ব্যাংক খাতের দুর্দশার দায় অডিট ফার্ম ও ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানেরও

অর্থনীতির সুরক্ষায় নিরীক্ষা ও ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারত্ব জরুরি

সামষ্টিক অর্থনীতি উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত স্বচ্ছ ও মানসম্পন্ন আর্থিক প্রতিবেদন। বিশেষ করে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে অর্থনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সামষ্টিক অর্থনীতি উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত স্বচ্ছ ও মানসম্পন্ন আর্থিক প্রতিবেদন। বিশেষ করে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে অর্থনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাই এ প্রতিবেদনে বানোয়াট তথ্যের উপস্থিতি থাকলে সেটি স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করে। একই সঙ্গে সম্পৃক্তজনদের আস্থার সংকট তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়ে ব্যাংক খাতের অবস্থায়ও। বলা বাহুল্য, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের যে দুরবস্থা, এর দায় তাই বর্তায় অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ছিল ব্যাংকগুলোর লেনদেন, ঋণমান ও ঝুঁকি, খেলাপি ঋণ, সম্পদের গুণগত মান ইত্যাদি বিষয়ের প্রকৃত চিত্র আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বরং ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকাশ করেছে মিথ্যা তথ্য।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে, সেগুলোর প্রতিটি থেকেই অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, বহির্নিরীক্ষক ও ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় সেগুলো উদ্ঘাটন বা সংশোধনের পরিবর্তে সত্যায়ন করা এবং নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে অনিয়মগুলোকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষক বাদে অন্য কোনো ব্যাংকের নিরীক্ষক আর্থিক প্রতিবেদনে তাদের মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেননি। বরং ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তৈরি করা আর্থিক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে প্রকৃত ও স্বচ্ছ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে বলে মত দিয়েছেন। উপরন্তু সব ধরনের স্থানীয় আইন ও বিধি-বিধান, আন্তর্জাতিক মান এবং নিরীক্ষকদের পেশাগত নীতি-নৈতিকতা অনুসরণ করে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে বলে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার নিরীক্ষকদের আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলোর ঋণমান নির্ধারণ করেছে মোট চারটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একাই পাঁচটি ব্যাংককে রেটিং দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছে ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড (ইসিআরএল)। সেই পাঁচ ব্যাংকের ক্ষেত্রেই পূর্বাভাস স্থিতিশীল রেখেছিল ইসিআরএল।

অর্থাৎ নিরীক্ষিত প্রতিবেদন ও ক্রেডিট রেটিং অনুযায়ী ওই ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশেষ করে সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা পুরোপুরি উন্মোচন হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর দুর্দশাকে নির্দেশ করে। ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি এতটা ভঙ্গুর হয়ে ওঠার পেছনে নিরীক্ষা, নিরীক্ষক ও ঋণ মান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারত্বের অভাবকে দায়ী মনে করছেন আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরাও। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে তথা আর্থিক ও ব্যাংক খাতের সুরক্ষায় নিরীক্ষা ও ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার দিক থেকে কোনো ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা। বিগত সরকারের আমলে যে কারণে মূলত আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করে নিরীক্ষা করতে ও ঋণমান নির্ধারণে, সেটিও অনুসরণীয় হতে পারে।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলো হলো মুডি’স, ফিচ রেটিং ইত্যাদি। সাধারণত আর্থিক খাতের একাধিক সূচক বিশ্লেষণের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রেডিট রেটিং করে। ব্যাংকের আমানত, বিনিয়োগ খাত ও রিটার্ন, কত দ্রুত গ্রাহক চাওয়া মাত্র আমানত ফেরত দিতে সমর্থ, কোন খাতে ঋণ বেশি দেয়া হয়েছে ও সেখানে ঝুঁকি কেমন ইত্যাদি যাচাই করা হয়। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ কতটা সুদৃঢ় সেটিও পর্যালোচনা করা হয়। তবে ঋণমান পর্যালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো ব্যক্তির ব্যাংক লেনদেনের সার্বিক পরিস্থিতি, যেটি দেশের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তবে একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক রকম সূচক বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে বলে রেটিংয়ে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। আবার আন্তর্জাতিক আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন Deloitte, PwC, EY, KPMG) আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনার ক্ষেত্রে করপোরেট ব্যবস্থাপনার মূল্যায়ন করে এবং অংশীদারদের সঠিক তথ্য প্রদানে সহায়তা করে। এ ধরনের পেশাগত চর্চা এখানে নেই বললেই চলে। একদিকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চায় যে তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হোক। কারণ এর ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়া সহজ হয়। অন্যদিকে নিম্নমানের নিরীক্ষা ও ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাওয়ার জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কথামতো বানোয়াট প্রতিবেদন তৈরি করে। এ ধরনের অনৈতিক চর্চা থেকে প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। ‍নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) পেশাদার নিরীক্ষকদের নিরীক্ষাচর্চার সনদ দেয়। এ প্রতিষ্ঠানের সনদ ছাড়া কেউ নিরীক্ষা করতে পারে না। এছাড়া নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ও পেশাগত নৈতিকতার লঙ্ঘন হলে সনদ বাতিল কিংবা স্থগিতের ক্ষমতাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে আইসিএবিকে দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে নিরীক্ষকের দিক থেকে পেশাদারত্ব বজায় রাখা হয়।

যদিও নিরীক্ষকের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে আইসিএবি সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারেই নিরীক্ষককে মতামত দিতে হয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়া ঋণের বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নিরীক্ষকের থাকে না। এছাড়া পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ না থাকলে শুধু সন্দেহের বশে নিরীক্ষকের মতামত দেয়ারও সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু বিধিনিষেধের কারণে ব্যাংকের নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ফাঁকফোকর থেকে গেছে। সুতরাং এসব ফাঁকফোকরও পূরণ করতে হবে। সর্বোপরি নিরীক্ষক ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি নিরীক্ষা ও আর্থিক প্রতিবেদনের মান যাচাই ও তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকেও (এফআরসি) স্বচ্ছ প্রতিবেদন নিশ্চিতে সক্রিয় হতে হবে। সংস্থাটি যাতে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

আরও