ্রিড লাইনে ব্যবহার করা যাবে।

তবে শিল্প খাতসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি জ্বালানির দামও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও বাজারমূল্য নির্ধারণে। এদিকে নব্বই দশকের পর থেকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৩ বার, শিল্প-বাণিজ্য সংযোগে বাড়ানো হয়েছে ১৮ বার। যেখানে প্রতি ইউনিট ঘনফটু গ্যাসের দাম ১ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন তা সর্বোচ্চ করা হয়েছে সাড়ে ৩১ টাকা।

তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কখনই সরকার তা করতে পারেনি। বর্তমান সরকারও দাম বাড়ানোর পথে হাঁটছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং গ্যাসের দাম বাড়ানোয় তা মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে।

বিগত সরকারের শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘটেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে; দেউলিয়া হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠান। গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে লাখ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্টও দেয়া হয়েছে। আবার আর্থিক লোকসান ও সংকটের কথা বলে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এর চাপ পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে। ক্ষমতাঘনিষ্ঠদের অনৈতিক সুবিধা দিতে গিয়ে নেয়া একের পর এক অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ভঙ্গুরপ্রায় করে তুলেছে খাতটিকে।

দাম না বাড়িয়ে জ্বালানি উৎপাদন পর্যায়ে যেসব লুক্কায়িত চার্জ আছে, সেগুলো বের করা হোক। এ খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম

দূর করা ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাহলে আশা

করা যায়, দাম না বাড়িয়েই জ্বালানি উৎপাদনের পরিচালন ব্যয়ের সংকুলান বাড়ানো যাবে এবং সরকারের ভর্তুক্তির পরিমাণও কমে আসবে।

আরও