ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক সোমেশ্বরী নদী। বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের রানীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে। বর্তমানে নদীটি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। নদীর সর্বনাশ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তের এক কিলোমিটার ভাটি বিজয়পুর ও ভবানীপুর থেকে। এখান থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার ভাটিতে পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। এসব বালুমহালে নিয়ম ভঙ্গ করে তোলা হচ্ছে বালি। প্রায় এক যুগ ধরে সোমেশ্বরী নদীর ভূগর্ভস্থ থেকে যত্রতত্র বালি-পাথর উত্তোলনে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে সোমেশ্বরীর শাখা নদী আত্রাখালীতেও। এছাড়া আত্রাখালী নদীর মূল প্রবেশদ্বার আটকে বালির ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরি করায় সোমেশ্বরী নদীর পানি শাখা নদী আত্রাখালীতে প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ে। একসময়ের খরস্রোতা আত্রাখালী নদী এখন শুধু নামেই নদী। প্রায় ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০ মিটার প্রস্থের নদীটি এখন পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে।
গত বুধবার সরেজমিন সোমেশ্বরী নদী পরিদর্শনের সুযোগ হয়। সঙ্গে ছিলেন আরো চার গণমাধ্যমকর্মী এবং দুজন পরিবেশ সংগঠক। সোমেশ্বরীর বুক থেকে যেভাবে বালি তোলা হচ্ছে চোখে না দেখলে তা বলে বোঝানো যাবে না। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ পৌঁছে পূর্বধলার সড়কে ঢোকার পরই দেখা মিলবে সোমেশ্বরীর ধ্বংসযজ্ঞের তাজা চিহ্ন। দুর্গাপুরের বিরিশিরি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ৩৭ কিলোমিটার রাস্তায় শুধু বালিবাহী ট্রাক আর ট্রাক। বেশির ভাগের যেমন নেই নাম্বারপ্লেট, তেমনি ত্রিপল। বালি উড়ে পড়ছে। এরই মধ্যে শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কের নানা স্থানে সাইনবোর্ডে লেখা ‘ওভারলোডেড ও ভেজা বালিভর্তি ট্রাক চলবে না’। কিন্তু সব ট্রাকেই ভেজা বালি ও ওভারলোডেড। চারপাশে আলাদা কাঠ লাগিয়ে বালি নেয়া হচ্ছে। ভয়ংকর বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত চারপাশ।
জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীতে পাঁচটি বালুমহাল রয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তের এক কিলোমিটার ভাটি বিজয়পুর ও ভবানীপুর থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার ভাটিতে অন্তত পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের হাতেই থাকে ইজারা। নতুন করে এ বছরের জন্য ১, ২, ৪ ও ৫ নম্বর বালুঘাট ইজারা নিয়েছেন নেত্রকোনা-১ (কলমাকান্দা-দুর্গাপুর) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী। নিজের রুহী এন্টারপ্রাইজের নামে ঘাটগুলো প্রায় ৭৫ কোটি টাকায় ইজারা নিয়েছেন। আর ৩ নম্বর বালুমহালটি ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন বিরিশিরি ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলামের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা অনুসারে পাম্প বা ড্রেজিং কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালি উত্তোলন করা যাবে না। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য, জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বালি উত্তোলন করা যাবে না। বালুমহাল ইজারার শর্তে এমন থাকলেও কিছুই মানা হচ্ছে না। নদীতে হাজার হাজার খননযন্ত্র বসিয়ে দিন-রাত কর্কশ শব্দে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে এলাকার শত শত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কটি। প্রতিদিন কয়েক হাজার ট্রাকে মাত্রাতিরিক্ত ভেজা বালু পরিবহনের কারণে ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত ৩৭ কিলোমিটার সড়কটি এখন স্থানে স্থানে ভেঙে গেছে। এতে একদিকে যেমন তীব্র যানজট লেগে থাকে, অন্যদিকে কাদাপানির কারণে হেঁটে চলাও কষ্টকর। বছর দুয়েক আগে বালি পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ একটি ওজন পরিমাপক যন্ত্র বসালেও রহস্যজনক কারণে সেটির কার্যক্রম শুরু হয়নি।
বিরিশিরি সেতুতে ওঠার পর বাম পাশে তাকালেই দেখা মেলে নদীখেকো বীভৎস বালুমহাল। পাগলা মোড়ের ১ নম্বর ঘাটে ৫০ ফুটের বেশি গর্ত করে শত শত ড্রেজিং মেশিনে তোলা হচ্ছে বালি। একটি ড্রেজারের মালিক জানান, ইজারাদার দুজন হলেও যখন যার খুশি, যেখান থেকে বালি তুলতে পারেন। ট্রাকপ্রতি বালির জন্য দিতে হয় ১৩-১৪ হাজার টাকা। এসব বালি শিমুলতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়। দৈনিক এ এলাকায় চার হাজারের বেশি ট্রাক চলাচল করে। প্রতিটি বড় ট্রাকে ৫২০-৫৮০ ঘনফুট বালি থাকে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুরো এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন বালি ব্যবসায়ীরা। মোড়ে মোড়ে মোটরসাইকেলে চলছে তাদের টহল। নতুন লোক এলেই তার গতিবিধিতে রাখছে নজর। ভয়ে স্থানীয়দের কেউ মুখ খোলার সাহস করেন না।
একটু খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম, ইজারাদার নামে দুজন হলেও এখানকার ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও প্রশাসনের লোক বালি ব্যবসায় জড়িত। নিয়মিত চাঁদা দিয়ে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করা হয়। নির্দিষ্ট বালুমহালের বাইরে আশপাশের নদী থেকেও তোলা হচ্ছে বালি। দুর্গাপুর উপজেলার ২ নম্বর দুর্গাপুর ইউনিয়নের দেবথৈল, মধ্যম বাগান ও ফাড়ংপাড়া, শ্মশানঘাট, চেরানখোলা এলাকার কয়েক কিলোমিটার ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে শত শত নিষিদ্ধ ‘ছয় সিলিন্ডার’ বা ‘চার সিলিন্ডার’ নামের বাংলা পাম্প ড্রেজার। ড্রেজারচালকরা জানান, এসব ড্রেজার দিয়ে নদীর ৫০-৮০ ফুট গভীর থেকে বালি তোলা হচ্ছে। সঙ্গে পাথরও ওঠে। অপরিকল্পিত বালি তোলায় নদীর বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে গভীর গর্ত।
ড্রেজিং বিশেষজ্ঞরা বলেন, বালুমহাল থেকে কতটুকু বালি কাটা হবে, তা সমীক্ষা করে নেয়ার নিয়ম। ‘কাটার সাকশন ড্রেজার’ ব্যবহার করতে হবে, যাতে নদীতে সমভাবে সুইং করে তলদেশ সুষম খনন হয়। কিন্তু বাংলা পাম্প ড্রেজার একই স্থানে গর্ত করে বালি তোলে। ফলে চারপাশ ভেঙে পড়ে। নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হওয়ায় বালুমহাল আইনে এসব ড্রেজারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সোমেশ্বরীর ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজের সঙ্গে। তিনি আশস্ত করেছেন ইজারাদারদের নিয়মিত সতর্ক করা হচ্ছে শর্ত রক্ষার জন্য। বালি তোলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘উজান থেকে প্রচুর বালি আসে নদীর স্রোতে। বালি না তোলা হলে নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে ভরাট হয়ে যাবে। নদী রক্ষার জন্যই বালি তোলা প্রয়োজন। সে কারণেই বালুমহালের ইজারা দেয়া হয়েছে।’
বালি তোলার পক্ষে আরেকটি ক্ষুরধার যুক্তি তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, ‘ সোমেশ্বরীর বালি খুবই ভালো মানের। পদ্মা সেতু, থার্ড টার্মিনালসহ বড় বড় অবকাঠামো টেকসই করতে এসব বালি ব্যবহার হচ্ছে।’ আশার কথা হলো, উন্নয়ের স্বার্থেই নদী বাঁচানো প্রয়োজন—এ বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেননি।
ঢাকায় ফিরে সোমেশ্বরীর বিপর্যস্ত পরিবেশ নিয়ে কথা বলি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজের সঙ্গে। দেশের নদ-নদী নিয়ে একাডেমিক কাজ করার সুবাদে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট তুলে ধরেন এ গবেষক। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। এজন্য বালি ও পাথর লাগবে সেটাও অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বর্তমানে যেভাবে বালি-পাথর উত্তোলন হচ্ছে আমরা শতভাগ নিশ্চিত বিজ্ঞানভিত্তিক হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে না করেই এমন কর্মযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। যে হাইড্রোগ্রাফির কথা বলা হচ্ছে সেটা জনগণের সামনে প্রকাশ করা হোক, আমরা সেটাকে চ্যালেঞ্জ করব। এভাবে নদী মেরে, পরিবেশ ধ্বংস করে, প্রাণবৈচিত্র্য নিঃশেষ করে বালি উত্তোলনের কথা নিশ্চয়ই সার্ভেতে বলা হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘ সোমেশ্বরীর সর্বনাশ শুধু বালি উত্তোলনের মাধ্যমেই হচ্ছে না, সেখানে শব্দ দূষণের তাণ্ডব চলছে। এর ফলে আশপাশের সাধারণ লোকজন-নারী-শিশু রাতে ঘুমাতে পারেন না। গ্রামবাসীর ঘুম হারাম করে রাতে বিকট শব্দের ড্রেজার চালানোর অনুমতি কে দিয়েছে? আমরা মনে করি, সোমেশ্বরীতে বালি উত্তোলনের নামে ভয়ংকর অরাজকতা চলছে। পুরো নদীটাকেই ওপেন মাইনড ফিল্ড করা হয়েছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কামানের গোলার মতো শব্দ হচ্ছে। স্থানীয় মানুষজন সেখানে বসবাসের কোনো পরিবেশ নেই। নদীর মরফোলজি নেই, নদীতে কোনো প্রাণী বসবাসের পরিবেশ নেই।’
সোমেশ্বরী নদীর বালুমহালের ইজারা বাতিল চেয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সাফ কথা—‘কয়েকজন বালি ইজারাদারের সঙ্গে প্রশাসন নিশ্চুপ থেকে সোমেশ্বরী নদীটি হত্যা করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘নদীটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় ঐতিহ্য। বাংলাদেশের ইকো ট্যুরিজম সাইটের অন্যতম। এ নান্দনিক নদীকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সামনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। একটা নদী থেকে যদি প্রতিদিন চার হাজার ট্রাক বালি তোলে তাহলে সেখানে আর নদী থাকে কীভাবে? আপনারা যারা সেখানে গিয়েছেন তারা কি নদীর কোনো অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছেন? প্রশাসনের সামনেই যদি একটি নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে তাহলে সে প্রশাসনের দরকার কী? এখানে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে কী করে? ডিসি মহোদয় কী করেন? নদী রক্ষা কমিশন কী করে? পানি উন্নয়ন বোর্ড কী করে? কারোই তো মনে হয় জাতীয় স্বার্থে নদীটা রক্ষার দায়বদ্ধতা নেই। সোমেশ্বরী এখন আর নদী নেই, ক্ষীণ একটা জলধারা। লুট হয়ে যাচ্ছে নদী। সবখানে অননুমোদিত বাংলা ড্রেজার দিয়ে বালি তোলা হচ্ছে। অবিলম্বে বালি তোলা ইজারা বন্ধ করতে হবে। নদীকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব, বালি ব্যবসায়ীদের নয়। অন্তত তিন-চার বছর বালি তোলা বন্ধ রেখে নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।’
আল ফাতাহ মামুন: সাংবাদিক