অভিমত

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার কি চলতেই থাকবে?

কাগজ-কলমের আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু সুস্পষ্ট দালিলিক বক্তব্য রয়েছে যে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থের পরিমাণ বহুলাংশে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবমতে একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার

কাগজ-কলমের আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু সুস্পষ্ট দালিলিক বক্তব্য রয়েছে যে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থের পরিমাণ বহুলাংশে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবমতে একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি হয়েছে। আর ওই তথ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে যে ওই রফতানি মূল্যের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৯ কোটি ডলারই দেশে ফেরত আসেনি, যা মোট রফতানি মূল্যের ২২ শতাংশ। তো, এই যে আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কাগুজে মূল্যকে বেশি করে দেখানো কিংবা রফতানি আয়ের একটি বড় অংশ দেশে না আসার মতো ঘটনা—এসব এবারই যে প্রথম ঘটল বিষয়টি মোটেও তা নয়। দেড় দশক ধরেই এমনটি প্রায় ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে এবং এ আলোচনার মধ্যে এখন আর তেমন কোনো রাখঢাকও নেই। সমাজের অধিকাংশ মানুষ এখন কারা কীভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করছে, সে সম্পর্কে কমবেশি জানে। 

তবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে প্রথম মুখ খোলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন, আমদানি-রফতানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এ মর্মে তিনি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ উল্লেখ করেন যে ১ লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস হয়েছে” (প্রথম আলো, ০১ ডিসেম্বর ২০২২)। বিষয়টি গোচরীভূত হওয়ার পর এ ধরনের ১০০টি ঋণপত্র পরে বন্ধ করে দেয়া হয় বলেও তিনি জানান। 

ওপরের দালিলিক সূত্রের তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কৌশল তার মধ্যে অন্যতম। এ কৌশলকে আশ্রয় করে কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়েও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) হিসাব অনুযায়ী ২০০৯-১৮ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে প্রায় ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি। উল্লিখিত হিসাব থেকে এটাও জানা যায় যে বাংলাদেশের এ আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৩ ভাগ পণ্যের মূল্য ঘোষণার মধ্যেই ফাঁকি বা গরমিল রয়েছে। 

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে কীভাবে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে, সে বিষয়ে প্রকাশ্যে ও অকপটে সুনির্দিষ্ট তথ্য তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ গভর্নর অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। কিন্তু কথা হচ্ছে, ওভার ইনভয়েসিং প্রচেষ্টা চিহ্নিত হওয়ার পর সেসব আমদানিকারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সেগুলো আটকে বা বন্ধ করে দেয়াই কি যথেষ্ট? যে চতুর আমদানিকারক ১ লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ দেশে আনার জন্য ২০ হাজার ডলারে ঋণপত্র খুলে হীন পথে এগোনোর চেষ্টা করেন, তাকে শাস্তির আওতায় আনা না হলে কিনি তো আবারো অন্ধকার কানাগলি খুঁজে বিকল্প পথে হীন উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করেই যাবেন। অতএব পণ্য আমদানিকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে অর্থ পাচারের যে ধারা বর্তমানে চালু আছে, সেটিকে থামাতে হলে সর্বাগ্রে চিহ্নিতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য পণ্য রফতানির আড়ালে যারা অর্থ পাচার করে, তাদের জন্যও। 

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেই নয়। উল্লিখিত ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তা যতটুকু এগিয়েছিল, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মীদের সহযোগিতা ও যোগসাজশ ছাড়া কি সেটি কখনো সম্ভব ছিল? মোটেও না। অতএব দায় শুধু এখানে আমদানিকারকের একার নয়; ব্যাংক কর্মীরাও এক্ষেত্রে সমানভাবে না হলেও বহুলাংশে দায়ী। সুতরাং শাস্তির আওতায় শুধু আমদানিকারককে আনলেই হবে না; উল্লিখিত একই অপরাধে জড়িত থাকার কারণে ব্যাংক কর্মীরও পদোন্নতি, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও অনুরূপ সুবিধাদি বন্ধ রাখতে হবে। আর পণ্য রফতানি করে ওই আয় দেশে ফেরত না আনা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া থেকে যারা গাফিলতি করে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিরত থাকে, সেই ব্যাংক কর্মীদের ক্ষেত্রেও একই শাস্তি প্রয়োগ করা উচিত বলে মনে করি। এ সামগ্রিক বিষয়টির নৈতিক দায় কিন্তু সর্বাগ্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ওপরই বর্তায়।

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে ২০০৯-১৮ সময়ে যদি ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা পাচার হয়, তাহলে ২০১৮-পরবর্তী সময়ে এ পরিমাণ যে আরো বহুগুণ হবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ আনুষঙ্গিক সব পরিসংখ্যানই বলে যে অর্থ পাচার, অর্থ আত্মসাৎ ও আনুষঙ্গিক আর্থিক দুর্নীতিগুলো গত পাঁচ বছরেই সবচেয়ে বেশি হয়েছে। তবে এসব আঁচ-অনুমানের ঊর্ধ্বে থেকে প্রকৃত তথ্য নিয়ে কথা বলা বা ব্যবস্থা নেয়ার সুবিধার্থে আশু করণীয় হচ্ছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কর্তৃক এ বিষয়ে অর্থাৎ দেশের আমদানি বাণিজ্যের সূত্রে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব প্রকাশ করা। কিন্তু বিএফআইইউ তা করছে না বলেই এ-সংক্রান্ত আলোচনাগুলো কখনো বিদেশী প্রতিষ্ঠাননির্ভর তথ্যের আলোকে আবার কখনোবা অনুমানভিত্তিক হয়ে উঠছে। ফলে ওই হিসাবের মধ্যে কিছু না কিছু ফাঁকফোকর থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া অর্থ পাচারে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রকৃত সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলে সেটিও সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কীভাবে সম্ভব? অতএব এক্ষেত্রে বিএফআরইউর এগিয়ে আসা ছাড়া বস্তুতই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো উপায় নেই।

কিন্তু বিএফআইইউর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ধরন দেখে মনে হয় যে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পরামর্শের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনোরূপ ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনোটিই তাদের নেই। অন্যদিকে বিরাজমান পরিস্থিতি ও প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে যে, আমদানি-রফতানিরকারকরাও সহসাই তাদের পাচার তৎপরতা থেকে বিরত হবেন বলে মনে হয় না। বরং শিথিল শর্তে ঋণ লাভের বিদ্যমান সুযোগের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩ জানুয়ারি যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তা থেকে ধারণা করা চলা যে বছরের সামনের দিনগুলোয় অর্থ পাচারের উল্লিখিত তৎপরতা আরো জোরদার হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ এ প্রজ্ঞাপন সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক, যদিও তারা বলছে যে এটি তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরানোর লক্ষ্যেই করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রবণতা কি সে কথা বলে? মোটেও না। বরং স্বগোত্রীয়দের আরো শর্তহীন সুবিধা দেয়ার জন্যই যে এমনটি করা হয়েছে, গত কয়েক বছরের তথ্য সে ধারণাকেই বহুলাংশে নিশ্চিত করে।

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের বাইরেও আরো নানা কায়দায় দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। প্রবাসী কর্মীদের দ্বারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানো সেসব কায়দার একটি। তবে এ নিবন্ধের আলোচনা যেহেতু আমদানি বাণিজ্যকেন্দ্রিক, সেহেতু এর উপসংহারটিও তা নিয়ে হওয়াটাই সমীচীন। সেক্ষেত্রে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে বলা চলে যে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান নীতি, চর্চ্চা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আশু কোনো পরিবর্তন না এলে আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচারের বর্তমান ধারায় এতটুকু কোনো খামতি আসবে না। বরং অর্থ পাচারের বিশ্বক্রমে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান যেখানে ৪৬তম, বছর শেষে সে অবস্থানের আরো অবনতি ঘটবে বলেই ধারণা করা চলে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি তাহলে থামবে কোথায় যেয়ে? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এ দেশ থেকে পাচারকৃত সম্পদ ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি গড়ে দিতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল। পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক কালে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পাটসহ অন্যান্য সম্পদের আয় দিয়ে গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পভিত্তি। এসবের বিপরীতে এখনকার পাচারকৃত অর্থ কি তাহলে সীমিত পরিসরে হলেও পশ্চিম ও পূর্ব আটলান্টিক, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে একটু একটু করে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে? আর বাংলাদেশ হয়ে উঠছে সেই আগের মতোই নতুন ঔপনিবেশিক দেশগুলোর নতুন পশ্চাদ্‌ভূমি?

দেশের নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত প্রণেতাদের কাছে তাই আবারো অনুরোধ করি, অর্থ পাচারে সহযোগিতাদানের মাধ্যমে দেশটিকে একুশ শতকের নতুন ধারার ঔপনিবেশিক কাঠামোর আওতাধীন পশ্চাদ্‌ভূমি বানানো থেকে বিরত থাকুন। আর সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য বলি, একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হতে পারাটা পৃথিবীজুড়েই এখনো একটি অত্যন্ত মর্যাদার ব্যাপার, যদিও সে মর্যাদার অনেকখানিই আপনাদের নানা হীন কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে আজ হৃতপ্রায়। কিন্তু তার পরও যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকুর দিকে তাকিয়ে হলেও ওই অর্থ পাচারকারীদের সহযোগী হওয়ার কলঙ্ক থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলার চেষ্টা করুন। তাতে তলানিতে নামা দেশের মর্যাদা ও ভাবমূর্তির শেষটুকু অন্তত রক্ষা পাক এবং দেশও অর্ধমৃত অবস্থায় হলেও কোনো রকমে বেঁচে যাক। তার করার জন্য এখনো যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন-অধিকার বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে রয়েছে বলে মনে করি।

আবু তাহের খান: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরও