ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্য এই যে উপমহাদেশের এ অঞ্চলে আজ পর্যন্ত যখনই কোথাও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত, দুর্ভিক্ষ কিংবা অন্য কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখনই তা এক শ্রেণীর অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি মুনাফা অর্জনের মোক্ষম সুযোগ হয়ে ধরা দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) মন্বন্তরের কালে কিংবা ১৯৪৬ ও ১৯৬৪-এর দাঙ্গায় মানুষের জীবন যখন চরমভাবে বিপর্যস্ত, তখন এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ী এ সুযোগে তাদের মুনাফার অংককে এতটাই বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হন যে তাদের অনেকে অতিসাধারণ বেচাকেনার মৌসুমি ফড়িয়া বা দোকানদার থেকে রাতারাতি কোটি টাকার ব্যবসায়ীতে পরিণত হন। আর তাদের সেসব একচেটিয়া মুনাফার বলিতে পরিণত হন এ দেশের সাধারণ মানুষ। পঞ্চাশের মন্বন্তরে এ দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে প্রাণ হারায়, ১৯৪১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী যখন এ দেশের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৬ কোটি ৩০ লাখের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। অথচ সে সময় দেশে খাদ্যের কোনো অভাব ছিল না। রাষ্ট্রের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরাই সেদিন এ সংকট সৃষ্টি করেছিল। গবেষণা গ্রন্থের তথ্য জানাচ্ছে যে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের উপেক্ষা ও অবহেলার কারণেই সেদিন তাদের শাসনাধীনে থাকা বাংলায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছিল।
প্রায় একই অবস্থা এখন বিরাজ করছে আজকের বাংলাদেশেও। দেশের বাজারে বা গুদামে পণ্য বা মালামালের কোনো অভাব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজারে সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই। তার পরও অধিকাংশ পণ্যের মূল্য বেড়েই চলেছে এবং এর পেছনে সেদিনের রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতার মতো আজও কোনো কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতকার অসাধু ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মেনে অতীতের মতো আজও বাংলাদেশের অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ২০২০-২১ সালের করোনা অব্যবহিত পরের ইউক্রেন যুদ্ধ, ২০২২ থেকে চলে আসা রাজনৈতিক সংকট ইত্যাদিকে পুঁজি করে জনগণকে জিম্মি বানিয়ে যথেচ্ছ হারে যে যার মতো করে সম্পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন। তবে পার্থক্য এই যে ১৯৪৩-এ ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও এখনকার সংকটে খাদ্যাভাবে কেউ মৃত্যুবরণ করছে না। তবে নিম্ন আয়ের, প্রত্যন্ত গ্রামের ও চা শ্রমিকদের মতো প্রান্তিক পর্যায়ের কোটি কোটি মানুষ বেঁচে থেকেও অনেকটাই জীবন্মৃত, যা উপলব্ধি করার মতো জীবনবোধ ও মানবিক সামর্থ্যের ঘাটতি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে যথেষ্টই রয়েছে বৈকি!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতে সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণ মোকাবেলায় নিজ পক্ষের সৈন্যদের ভবিষ্যতের জন্য অপ্রয়োজনীয় মাত্রায় খাদ্যের আপৎকালীন মজুদ গড়ে তোলার নীতি ও কৌশল গ্রহণ করার ফলেই দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও তা জনগণের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। একইভাবে স্বশ্রেণী ও গোষ্ঠীর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থানকারী ব্যক্তিরা দেশের সাধারণ মানুষকে তাদের আয় ও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন কিনা সে প্রশ্ন যথেষ্টই রয়েছে। চার্চিল বা ব্রিটিশ সরকারের আরাধ্য ছিল যুদ্ধে জয়লাভের উদ্দেশ্যে জনগণকে অভুক্ত রেখে হলেও সৈন্যদের তুষ্ট ও প্রাণবন্ত রাখা। একইভাবে সরকারের ভেতর অবস্থানকারী অসাধু ব্যক্তিদেরও আরাধ্য হচ্ছে, জনগণকে কষ্টে রেখে হলেও ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে সুরক্ষাদান।
ওপরে উল্লিখিত সাম্প্রতিক তিনটি সংকটের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে করোনা। করোনাকে উপলক্ষ করে সরকার কর্তৃক ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা, নগদ ভর্তুকি, সহজ শর্তের ঋণ, সুদ মওকুফ সুবিধা, টিকা ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক মওকুফকরণ ইত্যাদি হেন সুবিধা নেই যা দেয়া হয়নি। জেনে এবং দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন খাতের এমন বহুসংখ্যক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী আছেন যারা শুধু করোনাকে উছিলা করে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন এবং সেই সুবাদে তখন তাদের অনেকেরই আরাধ্য ছিল করোনা যেন আরো বেশকিছু দিন থেকে যায়। ওই যে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি ২০২৪ সালে করোনার পুনঃআবির্ভাব বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দিলেন, তা শুনে ওই ব্যবসায়ীদের অনেকেই আবার নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন, যদি আবার করোনার দেখা মেলে এবং তা তাদের জীবনে ব্যবসায়িক আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়!
বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়েও সেই একই কথা। এক্ষেত্রে বিদ্যমান অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ব্যবসায়ীই নানাভাবে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে নানাভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেয়া, অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ব্যাংক ঋণ গ্রহণ বা গৃহীত ঋণের সুদ মওকুফকরণ কিংবা বকেয়া ঋণের পুনঃতফশীলীকরণ, কর ও শুল্ক ফাঁকি বা রেয়াত সুবিধা আদায় ইত্যাদি অন্যতম। ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়ে গেল, সেখানেও ব্যবসায়ী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৭ শতাংশের বেশি এবং এদের মধ্যকার অধিকাংশই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সার্বিক হার এখন ৬৬ শতাংশ। অবশ্য এরই মধ্যে লোকজন আসন্ন জাতীয় সংসদকে কোটিপতিদের ক্লাব হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করেছে, যা খুবই যথার্থ। কারণ কোটিপতির বাইরে অ-কোটিপতি সংখ্যালঘু সদস্যের সংখ্যা সেখানে প্রায় থাকছে না বললেই চলে। এ অবস্থায় ওই কোটিপতি সদস্যরা যখন উল্লিখিত ক্লাবে বসবেন, তখন তারা যে সাধ্যমতো সব ফায়দাই উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন, তাতে কারোরই সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ নেই। ফলে নির্বাচনী অস্থিরতাকে পুঁজি করে এ পর্যন্ত অবৈধ পন্থায় যে পরিমাণ সুবিধা তারা করায়ত্ত করেছেন, ক্লাবে বসার পর বৈধভাবেই এর চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা তখন তারা গ্রহণ করতে পারবেন। দেশের জনগণকে এখন সেটি দেখার জন্যই অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
মোট কথা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত-সংঘর্ষ, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ-মহামারী, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি সবই হচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্য এক-একটি মোক্ষম আশীর্বাদ। ওই যে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক কারসাজিতে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে (ধারণা করা যায় তেমনটি হবে না)—সেটি যেমন তাদের জন্য সম্ভাব্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি আবার আশীর্বাদ হতে পারে এ তথ্যও যে নির্বাচনের পরও হয়তো বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিসমাপ্তি ঘটবে না। আশঙ্কা অনুযায়ী যদি তা না ঘটে, তাহলে সেটি যে দেশের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের জন্য তা হবে বাড়তি মুনাফা লোটার আরেকটি মোক্ষম উপলক্ষ। এবং ধারণা করা যায় যে অনেক ব্যবসায়ী হয়তো এখন থেকেই সে মোক্ষম সুযোগটির জন্য অপেক্ষায় দিন গুনছেন। কিন্তু নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে না গেলে সাধারণ জনগণের জীবনযাপনের ভোগান্তি ও কষ্ট সামনের দিনগুলোয় আরো বেড়ে যাবে না কি?
সব মিলিয়ে তাই বলব, সামনের দিনগুলোয় ব্যবসায়ীদের আনুষ্ঠানিক প্রভাব বৈধভাবেই হয়তো আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কর্তৃত্বই শুধু বাড়বে না—রাজনীতির প্রায় পুরোটাই হয়তো তখন রাজনীতিকদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। আর তেমনটি ঘটলে এখন যেমন অনেক রাখঢাক ও লুকোছাপা করে তাদের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে হয়, তখন হয়তো সেটি তারা জাতীয় সংসদে ও অন্যত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই করতে পারবেন। আসলে উপলক্ষপ্রবণ এ দেশে ব্যবসায়ীরা সত্যি ভাগ্যবান। কখনো তাদের ভাগ্য খোলে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারী ইত্যাদিতে, আবার কখনো-বা তা খোলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুবাদেও। তবে ভাগ্যের চাকা শুধু খোলে না দুর্ভাগা জনগণেরই। অবশ্য সেজন্য তাদের নিজেদেরও দায় রয়েছে বৈকি। কারণ ১৯৭১ সাল ছাড়া আর কখনই তারা পরিপূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকরভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি। আর পৃথিবীর কোথায় এমনটি আছে যে সমতা, বণ্টন ও ন্যায়ের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ছাড়া কোনো গণমুখী পরিবর্তন সাধিত হতে পেরেছে?
আবু তাহের খান: গবেষক ও প্রাবন্ধিক