ইসলামিক ব্যাংকিং আইন প্রণয়নে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন

ইসলামিক ব্যাংক পর্যায়ে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির নিয়োগ, কাঠামো, কার্যপরিধি ও ক্ষমতা বিষয়েও আইনটিতে কিছু বলা হয়নি। পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন ছাড়া এ কমিটিগুলো এখনকার মতো ভবিষ্যতেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না।

১৯৮৩ সালে শুরু হওয়া ইসলামিক ব্যাংকিং বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করছে। ১০টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ রূপে ও ৩০টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোর মাধ্যমে এ ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ব্যাপক প্রসারের পরও ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের জন্য একটি পৃথক আইন না থাকার আক্ষেপ বহু বছর ধরে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিদ্যমান। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এমন একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে এবং এর ওপর মতামত আহ্বান করেছে। স্বাভাবিক কারণে এ নিয়ে ইসলামিক ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি সাড়া পড়েছে। তবে ইসলামিক ব্যাংকিং শুরুর চার দশকের অধিক সময় পর নেয়া উদ্যোগটিতে গভীরতা ও ব্যাপ্তি উভয় দিক থেকে যথেষ্ট মান উন্নয়ন প্রয়োজন।

আইন প্রণয়নের প্রথম ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামিক ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি বোঝাপড়া সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ধরন কেমন হবে। যেমন ইসলামিক ব্যাংকিং কি প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর সমান্তরালে চলতে থাকবে, নাকি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ইসলামিক হবে? এ বোঝাপড়া সৃষ্টিতে প্রয়োজন ধারাবাহিক মতবিনিময়ের। অথচ খসড়া আইন প্রস্তুতের পূর্বে তেমনটা হয়নি। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের মনোভাব কী তাও সুনির্দিষ্ট নয়।

নীতির দিক থেকে ইসলামিক ব্যাংকিং প্রকৃত, দায়িত্বশীল ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবসানির্ভর। ফলে এ ব্যবস্থা টেকসই অর্থনীতি সৃষ্টিতে সহায়ক। কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে ইসলামিক ব্যাংকিং অনেকাংশে কাগুজে ব্যবসা ও দায়ভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থার প্রকৃত সুবিধা পেতে হলে নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে যে বিস্তৃত ব্যবধান বিদ্যমান তা মোচনে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন, যার প্রধানতম হচ্ছে ইসলামিক ব্যাংকিং আইনে এ-বিষয়ক প্রয়োজনীয় বিধান নিশ্চিত করা। অথচ খসড়া আইনটিতে এমন কিছু পরিলক্ষিত হয়নি, বরং এমন কিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে যা ইসলামিক ব্যাংকিং নীতি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

গ্রাহক অর্থায়নে ইসলামিক ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের প্রকৃত মালিক হতে হয় ও মালিকানা ঝুঁকি নিতে হয়। কিছু সম্পদ তারা বাজার থেকে ক্রয় করতে পারে, আবার কিছু সম্পদ তাদের নির্মাণ করতে হয়। কিছু সম্পদ তারা ক্রয় করার পরপরই বিক্রয় করে দিতে পারে, আবার কিছু সম্পদের মালিকানা তাদের দীর্ঘ সময় ধারণ করতে হয়। তারা অংশীদারি চুক্তির ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে যেখানে লাভের পাশাপাশি মূলধনের ক্ষতির ঝুঁকিও থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় এগুলো নিশ্চিতে নানা প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন ধরনের কর ও শুল্কের অতিরিক্ত বোঝা। প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর না হলে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহ অনুসরণ করে ইসলামিক ব্যাংকিং সম্ভব নয় বা দুরূহ। আইনি কাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংশোধন না আনলে ইসলামিক ব্যাংকগুলো কাগুজে ব্যবসা ও সমালোচনার চক্রে আটকে থাকবে। ইসলামিক ব্যাংকিং আইন প্রণয়নে এ বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ওপর অতিরিক্ত কর ও শুল্কের বোঝা কমাতে বিভিন্ন দেশ সংশ্লিষ্ট আইনগুলোয় প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেছে।

ইসলামিক ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ পরিপালন নিয়ে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ বিদ্যমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বহু বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে শরিয়াহ্‌ কমিটি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছেন অনেকে। এর প্রতিফলন হিসেবে খসড়া আইনটিতে ‘বাংলাদেশ সেন্ট্রাল শরিয়াহ কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর নিয়োগ, কাঠামো, কার্যপরিধি ও ক্ষমতা বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। কেবল এটুকু বলা হয়েছে যে এ বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবিধান দ্বারা নির্ধারণ করবে। অথচ গুরুতর এ বিষয়গুলো যদি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত না হয়, প্রবল সম্ভাবনা আছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্বারা এ কাউন্সিলের কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হবে। ফলে কাউন্সিলটি প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল সদস্যরা দেশটির রাজা দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের শরিয়াহ বিষয়ে তাদের মত চূড়ান্ত।

ইসলামিক ব্যাংক পর্যায়ে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির নিয়োগ, কাঠামো, কার্যপরিধি ও ক্ষমতা বিষয়েও আইনটিতে কিছু বলা হয়নি। পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন ছাড়া এ কমিটিগুলো এখনকার মতো ভবিষ্যতেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না।

খসড়া আইনটিতে বহিঃশরিয়াহ নিরীক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে যেকোনো ইসলামিক ব্যাংককে এটি করতে বাধ্য করতে পারবে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রয়োজন এটিকে সব ধরনের ইসলামিক ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক করা, যেমনটা ওমান, পাকিস্তান, কুয়েত ও বাহরাইন করেছে। একই সঙ্গে বহিঃশরিয়াহ রেটিংয়ের বিধান যুক্ত করা প্রয়োজন।

শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব আরো স্বচ্ছ এবং কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অবহেলায় শরিয়াহ পরিপালনে ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে তারা কী ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হবে তার বিধান যুক্ত করা প্রয়োজন। খসড়া আইনটিতে যদিও বিভিন্ন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট শরিয়াহ বিচ্যুতির আলোকে কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। মালয়েশিয়ায় এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আট বছরের জেল বা ২৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত (আনুমানিক ৭০ কোটি টাকার সমান) বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

একই সঙ্গে গ্রাহকদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় যদি পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আস্থা ভঙ্গ করে তাহলে তাদের শাস্তির বিধান কী হবে তা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। খসড়াটিতে বলা হয়েছে যে মুদারাবাহভিত্তিক হিসাব গ্রাহকরা প্রকৃত ক্ষতির দায় বহন করবে, যা শরিয়াহ নীতির দিক থেকে সঠিক। কিন্তু এ ক্ষতি যদি গ্রাহক কর্তৃক প্রদত্ত বিনিয়োগের শর্ত ভঙ্গ বা পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা অসদাচরণের কারণে হয়, তাহলে এর প্রতিকার কী হবে ও দায়ীদের শাস্তির বিধান কী হবে তা খসড়া আইনটিতে সুনির্দিষ্ট নয়।

খসড়া আইনটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকের ন্যূনতম সংখ্যা মাত্র তিনজন রাখা হয়েছে, যেখানে পর্ষদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫ জন হতে পারবে। খসড়ায় বলা হয়েছে যে স্বতন্ত্র পরিচালকরা কেবল ইসলামিক ব্যাংক কোম্পানির স্বার্থে মতামত দেবেন। ব্যাংকের প্রায় ৯০ শতাংশ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে আসে। সে বিবেচনায় স্বতন্ত্র পরিচালকের ন্যূনতম সংখ্যা ও কার্যক্রমের বিবরণে সংশোধন আনা প্রয়োজন। এছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়োগে ব্যাংক গ্রাহকদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বতন্ত্র পরিচালকের নিয়োগ যদি শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে হয়, গ্রাহকদের স্বার্থকে তারা বাস্তবে কতটুকু অগ্রাধিকার দেবেন সে প্রশ্ন রয়ে যাবে। আবার এক পরিবার থেকে দুজন পর্ষদ সদস্য হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে খসড়া আইনটিতে, যা বিশেষ পরিবার কর্তৃক ব্যাংকে প্রভাব খাটানো বা এর নিয়ন্ত্রণ ও তারা ব্যাংকের মালিক এমন বিদ্যমান চর্চা ও মানসিকতাকে ধারাবাহিকতা প্রদান করবে। এ পরিস্থিতি প্রতিরোধে এক পরিবার থেকে একজনের বেশি পর্ষদ সদস্য হওয়ার সুযোগ সব ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রে রহিত করা প্রয়োজন।

সব পরিচালকের ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা আইনে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। খসড়া আইনটিতে কেবল স্বতন্ত্র পরিচালকদের শরিয়াহ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থাবিষয়ক পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়া বাস্তবিক অর্থে পরিচালনা পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না। একই রকমভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর ক্ষেত্রেও ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থাবিষয়ক পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা প্রয়োজন। অন্যথায় দেখা যাবে, সুদভিত্তিক ব্যাংক থেকে এসে তিনি তার পূর্ববর্তী মানসিকতায় ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করছেন এবং অন্যদের ওপর সে অনুযায়ী চাপ সৃষ্টি করছেন।

খসড়া আইনটিতে একটি শরিয়াহ গভর্ন্যান্স কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, তবে এর নিয়োগ, কাঠামো, কার্যপরিধি ও ক্ষমতা ব্যাখ্যা করা হয়নি। এ বিষয়গুলো আইনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির সঙ্গে এর পার্থক্য ও যোগাযোগ সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (আইএফএসবি) প্রণীত মানের আলোকে এ বিষয়াগুলো নির্ধারণ করা যথাযথ হবে।

ইসলামিক ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ পরিপালন সুসংহত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (আওয়াফি) কর্তৃক প্রণীত শরিয়াহ মান পরিপালন আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যেমনটা বাহরাইন করেছে। একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতে আওয়াফির হিসাবরক্ষণ মান পরিপালন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বর্তমানে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক শরিয়াহ মান পরিপালনে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান বাধ্যবাধকতার ফলে আর্থিক প্রতিবেদনগুলো আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক দূরে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ ব্যাংক আওয়াফির সদস্য।

ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থায় অর্থ জমা হিসাবকে দুই ভাগে ভাগ করা প্রয়োজন—আমানত হিসাব ও বিনিয়োগ হিসাব। বর্তমানে কেবল আমানত হিসাবের বিধান বিদ্যমান, যার মাধ্যমে এমনসব চর্চার প্রচলন হয়েছে যা শরিয়াহ দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। আমানত হিসাব ও বিনিয়োগ হিসাবের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শরিয়াহ মানের সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং চর্চার সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা হবে।

খসড়া আইনটির যে বিষয় সংশ্লিষ্টদের সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হচ্ছে, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ না রাখা। এছাড়া প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনক্রমে ইসলামিক ব্যাংকিং সাবসিডিয়ারি গঠন করতে পারবে।

তত্ত্বগত দিক থেকে ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং বন্ধ করে দেয়া ও সাবসিডিয়ারি সৃষ্টির ধারণা ভালো। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে ইসলামিক ব্যাংকিং চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি না দিলে তারা অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ সৃষ্টিতে যে বিনিয়োগ করেছে তা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বড় বিপদে পড়বে দেড় হাজারের অধিক জনবল, যারা সরাসরি এ ধরনের ব্যাংকিংয়ে কাজ করছে।

প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোয় ইসলামিক ব্যাংকিং বন্ধ করে দেয়ার একটি যুক্তি দেয়া হয়েছে যে এর মাধ্যমে প্রচলিত ও ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমতা আনা হবে। তবে এ সিদ্ধান্ত কি বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রসারিত করবে নাকি সংকুচিত করবে—এ ধরনের কোনো পর্যালোচনা বাংলাদেশ ব্যাংক করেছে কিনা সে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।

খসড়া আইনে প্রচলিত ব্যাংক কর্তৃক ইসলামিক ব্যাংকিং সাবসিডিয়ারি গঠনের যে বিকল্প রাখা হয়েছে তা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের সাবসিডিয়ারি গঠনের সুযোগ ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২০১৩ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কেন পরবর্তী সময়ে এর অধীনে সাবসিডিয়ারি গঠনের নির্দেশনা না দিয়ে উইন্ডো বা ব্রাঞ্চভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন দিয়ে গেল সেটি একটি প্রশ্ন। আবার কেন ২০২৩ সালের সংশোধনীতে এ সুযোগ বিলুপ্ত করা হলো সেটিও একটি প্রশ্ন। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিতে ধারাবাহিকতার ঘাটতির দায় ব্যাংকগুলো কেন নেবে?

প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর অধিকাংশের ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের আকার অনেক ছোট, যা সাবসিডিয়ারি গঠন ও পরিচালনার খরচ কোনো অবস্থায় বহনে সক্ষম নয়। আইন প্রস্তুত কমিটির প্রয়োজন বাস্তবতা পর্যালোচনা করা।

ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং বন্ধ করে দেয়া নয়, বরং এর মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। পূর্ণাঙ্গ ইসলামিকে রূপান্তর করতে হলে সময় ও সুবিধা দিতে হবে, অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিজেদের প্রশ্ন করা প্রয়োজন যে ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থা প্রসারের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তারা গড়ে তুলেছেন কিনা।

খসড়া আইনে অনেক ছোটখাটো বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। শরিয়াহভিত্তিক বিভিন্ন চুক্তির নাম ও সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে, যার ভাষার ব্যবহারে সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থায় উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। খসড়া আইনে ব্যবহৃত পরিভাষায় সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার চর্চার প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। সর্বোপরি ইসলামিক ব্যাংকিং আইন একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে প্রস্তুত করা প্রয়োজন, যেটিতে একটি ন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে।

মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ: ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থাবিষয়ক গবেষক

আরও