সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে গ্রামীণ অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট ও বন্যার প্রাদুর্ভাবে অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কৃষি এবং কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার, ব্যাংক খাতের দুর্দশা প্রভৃতি কারণে এ খাতে অর্থায়ন সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় ঘুরে দাঁড়াতেও হিমশিম খাচ্ছেন গ্রামীণ উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি কমেছে প্রায় ১ দশমিক ১২ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে গ্রামীণ শিল্পকে বাঁচাতে হলে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হবে। তেমনি সরকারের প্রণোদনাও বাড়ানো প্রয়োজন।
দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল দশমিক ১৬ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কৃষির অবদান কমেছে।
এদিকে কৃষিভিত্তিক পণ্যসহ ছোট আকারের নানা ধরনের উৎপাদন ও সেবামুখী সিএমএসএমই উদ্যোগগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। এতে গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সিএসএমই উদ্যোগের বড় একটি অংশ কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় গড়ে উঠেছে। কিন্তু চলতি বছর দুই দফা বন্যায় দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে এ উদ্যোগগুলোয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিএমএসএমই খাত। বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের কৃষি, ফল-ফসল ও প্রাণিসম্পদ ব্যাপক মাত্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পারছেন না সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। আবার ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। সচল থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। যে কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা ও ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির জন্য বর্তমানে সহজ অর্থায়ন সুবিধা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় সরকারের দিক থেকে অর্থায়ন বাড়ানো ও সহজ করার উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে অনেক সিএমএসএমই উদ্যোগ অর্থায়ন সুবিধার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা। সবাইকে এ সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন।
দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হচ্ছে সিএমএসএমই খাতের মাধ্যমে। ছোট আকারের কৃষি উদ্যোগ কিংবা পশুপালন খামার, ছোট আকারের উৎপাদনমুখী শিল্প কিংবা সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অসংখ্য উদ্যোক্তা নিজেদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি আরো অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এসব উদ্যোক্তার কেউ কেউ ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে নিজেদের আরো বড় পরিসরে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে প্রচলিত সিএমএসএমই উদ্যোগের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নে খাতটির পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগানো প্রয়োজন। এজন্য খাতটির উন্নয়নে দরকার পর্যাপ্ত অর্থায়ন সুবিধা নিশ্চিত ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে সিএমএসএমই উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিতকরণ। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে নীতিসহায়তা এ খাতের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত এজেন্ট ও উপশাখা ব্যাংকিং সেবার সম্পূর্ণ সুফল যেন প্রান্তিক উদ্যোক্তারাই পান তা নিশ্চিত করতে হবে। দেখা গেছে, এজেন্ট ও উপশাখা ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামে ঋণপ্রবাহ না বেড়ে উল্টো গ্রামের পুঁজি ব্যাংক খাতে যুক্ত হয়েছে আমানত হিসেবে। সেসব টাকা ঋণ আকারে পেয়েছে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ী, যাদের সিংহভাগই ঋণখেলাপি। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, গ্রামীণ এলাকা থেকে গৃহীত ঋণ ওইসব এলাকায়ই বিতরণ করা গেলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। স্থবিরতা কাটাতে হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে।
এ উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর উৎপাদন কার্যক্রমে ফিরতে না পারা কৃষক ও খামারিদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বশেষ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ফেনী। বন্যায় এখানকার পোলট্রি ও ডেইরি খাতের অন্তত পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বন্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত এসব ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রণোদনা, স্বল্পসুদে ঋণদানসহ নানা দাবিতে বেশ কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি দিলেও এখনো কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। যে কারণে মাংস, ডিম ও দুধের সংকট বর্তমানে প্রকট হচ্ছে। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ ছাড়া খাদ্য উৎপাদনে জড়িত গ্রামীণ অর্থনীতির বড় এ খাতকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য কাজ। সরকারি প্রণোদনা এ খাতে স্বস্তি বয়ে আনতে পারে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা হারানো গতি ফিরে পেতে পারে।