আগামী ১১ জুন ২০২০ সালে জাতীয় সংসদে পেশ হতে যাচ্ছে ২০২০-২১ সালের বাজেট। পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে, এ বছরের বাজেট হতে যাচ্ছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাবরের মতো এবাবের বাজেটও বিশাল অংকের ঘাটতি বাজেট হতে যাচ্ছে। আবার এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দেশে বিদেশে করোনার থাবার ৪ লাখের অধিক মানুষের প্রাণ গেছে। অর্থনীতি টালমাটাল। দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। চাকরি হারাচ্ছে মানুষ।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের করোনাকালের বাজেট কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আমি শুধু একটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে চাই। তা হলো, কী করে জনগণের হাতে টাকা পৌঁছানো যায়। মানুষের আয় বাড়াতে হলে তার হাতে ব্যয়যোগ্য টাকা থাকতে হবে। হাতে টাকা বাড়ানোর অন্যতম একটি উপায় হলো করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে দেয়া।
গত আট অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। এটিকে বাড়িয়ে তখন আড়াই লাখ টাকা করা হয়। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২ লাখ টাকা ও ২০১৩-১৪-তে ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা।
অবশ্য ২০১৫-১৬ পর প্রতি অর্থবছর গড়ে ৫ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি থাকলেও আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এ সীমা বাড়াতে পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সংগঠনসহ সব মহল থেকে দাবি জানানো হয়েছিল। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত করমুক্ত আয়সীমা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫ লাখ রুপি করেছে। এমতাবস্থায় আয়করের বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার জোর দাবি আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা। এর বেশি বার্ষিক আয় থাকলে এলাকাভেদে ন্যূনতম ৩-৫ হাজার টাকা আয়কর দেয়ার বিধান আছে। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ৩ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতারা ৪ লাখ টাকা ও গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতারা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। বর্তমানে এলাকাভেদে ন্যূনতম কর হারে পার্থক্য আছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জন্য ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা, অন্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৪ হাজার টাকা এবং জেলা শহরের করদাতাদের ৩ হাজার টাকা কর দিতে হয়।
অন্যদিকে আয় অনুযায়ী কর নির্ধারিত আছে। আড়াই লাখ টাকার পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখের জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লাখের জন্য ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখের জন্য ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর নির্ধারিত আছে।
আমরা কেন ব্যাক্তিশ্রেণির করসীমা বৃদ্ধি করতে বলছি তার কারণ নিম্নে সন্নিবেশ করছি:
ব্যাক্তিশ্রেণির করসীমা ২ লাখ ৫০ লক্ষ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হোক। আমাদের দেশের একটি পরিবার চালাতে আয় করেন মাত্র একজন। গড়পড়তা পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ এর ওপরে। তার ওপর বাবা, মা, ভাইবোনদের প্রায়শই সংসার চালানোর খরচ দিতে হয়। এতে করে ধরি, একজন লোকের আয় বাড়িভাড়ার খরচ ছাড়াও মাসে যদি ২৫ হাজার হয় তবে তাকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। তাই ২৫ হাজার টাকা বেতনের একজন লোকের পক্ষে আয়কর দেয়া দিবাস্বপ্নের মতো।
আবার বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে রয়েছে জটিল হিসাব । মাসে ২৫ হাজার টাকা বাড়িভাড়া বা বছরে ৩ লাখ টাকা একজন লোক কর অব্যাহতি পায়। কিন্তু যার বাড়ি ভাড়া বাবদ আয় মাসে ২৫ হাজারের কম তার জন্য এখানে রেয়াতের বিষয় থাকছে না।
তাই আমাদের প্রস্তাব সাধারণ মানুষের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার সঙ্গে বাড়ি ভাড়ার ৩ লাখ টাকা ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত সীমার মধ্যে আনা হোক।
আমাদের করমুক্ত সীমা শুরু হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে এবং করহার শুরু হয় ১০ শতাংশ থেকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর করমুক্ত আয়ের সীমা আমাদের দেশের তুলানয় ঢের বেশি। ভারতে কর হার শুরু হয় ৫ শতাংশ থেকে, পাকিস্তানে কর হার শুরু হয় ২ শতাংশ থেকে, থাইল্যন্ডে কর হার শুরু হয় ৫ শতাংশ থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে করমুক্ত সীমা এবং কর হারের দিক থেকে শ্রীলংকার পরে বাংলাদেশের অবস্থান।
তাই পার্শ্ববর্তী দেশ এবং করোনাকালে দেশের মানুষের জীবনে সামান্যতম স্বস্তি দিতে ন্যূনতম করমুক্ত সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা হওয়া সময়ের দাবি। আমরা পাশাপাশি কর হারের নিম্নলিখিত পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করছি:
৩ লাখ ৫০ হাজারের ওপর থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার পর্যন্ত ৫ শতাংশ , পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ রাখার জোর দাবি জানাচ্ছি।
বেশি কর আদায়ের জন্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিটি জেলা উপজেলায় করজাল বিস্তৃত করতে হবে। উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে এখন এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা এখনও করের আওতায় আসেননি। তাদের কর জালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অনেক বাড়িওয়ালা, পেশাজীবী, ডাক্তার প্রচুর আয় করেন, তাদের আয়কে করের আওতায় আনা যেতে পারে।
করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর প্রদানে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো উচিত। আমাদের ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৪৬ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী নাগরিক রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করেন ২২ লাখের মতো করদাতা।
কর আদায় আরও সহজ করতে হবে। করহার কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোকে উৎসাহিত করে সফল হলে মোট কর রাজস্ব অনেক বাড়বে। কর প্রশাসনকে উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করার কথা বিবেচনা করা যায়।
কর আদায়ে অর্থনীতিবিদ স্মিথের চারটি নীতি হলো- করদাতা সামর্থ্য অনুযায়ী কর দেবে। কখন, কীভাবে ও কত কর দেবে, তা করদাতার জানা থাকবে। করদাতা সুবিধাজনক সময়ে কর দেবে এবং কর সংগ্রহের ব্যয় সর্বনিম্ন হবে। এই নীতিগুলো বাস্তবে পরিণত করলে কর আদায় বাড়বে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
বিদ্যমান করদাতাদের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে বরং নতুন নতুন করাদাতা বাড়ানোর এবং প্রগতিশীল হারে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া উচিত বলে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদই মনে করেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে দেশের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। মূলত কর ছাড় দিয়ে নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই করমুক্ত আয়সীমা একলাফে দ্বিগুণ করেছে ভারত। আমাদেরও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফি বছর করমুক্ত সীমা বাড়ানো উচিত। আমরা আশা করছি, অর্থমন্ত্রী আমাদের দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে করের নিম্ন সীমা এবং করহার সমন্বয় করবেন।
লেখক, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক