ঐকমত্যে আটকে আছে জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রম

রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারে থাকা উচিত জনপ্রশাসন সংস্কার

দেশের জনপ্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে জর্জরিত। বিশেষ করে বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে এর অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণের ফলে যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, তাতে রাষ্ট্রীয় সেবাদানে এর কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

দেশের জনপ্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে জর্জরিত। বিশেষ করে বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে এর অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণের ফলে যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, তাতে রাষ্ট্রীয় সেবাদানে এর কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে এ প্রশাসনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তীব্র হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়, গঠন করা হয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। প্রায় চার মাস নানা বিচার-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে এ কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে সরকারকে জনমুখী করতে জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সে মোতাবেক নানা সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকারকে এখনো সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, অনুগত আমলাদের পুরস্কৃত করতে আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্টপদ ‘সিনিয়র সচিব’ বাদ দেয়ার সুপারিশ করলেও তা বাদ দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। উল্টো ঢালাওভাবে ওই পদে নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন জায়গায়ই সিনিয়র সচিব হিসেবে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। আবার ২৫ বছর চাকরির পর সরকারের ইচ্ছায় কর্মীদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর যে বিধান রয়েছে তা বাতিলের সুপারিশও করা হয় কমিশনের পক্ষ থেকে। সেটিও আমলে নেয়া হয়নি। এছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি না করার সুপারিশটিও সরকারের পক্ষ থেকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়া পর জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের পদায়ন বা পদোন্নতি ঘিরে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটে গঠিত সরকারের কাছ থেকে কাম্য ছিল না। জনপ্রশাসনে গতি ফেরানোয় মনোযোগ না দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের মতোই মাথাভারী প্রশাসন (যেখানে শীর্ষ পর্যায়ে অতিরিক্ত জনবল আর নিচের দিকের পদগুলোয় লোকবল ঘাটতি), পুরনো আমলাদের ওপর নির্ভরতা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আধিক্য ও সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এতে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়ছে, কাজেও এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতেও জনপ্রশাসন সংস্কারের কাজে গতি না থাকাটা হতাশাজনক। জনপ্রশাসনের কার্যকারিতা শুধু রাষ্ট্রের ভিতকে মজবুত করে না, বরং নাগরিকদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতাও প্রতিফলিত করে। একটি দলীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন কখনই জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে পারে না, যা বিগত সরকারের শাসনামলে দেখা গেছে। তাই জনপ্রশাসন সংস্কার কেবল প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারের বিষয় নয়, এটি গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। গণতান্ত্রিক ধারার পুনরুদ্ধার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতিতে যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে সে সরকারের কাছে প্রত্যাশা, সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব না করে অন্তত স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। ঐকমত্যের নামে সংস্কার আটকে না থাকুক। জনপ্রশাসনের মতো জায়গায় যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়া হবে, পদায়ন করা ও ভারসাম্য বজায় রাখা হবে—সেটিই কাম্য। সরকারের এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। জনপ্রশাসনের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।

যদিও জানা গেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করছে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর। অর্থাৎ এ কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সরকারের এ ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই চাইবে জনপ্রশাসনকে তাদের স্বার্থ চরিতার্থে কাজে লাগানোর। সরকারের নিশ্চিত করতে হবে জনপ্রশাসন যেন দলীয়করণের বাইরে থাকে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার রাজনৈতিক দল বা সংশ্লিষ্টদের মতামত সংগ্রহ করছে, সেটি ইতিবাচক উদ্যোগ বটে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যেসব কার্যক্রমে তারা একমত হবেন না, সেসব ক্ষেত্রে সংস্কার কি হবে না? এতে আবারো জনপ্রশাসন কি রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার বা দলীয়করণের শিকার হবে কিনা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে জনপ্রশাসন সংস্কারের কার্যক্রম ঝুলে থাকবে? যদিও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাষ্য, সংস্কার কমিশনগুলো যে প্রস্তাব করেছে, তার মধ্য থেকে যেগুলো (১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব) নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা দরকার সেগুলো রাজনৈতিক দলের কাছে উপস্থাপন করা ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর বাইরে বাকি সংস্কারগুলো সরকার চাইলে বাস্তবায়ন করতে পারে। এ জায়গা থেকে বলা যায়, সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতিও প্রতিফলিত হচ্ছে জনপ্রশাসনের সংস্কারে। অথচ রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন জনপ্রশাসন সংস্কারে।

এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসন কাঠামোর ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো, যেমন ৪৩টি মন্ত্রণালয়কে ২৫-এ এবং ৬১টি বিভাগকে ৪০-এ কমিয়ে আনা, বিসিএস ক্যাডারগুলোকে ১২টি প্রধান সার্ভিসে রূপান্তর, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস গঠন, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমানো, ডিসিদের মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন, পদোন্নতিতে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন বাতিল এবং চাকরিতে ১৫ বছর পূর্ণ হলে স্বেচ্ছায় অবসরের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সহায়ক হতে পারে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। এছাড়া বিশ্লেষকরাও বলে আসছেন, যেসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সংবেদনশীল নয়, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে পারবে, অন্যদিকে জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে। অথচ এ সহজ পথ বেছে না নিয়ে সরকার কালবিলম্ব করছে, যা কাম্য নয়।

আরও