চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পেছনে ছিল রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

বইটিতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে, যা ব্যাখ্যা করে কেন বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, কার্যকর ও দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ন মডেল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

ড. নাওমি হোসাইন, যুক্তরাজ্যের সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের গ্লোবাল রিসার্চ অধ্যাপক। কাজ করেছেন বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগসহ সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টেবিলিটি রিসার্চ সেন্টারে। বণিক বার্তাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দি এইড ল্যাব-এর বাংলাদেশ সংস্করণ নিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, এর কারণ, প্রভাব, পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

আপনার বই ‘দি এইড ল্যাব’-এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, লেখার সময় মাঝে মাঝে আপনাকে কি-বোর্ড থেকে চোখের পানি মুছতে হয়েছে। কেন?

বইটিতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে, যা ব্যাখ্যা করে কেন বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, কার্যকর ও দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ন মডেল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ওই দুর্ভিক্ষ ছিল এক ভয়াবহ বিপর্যয়। ব্রিটিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক জন পিলগারের প্রামাণ্যচিত্র অ্যান আনফ্যাশনেবল ট্র্যাজেডি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ওপর বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করেছে। এছাড়া এ বিষয়ে আরো ভিডিও ও গবেষণামূলক উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ মুহিউদ্দিন আলমগীরের লেখা Famine in South Asia শীর্ষক বইটিও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করে, যদিও বইটি বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায় না।

মুহিউদ্দিন আলমগীর ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) অন্য অর্থনীতিবিদরা ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানা (সুপ কিচেন) ও ত্রাণ শিবিরগুলোয় একটি বিস্তৃত জরিপ পরিচালনা করেছিলেন। তাদের গবেষণায় উঠে আসে ভয়াবহ খাদ্য সংকট, মর্যাদাহানির বেদনা এবং প্রাণহানির মর্মস্পর্শী চিত্র। ওই দুর্ভিক্ষ সামাজিক অবকাঠামোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ সরকার যথাযথভাবে সাড়া দেয়ার সক্ষমতা রাখত না।

এছাড়া সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্য পাঠানো বন্ধ রাখে, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। পুরো বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। গবেষণার সময় এমন বহু মুহূর্ত এসেছিল যখন আমি আবেগে অভিভূত হয়ে থমকে যেতে বাধ্য হয়েছি। এ কারণেই আমি এটি নিয়ে লিখেছি—কারণ এ বিপর্যয়কে কখনই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

কেন ১৯৭৪ সালে এ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল? কেন এটি ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালে, যুদ্ধের পরপরই ঘটেনি? এর কারণ কী? এটি কি মতাদর্শগত সংঘাত, আদর্শগত পার্থক্য, নাকি কেবল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফল?

আমরা যা বুঝতে পারি, তা হলো দুর্ভিক্ষ সবসময়ই একটি জটিল ঘটনা, যা বহু কারণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। তবে যারা দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণা করেন, তারা একমত যে শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ঘটে তখনই যখন তা প্রতিরোধ করা হয় না—সরকার বা যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় দুর্ভিক্ষ এমন স্থানেও ঘটে, যেখানে কার্যকর কোনো সরকারই নেই। তবে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতাই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ।

কেন ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয়নি? এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭১-৭২ সালেও এক ধরনের দুর্ভিক্ষ ছিল, কিন্তু এটি ভারতের দিকে স্থানান্তরিত হয়েছিল, যেখানে যুদ্ধের ফলে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের মতোই ছিল। ১৯৭৪ সালের আগেও বাংলাদেশ বহু বছর ধরে দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছিল। যুদ্ধের পর ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে বিপুল পরিমাণে বিদেশী সাহায্য প্রবাহিত হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৪ সালের দিকে এটি হ্রাস পেতে শুরু করে এবং তা ত্রাণমূলক সহায়তা থেকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের দিকে স্থানান্তরিত হয়।

১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের পেছনে বেশ কয়েকটি কার্যকারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যা: ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়, যেখানে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যমুনা নদী ছয়বার ভেঙে পড়ে। প্রচুর ফসল নষ্ট হয় এবং বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, ফলে কৃষিকাজে নিয়োজিত দিনমজুররা কাজ হারান।

দ্বিতীয়ত, দুর্ভিক্ষ অর্থনীতি (Famine Economics): ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়, যা নিম্নবিত্তের জন্য খাদ্য দুষ্প্রাপ্য করে তোলে। চালের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, তবে চোরাচালান ও মজুদদারির ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। অমর্ত্য সেনের ‘অধিকার তত্ত্ব’ (Entitlement Theory) অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে নয়, বরং মানুষের তা কেনার সামর্থ্যের অভাবে ঘটে।

তৃতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের অভাব: ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম দ্রুত বেড়ে যায়। বাংলাদেশ সরকার তখন আর্থিক সংকটে ছিল এবং পর্যাপ্ত খাদ্য আমদানি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্যসহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের Public Law 480 (পিএল ৪৮০) অনুসারে, এটি তাদের নীতির পরিপন্থী ছিল। খাদ্যসহায়তা এক বছর দেরিতে আসে, যখন দুর্ভিক্ষ এরই মধ্যে তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ একাধিক কারণের সম্মিলিত ফল, যার মধ্যে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। যদিও মতাদর্শগত সংঘাত (যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্কজনিত সমস্যা) কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল, মূলত দুর্নীতি, বাজারে খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে না পারা এবং কার্যকর নীতি গ্রহণের ব্যর্থতার কারণেই এ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল, কিন্তু নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতার কারণেই এটি ঘটে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যসহায়তা স্থগিতকরণের বিষয়টি উঠে আসে। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ১৯৭৯-৮০ সালে Economic and Political Weekly-তে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে প্রসঙ্গটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। এছাড়া অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, যিনি আমার বইয়ের প্রথম সংস্করণের অন্যতম প্রথম দিককার পাঠক ছিলেন, এ বিষয়ে একটি ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি আমেরিকার সরকার হতাম, আমি সাহায্য দিতাম না। কারণ এটি তাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয় ছিল।” তার যুক্তি ছিল, এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র কেন খাদ্যসহায়তা স্থগিত রেখেছিল?

প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল, বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করুক। তখনকার শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। কারণ তারা একটি অনুগত সরকারকে সমর্থন দিতে আগ্রহী ছিল। এছাড়া সে সময় বাংলাদেশ ছিল ভৌগোলিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ, আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্য অনেক বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান ছিল।

তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কী বলবেন?

অবশ্যই দুর্ভিক্ষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল প্রশাসনিক অক্ষমতা। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল বিধ্বস্ত, স্থানীয় সরকার ছিল দুর্বল এবং সম্পদের ঘাটতি ছিল প্রকট। খাদ্য বিতরণের জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা ছিল না, স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহিতার অভাব ছিল স্পষ্ট। যে পরিমাণ খাদ্যসহায়তা পাওয়া গিয়েছিল, তার ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অদক্ষতা দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশ তখন খাদ্যসহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। তবে এ সহায়তা মূলত মধ্যবিত্ত ও অপরিহার্য কর্মীদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) রেশন ব্যবস্থা, যা আজও চালু আছে, ১৯৭০-এর দশকে মূলত সরকারি কর্মচারীদের জন্য কার্যকর ছিল। যদি কেউ সরকারি চাকরি করতেন, সেনাবাহিনীতে থাকতেন বা বড় কোনো কারখানায় কাজ করতেন, তবে তিনি রেশন সুবিধা পেতেন। কিন্তু দরিদ্র কৃষিজীবীরা এ সুবিধার বাইরে ছিলেন, কারণ তারা ‘প্রয়োজনীয় ক্যাটাগরির’ আওতায় পড়তেন না।

তত্ত্বগতভাবে সরকার চাইলে এ রেশন সুবিধা গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দিতে পারত, কিন্তু তা করা হয়নি। সম্ভবত নীতিনির্ধারকদের কাছে নগর মধ্যবিত্তরা ছিল বেশি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান, যেখানে গ্রামের দরিদ্র জনগণ নীরবে অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল। সরকার আদৌ বুঝতে পেরেছিল কিনা যে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা স্পষ্ট নয়।

সরকারি হিসাবে দুর্ভিক্ষে মৃত্যু সংখ্যা ২৮ হাজার বলা হলেও বাস্তব সংখ্যা সম্ভবত এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল একটি প্রতিরোধযোগ্য বিপর্যয়, যা প্রকৃতির বিপর্যয়ের পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফল ছিল।

আপনি দেড় মিলিয়ন মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। তাহলে সরকার বা কর্মকর্তারা কেন এ সংখ্যা লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন?

আমি নিশ্চিত নই তারা সংখ্যা লুকানোর চেষ্টা করেছিল কিনা, তবে যেমনটি উল্লেখ করেছি, সেই সময়ের নির্ভরযোগ্য তথ্য অপ্রতুল। এটাও বিবেচনা করতে হবে যে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের আগস্টে নিহত হন এবং সেই সময়েও দুর্ভিক্ষের প্রভাবে মানুষ মারা যাচ্ছিল। দুর্ভিক্ষ এমন সংক্ষিপ্ত ঘটনা নয় যেখানে কয়েকদিন না খেয়ে থাকার কারণে মানুষ এক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়। শুধু অনাহারই মানুষকে মারে না। শরীরের ধ্বংসই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়—হৃদপিণ্ড, লিভার ও কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি। মানুষ যা পেত তাই খাওয়া শুরু করেছিল, প্রায়ই এমন জিনিস যা তাদের খাওয়া উচিত নয়, যেমন গবাদি পশুর খাদ্য বা পাতা। এর ফলে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট চলতে থাকে। এমনকি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত খাদ্যপণ্যের দাম অত্যন্ত বেশি ছিল। আমার মনে হয় না আওয়ামী লীগ সরকার কখনো সংকটের ব্যাপকতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তারা কখনো এটি পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।

আমি যে দেড় মিলিয়ন সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছি, তা বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ মহিউদ্দীন আলমগীরের একটি বই থেকে এসেছে, যা বর্তমানে অপ্রকাশিত। খুব কম লোকই আজ এ সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করে, তবে এটি খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ফলাফল। এ সংখ্যা প্রায় সব দুর্ভিক্ষ পণ্ডিত কর্তৃক উদ্ধৃত এবং সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গৃহীত হয়।

আওয়ামী লীগের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী এবং খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির পণ্ডিত ড. আব্দুর রাজ্জাকও ১৯৯০-এর দশকে এ সংখ্যার উল্লেখ করেছিলেন। যারা এ বিষয়ে পরিচিত তারা জানেন যে এটি একটি বাস্তবসম্মত অনুমান, যদিও কেউ কেউ এটিকে রক্ষণশীল মনে করেন। মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারত।

সেই সময়ে বাংলাদেশের আজকের মতো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান ব্যবস্থা ছিল না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না এবং জনসংখ্যার আকার বা কারা ক্ষুধায় ভুগছেন সে সম্পর্কে কারো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তখন থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে ১৯৭৪ সালে এগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।

বইটিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে অনেক ছবি এঁকেছেন, কিন্তু ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের মাত্র একটি ছবি কেন?

আমি শুধু একটি ছবি খুঁজে পেয়েছিলাম। তবে সম্প্রতি ঢাকায় একজন বিদেশী আমাকে জানান, জয়নুল আবেদিনের আসলে পাঁচটি ছবি রয়েছে। জয়নুল আবেদিনের ছেলের কাছে একটি, জাদুঘরে একটি এবং কয়েকটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। তিনি সেগুলো খুঁজে বের করছেন এবং শিগগিরই প্রথম আলোতে এ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখবেন।

আমি এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম; তিনি একজন শিল্প সংগ্রাহক। আমরা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলোচনা করছিলাম এবং জয়নুল আবেদিনের কাজের কথা উল্লেখ করি। তিনি বললেন, “ওহ, আমার কাছে ওগুলোর একটি আছে।” এবং দেয়ালে সত্যিই একটি মর্মান্তিক স্কেচ ছিল—১৯৭৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, অক্টোবর। এটা সত্যিই ভয়ংকর ছিল। ওগুলোর আরো ছবি আছে।

বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, জয়নুলের ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারি সৃষ্টি করেছিল। ছবিগুলো যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য স্থানে প্রদর্শিত হয়েছিল; সেগুলো বিশ্বকে হতবাক করেছিল এবং জনসমস্যা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালের একই ধরনের ছবিগুলো এলিটদের সংগ্রহে শেষ হয়েছিল। কেউ সেগুলো দেখেনি এবং কেউ সেগুলো সম্পর্কে জানত না। কিন্তু আজ এ ছবিগুলো অবিশ্বাস্যভাবে মূল্যবান হয়ে উঠছে। এটা কি বিদ্রূপাত্মক নয়?

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে অবিভক্ত বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ এবং আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করবেন? যেহেতু আপনার মা আইরিশ এবং বাবা বাংলাদেশী (রংপুর)। আয়ারল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সংযোগ দেখতে পান?

অবশ্যই সংযোগ রয়েছে। ছোটবেলায় মা আমাকে দুর্ভিক্ষের ধারণাটির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। আইরিশ ইতিহাসসংক্রান্ত একটি বইয়ে অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের ছবি দেখে তিনি দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা গাজার মতো ইচ্ছাকৃত ও জোরপূর্বক অনাহার সৃষ্টি করা হোক না কেন, দুর্ভিক্ষ সহজাতভাবে রাজনৈতিক। এটি একটি ভয়ংকর ঘটনা, যেখানে অনেক খারাপ বিষয় ঘটে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, দুর্ভিক্ষের সময় শক্তিশালী সরকার বা সংস্থাগুলো বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের সুযোগ পায়। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় যেকোনো খাদ্য বা সহায়তা গ্রহণে বাধ্য হয়। অনাহারক্লিষ্ট মানুষের ওপর যেকোনো অনৈতিক কাজ চালানো সম্ভব।

আইরিশ দুর্ভিক্ষের গবেষকরা মনে করেন, ১৮৪০-এর দশকে আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষের সময় ব্রিটিশ সরকার আইরিশ জনগণের ওপর পুঁজিবাদী মতাদর্শ ও সামাজিক কল্যাণ মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। তারা আইরিশদের অপ্রয়োজনীয় ও ‘নিম্নস্তরের মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা করত। ১৯৭৪ সালে একই ধরনের গতিশীলতা ছিল বলে মনে হয়, যদিও চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন। আমার বইয়ে এ ধারণাগুলো তুলে ধরেছি। আমার বিশ্বাস, আমেরিকানরা খাদ্যসহায়তাকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। খাদ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে তারা বাংলাদেশ সরকারকে নিজেদের পছন্দের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চেয়েছিল।

সে সময় ‘ফেমিন ১৯৭৫’ নামে একটি আমেরিকান প্রকাশনা বেশ প্রভাবশালী ছিল। এটি একটি উদ্বেগজনক বই—বর্ণবাদী, সহিংস ও সমস্যাযুক্ত। এর মূল যুক্তি ছিল খাদ্যসহায়তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকায় যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারণ করতে পারত কারা বাঁচবে, কারা মরবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কিছু লোক খাদ্যসহায়তাকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতার অধিকারী মনে করত, এটা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এ কারণেই আমি আমার বইয়ের নাম দিয়েছি ‘দ্য এইড ল্যাব’। ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশ বিভিন্ন সহায়তা ও উন্নয়ন পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এখানে নানা নীতি ও হস্তক্ষেপ প্রয়োগ করা হয়, যেখানে অসহায় মানুষ পরীক্ষামূলক বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বইয়ে এ বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।

আরও