বিদেশী ঋণ পাওয়ার চেয়ে পরিশোধ বেশি

পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে বিদেশী অর্থায়ন বাড়বে না

বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের প্রধান উৎস বিদেশী ঋণ। বর্তমানে দেশে বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এ ঋণের সিংহভাগই নেয়া হয় বিগত আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের প্রধান উৎস বিদেশী ঋণ। বর্তমানে দেশে বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এ ঋণের সিংহভাগই নেয়া হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশের আয় ও পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় এ ঋণের পরিমাণ অত্যধিক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয়ও অনেক বেশি। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পেই বেশি ঋণ করা হয়েছে। ফলে প্রকল্প চালু হলেও তা থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল আসছে না। ঋণ করেই এখন ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ফলে দেশের অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের অর্থ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় অর্থছাড় হয় কাজের অগ্রগতির ওপর। যতটুকু কাজ হয়, সেটির ওপরই উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ ছাড় করে। দুই মাসের আন্দোলন এবং সরকার পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতিসহ সব ধরনের কার্যক্রমে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হওয়ায় প্রকল্পের কাজে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এসব কারণে ঋণের অর্থছাড়ও কম হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে বিদেশী অর্থায়ন বাড়বে না। উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রমেও আনতে হবে গতিশীলতা। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দিন দিন ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে। দেশে রেমিট্যান্স, রফতানি আয় বাবদ বৈদেশিক মুদ্রার পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ থেকেও ডলারের জোগান আসে। নতুন ঋণ গ্রহণ কমে যাওয়ার কারণে ও আগের ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে দেশে ডলার আসছে কম, অন্যদিকে দেশের বাইরে ডলার চলে যাচ্ছে। এতে বাজারে ডলারে সংকট আরো প্রকট হয়ে উঠতে পারে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশের অনুকূলে ১২০ কোটি ২০ লাখ ডলারের বিদেশী ঋণের অর্থ ছাড় করা হয়েছে। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। যেখানে গত বছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১১০ কোটি ১৫ লাখ ডলার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নতুন করে বিদেশী সহায়তার প্রতিশ্রুতিও ব্যাপক মাত্রায় কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে ২৮৮ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছিল।

বিগত সরকার দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ নেয়। এসব প্রকল্পের অনেকগুলোই বাস্তবায়ন হয়েছে। বেশ কয়েকটির কাজ এখনো চলমান। এরই মধ্যে বাস্তবায়িত অনেক প্রকল্পের বিদেশী ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ দুটোই বেশ চাপে পড়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও বিভিন্ন ধরনের বকেয়া ও ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে। বাড়তি এ চাপ সামাল দিতে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাড়তি অর্থ চেয়েছে সরকার।

চলতি অর্থবছরে পদ্মা রেল সংযোগ, মেট্রো রেল ও কর্ণফুলী টানেলসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আলাদা চাপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু মেট্রো রেল ছাড়া পদ্মা রেল সংযোগ ও কর্ণফুলী টানেল থেকে তেমন আয় আসছে না। যে আয় আসছে তার চেয়ে বেশি রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে নিজের তহবিল থেকে এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ৩৩৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬৮ কোটি ডলার বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে সরকারকে এত ঋণ পরিশোধ করতে হয়নি।

বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণ স্থিতি মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। যদিও ঋণের এ অনুপাতকে অর্থনীতির জন্য মোটেই উদ্বেগজনক মনে করেনি বিগত সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশী ঋণ-জিডিপির অনুপাত হিসাব করাই অর্থহীন। কারণ দেশে কর-জিডিপির অনুপাত খুবই কম, যা ৮ শতাংশের নিচে। এর অর্থ হলো, সরকার নিজস্ব আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম নয়। এজন্য এখানে জিডিপির সঙ্গে ঋণের অনুপাত হিসাব করে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশে ঋণের অনুপাত তুলনা করতে হবে সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে। কোনো দেশের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২০০-২৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৪০০ শতাংশের বেশি। সে হিসাবে সরকারের ঋণ অনেক আগেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর থেকে বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এ চাপ সামনে আরো বাড়বে। তবে ডলারের জোগান ও রাজস্ব আয় না বাড়লে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। এ কারণে পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি বেড়ে চলেছে। এছাড়া ঋণ পরিশোধ মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানোর ফলে বাড়তি সুদের পাশাপাশি দণ্ড সুদও দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে এর বিপরীতে দণ্ড সুদসহ চড়া সুদ দিতে হয়। মোট কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বাড়ায় ও দফায় দফায় ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে দণ্ড সুদ আরোপ করা হচ্ছে। এতে সার্বিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি। একই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ায় টাকার অংকে বাড়তি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে।

বিদেশী ঋণের চাপ কমাতে হলে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনা জরুরি। প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করতে না পারা বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। বরাদ্দকৃত অর্থও সময়মতো ব্যয় করতে পারে না। ফলে দাতা সংস্থাগুলোর বড় অংকের প্রতিশ্রুতি পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে। তবে সরকারকে প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলে সহায়তার প্রতিশ্রুতিও বাড়তে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। নেই রফতানিতে বৈচিত্র্যও। বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাতও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক নিচে। বিদেশী ঋণের চাপ মোকাবেলায় রাজস্ব আহরণ বাড়ানোসহ রফতানি বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে। অর্থাৎ নতুনভাবে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করে নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।

আরও