পানি, বাতাস ও মাটিসহ পরিবেশের কোনো উপাদানের যখন মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবজগতের ওপর নেতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বা ফেলতে পারে তখন তাকে পরিবেশ দূষণ বলা হয়। পরিবেশ দূষণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন বায়ুদূষণ, পানি দূষণ, শব্দদূষণ এবং মাটি দূষণ। বর্তমান সময়ে দূষণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো বায়ুদূষণ। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে মানুষ যখন আগুন ব্যবহার করে রান্না করতে শুরু করেছে তখন থেকেই বায়ুদূষণের সূচনা। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য দৈনিক ২-৩ লিটার পানি পান করে, অন্যদিকে ফুসফুসের জন্য প্রয়োজন ২ হাজার লিটার বাতাস। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ বায়ু। বায়ুমণ্ডল মূলত বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের সংমিশ্রণ, এগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রধান। এছাড়া বায়ুমণ্ডলে রয়েছে নিয়ন, হিলিয়াম, ক্রিপটন, জেনন, হাইড্রোজেন, ওজোন প্রভৃতি স্বতন্ত্র গ্যাস। বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাস একটি নির্দিষ্ট হারে থাকে, যা মানুষসহ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। বায়ুমণ্ডলে এসব গ্যাস বিভিন্ন কারণে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সে অবস্থাকে বলা হয় বায়ুদূষণ।
অন্যদিকে গ্রামের তুলনায় নগর এলাকায় বায়ুদূষণের প্রকৃতিও ভিন্ন হয়। নগরায়ণের ধারা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে অনেক ক্ষেত্রে। কারণ নগর এলাকায় নানা ধরনের সামগ্রী ও সেবার প্রয়োজন যেগুলো বায়ুদূষণের জন্য মূলত দায়ী। যেমন নগর এলাকায় জনঘনত্ব ও আবাসিক স্থাপনার ঘনত্ব অধিক। এখানে অনেক মানুষের খাবার রান্নার প্রয়োজন হয়, ফলে প্রচুর পরিমাণে বায়ু দূষণকারী গ্যাস উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে নগর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতে যানবাহন থেকে প্রচুর কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন নির্গত হচ্ছে যা বায়ুদূষণের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। যানবাহনগুলো প্রধানত ডিজেল, পেট্রল ও সিএনজি ব্যবহার করে। যানবাহনগুলোর ইঞ্জিনে ত্রুটি, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার না করা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ফিটনেসের অভাব ইত্যাদি কারণে নগর এলাকায় দূষণের মাত্রা বেশি। মানুষের বসবাসের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে আমরা পরিবেশ বলি। শহর এলাকার সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি মানুষের বসবাসের প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করে তখন সেই পরিবেশে বসবাস করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ প্রতিকূলতা অথবা দূষণ পরিবেশকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। নগর এলাকায় বায়ুদূষণ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত একটি বিষয়। বাংলাদেশের নগর এলাকায় নির্মল বায়ু এখন অকল্পনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রতি ছয়টি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ী দূষণ। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে বায়ু, পানি ও মাটির দূষণ জাতীয় কারণে। দূষণের কারণে বিশ্বে ২০১৫ সালে মোট ৯০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে বেশির ভাগ মারা যায় বায়ুদূষণে।
বায়ু পরিবেশের অন্যতম একটি মৌলিক উপাদান। সুস্থ ও নির্মল বায়ু ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর। আমাদের নগর পরিবেশে বায়ুর অবস্থা শোচনীয়। গ্রামের চেয়ে নগর এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি হওয়ার মূল কারণ বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন আকারের যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া, শিল্প-কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, ইট ভাটার কালো ধোঁয়া, টায়ার ও প্লাস্টিক পোড়ানোর ধোঁয়া। তাছাড়া শহর এলাকায় রাস্তাঘাট সংস্কারকাজে বিটুমিন পোড়ানো, এসি থেকে নির্গত গ্যাস, ফটোকপি মেশিন চালানো, মশার কয়েল, অ্যারোসল, ইট ভাঙার মেশিন এবং নিরাপত্তা রক্ষার্থে পুলিশের ব্যবহৃত টিয়ার গ্যাস ইত্যাদি নগর এলাকায় বায়ুদূষণের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী। তাছাড়া নগর এলাকার গৃহস্থ ধুলাবালি, রাস্তার ধুলাবালি ও শহর এলাকায় বায়ুদূষণের একটি অন্যতম উপাদান। মানুষ বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। এ বায়ু যদি দূষিত হয় তাহলে মানুষের বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী বায়ুতে পাঁচটি (সাসপেনডেট পার্টিকোলেট ম্যাটার, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ওজোন) বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বায়ুর মান অনুযায়ী বায়ুকে ছয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যথা— ১. ভালো (বায়ুর মান:- ০-৫০), ২. মোটামুটি (৫১-১০০), ৩. সতর্ক অবস্থা (১০১-১৫০), ৪. অস্বাস্থ্যকর (১৫১-২০০), ৫. খুব অস্বাস্থ্যকর (২০১-৩০০) এবং ৬. অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর (৩০১-৫০০)।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মৃত্যু ঘটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং ২৫ শতাংশ মানুষ মারা যায় ফুসফুসে সমস্যাজনিত কারণে। হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে, এর মধ্যে বেশির ভাগ নগর এলাকার। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের জন্য ইটের ভাটা ৫৬ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ২৮ শতাংশ এবং সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলা থেকে ১৬ শতাংশ দায়ী। মূলত সবগুলো বিষয় নগরের সঙ্গে জড়িত। নগর এলাকা মানুষের বাসস্থানের চাহিদা, শিল্প-কারখানা স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিপণিবিতান নির্মাণ সবগুলোর জন্য প্রতিনিয়ত ইটের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে CASE (Clean Air and Sustainable Evironment) প্রজেক্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ইট তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে ৭ হাজার ৯০২টি। এসব প্রতিষ্ঠানে ইট তৈরিতে পোড়ানো হয় কাঠ, কয়লা, কাঠের গুঁড়া, ফার্নেস অয়েল এমনকি বাতিল টায়ার ও প্লাস্টিক। আবার ১ লাখ ইট পোড়াতে প্রায় ২০ টন কয়লার দরকার হয়। এ ইট তৈরি করতে গিয়ে অতিরিক্ত কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড যা দূষিত করছে সমগ্র বায়ুমণ্ডলকে। যেকোনো শিল্প এলাকার বায়ুতে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ১০) স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রাম। বাংলাদেশের ইস্পাত খাতের অধিকাংশ কারখানা চট্টগ্রাম শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় হওয়ায় এসব এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যধিক, সেখানে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ১০) মান গড়ে ৪০০-৯০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। এসব কলকারখানা প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে পরিবেশের ক্ষতি ও দূষণ করছে।
নগর জনসংখ্যার আবাসন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নগর এলাকায় পুরনো ভবন ভাঙা, নতুন নির্মাণ ও ভবন নির্মাণ সামগ্রীর কারণেও বায়ুদূষণ বাড়ছে। আবার আবাসন তৈরির অন্যতম উপাদান ইট প্রস্তুত করতে গিয়ে আগুন দিয়ে কাঠ-কয়লা পোড়াতে হয়, যা নগর এলাকার বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। শহরে মানুষের অভিগমনের মূল লক্ষ্য থাকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি অথবা যেকোনো পর্যায়ের ব্যবসা। কিন্তু পেশাগত যাতায়াতের ক্ষেত্রে পরিবহন অন্যতম একটি মাধ্যম। এছাড়া শহর এলাকায় চলাচলরত ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে লাগানো ডিজিটাল বিলবোর্ড, যত্রতত্র ফটোকপির দোকান, শহর এলাকায় জলাশয় ভরাট, বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন ও দীর্ঘদিন বৃষ্টিহীন অবস্থা প্রভৃতি নগর এলাকায় বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। তাছাড়া শহরের খাল, নালা পরিষ্কার করার সময় বর্জ্যগুলো রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয় এবং ডাস্টবিনের বর্জ্যগুলোর কারণেও শহরের নির্মল বায়ু হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক। বায়ুদূষণের ফলে মাথা ও বুকব্যথা, বমি, নাক-মুখ জ্বালাপোড়া করা, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি সমস্যা, দুর্বলতা ও মানসিক অস্থিরতা, চর্মরোগ ও ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়া, ফসল উৎপাদন হ্রাস, দেশের আর্থিক ক্ষতি এবং পরিবেশের সার্বিক অবনতি হয়। বায়ুদূষণ শহর এলাকায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে; বিশেষ করে শিশুদের মাঝে এর প্রতিফলন বেশি, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। চিকিৎসকদের মতে, বায়ুতে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বৃদ্ধি পেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট ও স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায় এবং বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়। বায়ুদূষণে তিন শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়: শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী মায়েরা।
সুতরাং পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে শহর এলাকায় সবুজবেষ্টনী স্থাপন; মানুষ ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঘনত্ব হ্রাস; পরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তার উন্নয়ন ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ; শহরের সড়কগুলোয় দৈনিক দুইবার পানি ছিটানো; অপ্রয়োজনীয় রাস্তা খনন বন্ধ; পরিবেশবিদ, পরিবেশ ও বন অধিদপ্তর, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে সমন্বয় টিম গঠন এবং বায়ু শোধন যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন করলে নগর এলাকায় বায়ুদূষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে।
ড. মো. ইকবাল সরোয়ার: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়