অধ্যাপক নুরুল ইসলাম একজন ভক্তের অর্ঘ্য

অধ্যাপক নূরুল ইসলাম আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। ১৯৭৪ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই, তখনই তিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। এ পদে যোগ দেয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তিনি সে সময়ে যাদের পড়িয়েছেন, তাদের কয়েকজন আমার শিক্ষক ছিলেন।

অধ্যাপক নূরুল ইসলাম আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। ১৯৭৪ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই, তখনই তিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। এ পদে যোগ দেয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তিনি সে সময়ে যাদের পড়িয়েছেন, তাদের কয়েকজন আমার শিক্ষক ছিলেন।

সে সময়ে আমরা অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সম্পর্কে সম্ভ্রম ও ভক্তি নিয়ে বেড়ে উঠেছি। একপর্যায়ে তার লেখা একটি বই আমাদের হাতে আসে, ১৯৭৯ সালে যা প্রকাশ হয়েছিল। বইটির নাম ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ- এ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি। বইটিতে তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কাল তুলে ধরেছেন, যাকে বলতে পারি বাংলাদেশের সবচেয়ে অনিশ্চিত ও উত্তেজনাপূর্ণ, হৃদয়গ্রাহী ও হৃদয়বিদারক, মহৎ ও ট্র্যাজিক ধরনের সময়। যে ধরনের সময়কে চার্লস ডিকেন্স টেল অব টু সিটিস গ্রন্থে লিখেছেন—ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অব দ্য টাইমস, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অব দ্য টাইমস।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বইটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ মূল্যায়ন রয়েছে। তার মৃত্যুর পর আজ মনে হচ্ছে, সেটি এখন ইতিহাসে পরিণত হলেও তার থেকে এখনো অনেক মূল্যবান শিক্ষা নেয়ার আছে। তিনি লিখেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর শাসক শ্রেণী সমাজের প্রায় সব অংশের সার্বিক আনুগত্য লাভ করেছিল। কিন্তু শুরু থেকেই রক্ষণশীল শক্তি এবং বিপ্লবী শক্তি ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। দলের সর্বোচ্চ শিখরে আসীন নেতৃত্ব উভয় শক্তির প্রতিযোগিতার মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করেন। দৃশ্যত মনে হচ্ছিল, দুই শক্তির কোনোটির প্রতিই তার কোনো শক্ত অঙ্গীকার ছিল না। এ নেতৃত্ব সমতাধর্মী নীতি গ্রহণ করে সমাজতন্ত্র¿ অভিমুখীন পদক্ষেপ গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন, যদিও এর বিরুদ্ধে রক্ষণশীল শক্তি বা কায়েমি স্বার্থের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। দলীয় নেতৃত্ব ক্রমাগত একের পর এক আপস করতে থাকেন। একদিকে এক পা এগিয়ে পরমুহূর্তে অন্যদিকে আরেক পা দিয়ে আগের পদক্ষেপকে বাতিল করে দিতে থাকেন। বস্তুত রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেছে দুই রাস্তাই খোলা রাখতে। দলের সাংগঠনিক কাঠামো এবং অর্থনীতিতে যেসব শক্তিশালী আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর অবস্থান ছিল, তার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব সরাসরি বিরোধে যেতে পারেননি। এক্ষেত্রে আশঙ্কা ছিল, এ গোষ্ঠীগুলোকে যদি আলোকিত আত্মস্বার্থের কথা বলে, বুঝিয়ে পক্ষে না এনেই তাদের ক্ষমতা ও সুবিধাগুলো কেড়ে নেয়া হয় তাহলে তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরোধী অবস্থান নেবেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যত অর্থনৈতিক নীতিমালা ও কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, তাকে এ সুনির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই মূল্যায়ন ও বিচার করতে হবে। (দেখুন নুরুল ইসলাম, ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ- এ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি (পৃষ্ঠা ৪ ও ৫) অধ্যাপক নুরুল ইসলামের এ মূল্যায়ন এখনো শিক্ষণীয় ও প্রাসঙ্গিক। তবে এ প্রশ্ন উঠতে পারে—রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল তার পুরনো সহচরদের মধ্যে যারা নতুন প্রয়োজনের সঙ্গে একমত তাদের নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া এবং জনশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া— সেটা কি শেখ মুজিবুর রহমান করতে পারতেন না? সেই সক্ষমতা ও ইচ্ছা কি তার ছিল? ১৯৭৫ সালে যেহেতু তাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়, সেজন্য এ প্রশ্নের যাচাইযোগ্য উত্তর আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে তার মৃত্যুর আগের পদক্ষেপগুলো এবং মৃত্যুর পর কারা উপকৃত হলেন তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে আমরা তা অনুমানের চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু অধ্যাপক নুরুল ইসলাম কঠোর প্রত্যক্ষবাদী অর্থনীতিবিদ হিসেবে সে ধরনের কোনো বিশেষণে ইচ্ছুক ছিলেন না।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আমৃত্যু মিশ্র অর্থনীতির পক্ষেই থেকে গেছেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম কিছুটা প্রয়োগবাদী, যতটুকু বাস্তবে ঘটেছে ততটুকুর ভিত্তিতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছেন। নীতিগত দুর্বলতা আর সবলতা উভয়কে তিনি চিহ্নিত করেছেন এবং আমার মনে হয় গণতান্ত্রিক পথে, বিবর্তনের পথে সমাজতন্ত্রকে পৌঁছানো সম্ভব বলে তখন তার মনে এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেজন্য অন্তর্বতীকালে যে নিবেদিতপ্রাণ অঙ্গীকারসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং দল প্রয়োজন, যার একই সঙ্গে জনগণের প্রতি অঙ্গীকার, নৈতিক নিষ্ঠা ও কৌশলগত নমনীয়তা থাকবে সে রকম নেতৃত্ব তিনি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সর্বাঙ্গসুন্দর রূপে খুঁজে পাননি। হয়তো তিনি ঠেকে ঠেকে তা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন এবং অবশেষে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে বিদেশে চলে যান। যদিও বঙ্গবন্ধু তাকে বিদায়লগ্নে গান শুনিয়েছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ নাই আসে, তবে একলা চলো রে...’ (দেখুন, নুরুল ইসলাম, এন ওডিসি- দ্য জার্নি অব মাই লাইফ। পৃ. ৮৬) 

তবে বিদায় মুহূর্তে বাকশাল বা একদলীয় শাসনের পক্ষে আমাদের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের কেউই ছিলেন না। তারা সবাই সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এ পদ্ধতি সমর্থন করেননি। তবে বাকশাল সফল বা ব্যর্থ হলে কী হতো এ বিতর্কে তিনি স্বাভাবিকভাবেই নাক গলাননি। সুতরাং শোষিতের গণতন্ত্র¿ বনাম শোষকের গণতন্ত্র¿ বা বুর্জোয়া গণতন্ত্র, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র, একদলীয় ব্যবস্থা বনাম অংশীদারত্বমূলক গণতন্ত্র বা উচ্চতর গণতন্ত্র ইত্যাদি বিতর্ক তার কাছে প্রাসঙ্গিক ছিল না কারণ তিনি মতাদর্শিক কোনো জায়গা থেকে এগুলোকে দেখেননি। তার বিচার পদ্ধতি হচ্ছে বাস্তব তথ্যমূলক বিচার-আদর্শগত বিশ্বাসের মূল্যায়নে তার কোনো আগ্রহ নেই। এ প্রায়োগিক পদ্ধতি যে আমৃত্যু তার কাছে সত্য ছিল তা আমরা টের পাই সম্প্রতি (২০ নভেম্বর, ২০১৪) প্রথম আলোয় প্রকাশিত তার একটি সাক্ষাৎকারে। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র¿ সম্পর্কে। তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘উন্নয়ন ও গণতন্ত্র এ দুটোয় সম্পর্ক বড় জটিল। আপনার প্রশ্ন তো এটাই যে গণতন্ত্র না হলে উন্নয়ন হবে কিনা? ইতিহাস এটাই বলে যে উন্নয়ন হতে পারে গণতন্ত্রে বা বিনা গণতন্ত্রে। এটা নির্ভর করে নেতৃত্ব উন্নয়নের প্রতি কতটুকু সংকল্পবদ্ধ এবং কী নীতি অনুসরণ করে, তার ওপর।’

তাকে প্রশ্ন করা হয় যে আইয়ুব খান তার আমলে কিছু উন্নয়ন কি করতে পেরেছিলেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, পেরেছিলেন। শেষে তো ধ্বংস হলো। দুটি কথা আছে। উন্নয়নের সূচনা যেকোনো অবস্থায় ঘটতে পারে। গণতন্ত্রে বা বিনা গণতন্ত্রে, অর্ধগণতন্ত্রে, কমিউনিজমে, সমাজতন্ত্রে—যেকোনো রাজনৈতিক অবস্থায় উন্নয়নের সূচনা ঘটতে পারে; যদি নেতৃত্ব সেটা চায়। এর সঙ্গে গণতন্ত্র থাকা না-থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। ইতিহাস বলে, উন্নয়ন গণতন্ত্রে হয়েছে, উন্নয়ন স্বৈরতন্ত্রে হয়েছে। আবার ইতিহাস এটাও বলে যে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রে, যখন রাজনীতি ধসে পড়ছে, তখন অর্থনীতিও ভেঙে পড়ছে। আইয়ুবের সময় অর্থনীতিতে উন্নতি ঘটেছিল। তারপর যখন রাজনীতি ভেঙে গেল, তখন অর্থনীতিও ভেঙে গেল। আরেকটি হচ্ছে, উন্নয়ন যখন উচ্চস্তরে চলে যায়, মানুষ তখন অবস্থার উন্নতি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে চায় না, তখন তারা রাজনৈতিক অধিকার চায়। এর আগ পর্যন্ত তারা কাপড়চোপড় ও জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাজেই অনেকে বলেন, আর্থিক অবস্থা যখন অনেক ভালো হবে, যখন আর নিজের খাওয়া-দাওয়া অর্থাৎ বস্তুগত সব চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে, মানুষ তখন রাজনৈতিক অধিকারের দিকে নজর দেবে। উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের এই হচ্ছে সম্পর্ক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের সূচনা সম্ভব হতে পারে বলে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বিশ্বাস। ইতিহাস অবশ্য তার পক্ষেই কথা বলবে। 

ড. এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরও